বৈষম্যহীন বাংলাদেশের জন্য রাষ্ট্রীয় প্রতারণা বন্ধের কোনো বিকল্প নেই। রাষ্ট্র নিজ উদ্যোগে ভালো হয়ে যাবে এটা সুদূর-পরাহত। তাই রাষ্ট্রের সবল সহযোগিতায় পরিচালিত কর্পোরেট কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পগুলো ভাঙতে প্রয়োজন শক্তিশালী স্বাধীন পেশাজীবী সংগঠন। পেশাজীবী সংগঠন মানে ক্ষমতাচাটা শ্রমিক লীগ/দল/শিবির না। সত্যিকারের সংগঠন যাদের মূল লক্ষ্য হবে শ্রমিকের অধিকার আদায়।
তিউনিসিয়ার জেসমিন বিপ্লব ও লেবার ইউনিয়ন UGTT
২০১১ সালের জানুয়ারিতে পুলিশী হয়রানির প্রতিকার না পাওয়ার প্রতিবাদে, মোহাম্মদ বুআজিজি পেট্রোল ঢেলে নিজের শরীরে আগুন ধরিয়ে দেন। পরে সেই ক্ষুদ্র আগুনই দাবানল হয়ে ধেয়ে আসে ক্ষমতার দিকে। ঐ ঘটনার এক মাসের মধ্যে বেকারত্ব, মূল্যস্ফীতি, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহারে পিষ্ট জনগণের তীব্র আন্দোলনের মুখে, তিউনিসিয়ার ২৩ বছরের স্বৈরশাসক বেন আলি পালিয়ে যায় সৌদি আরবে।
তিউনিসিয়ার বিপ্লবকে আরব বসন্তের সবচেয়ে উজ্বল সন্তান এমনকি দীর্ঘ মেয়াদে একমাত্র সফলতা হিসাবে বিবেচনা করা হয়। কারণ তিউনিসিয়াই একমাত্র যারা বিপ্লব পরবর্তী গৃহযুদ্ধ, সামরিক শাসনসহ অন্যান্য অপশক্তিকে প্রতিরোধ করে অন্তত দশ বছর গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে পেরেছিল। গণতন্ত্রকে উন্নতির ধারায় রাখতে হলে হঠকারীতার প্রতিবাদে ক্ষমতার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে এরকম শক্তিশালী গণসংগঠন প্রয়োজন। তিউনিসিয়ায় এরকম এক পেশাজীবীদের গণসংগঠন হল UGTT। এরা শ্রমিকদের পাশাপাশি জাতীয় সমস্যা সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়। যেমন ফ্রান্সের উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতার সংগ্রাম ও জেসমিন বিপ্লবের মতো জাতীয় আন্দোলনের গতি প্রকৃতি ও ফলাফল নির্ধারণে UGTT ছিল অন্যতম প্রধান অনুঘটক। ২০১১ সালের বিপ্লব পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন দল মতের দ্বন্দ্ব সংঘাতের ফলে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। এসময় সম্ভাব্য গৃহযুদ্ধ এড়িয়ে বৈপ্লবিক আদর্শকে সমুন্নত রাখতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে UGTT। তাদের এই অনবদ্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ২০১৫ সালে আরও কয়েকটি সংগঠনের সাথে মিলিতভাবে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।
বর্তমান বাংলাদেশ ও রাষ্ট্রীয় প্রতারণা
সম্পূর্ণ কায়িক শ্রম নির্ভর অর্থনীতি হবার পরও, এই বাংলাদেশে কার্যকর কোন ট্রেড ইউনিয়ন নেই।
রপ্তানি আয়ের ৮৬ ভাগ যোগান দেয় যে পোশাক খাত, সেখানে ৫০ লাখেরও বেশি শ্রমিক বছরের পর বছর নামমাত্র পারিশ্রমিকের বিনিময়ে দিনরাত অমানুষিক পরিশ্রম করে যাচ্ছে। এই নামমাত্র পারিশ্রমিকও সময় মতো শোধ করে না মালিকপক্ষ, আর ঈদের বোনাস নিয়ে টালবাহানা তো অমোঘ নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাষ্ট্রের সবল সহযোগিতায় পরিচালিত এইসব কর্পোরেট কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পগুলোর বিরুদ্ধে যখনি শ্রমিকরা আন্দোলনে নামে তখনি ঘৃণ্যতম উপায়ে দমন করা হয়। প্রকাশ্য দিবালোকে পুলিশি বর্বরতা আর অন্ধকারে ভাড়াটে সন্ত্রাসী দিয়ে শ্রমিক নেতা খুন, অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুত করা, আপোসে বাধ্য করা এসবই আন্দোলন দমনের নিত্য নৈমিত্তিক উপায়। তাছাড়াও আছে অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা বিলের মতো প্রস্তাবিত আইন যা কিনা সরাসরি শ্রমিক অধিকারের পরিপন্থী। বছরের পর বছর এভাবেই রাষ্ট্রীয় প্রতারণার শিকার তারা, যাদের হাতে ঘুরছে রপ্তানির চাকা।
রানা প্লাজার নারকীয় হত্যাকাণ্ডের পর আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ট্রেড ইউনিয়নের সুযোগ দিতে বাধ্য হয় সরকার ও মালিক পক্ষ। ওই হত্যাযজ্ঞের এক দশক পরে, এখন প্রায় ১ হাজারের মত নিবন্ধিত শ্রমিক সংগঠন থাকলেও শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না তারা। দিনশেষে ইউরোপ-আমেরিকার প্রয়োজন সুশীল ভাবমূর্তির সাথে সস্তা পণ্য, সরকারের প্রয়োজন বৈদেশিক মুদ্রা আর মালিকদের প্রয়োজন অঢেল মুনাফা। অসংখ্য অকার্যকর ট্রেড ইউনিয়ন এই তিন পক্ষকেই স্বস্তিতে রেখেছে।
শোষণের এই সর্বগ্রাসী প্লাবন থেকে বাঁচতে হলে বিভিন্ন পেশার শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। কোম্পানি ভিত্তিক পেশাজীবীদের সংগঠন, একই পেশার বিভিন্ন কোম্পানির মিলিত সংগঠন এবং জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন পেশাজীবীদের সংগঠন গণতান্ত্রিক উপায়ে পরিচালনা করতে হবে। যেমন পোশাক শ্রমিক, নির্মাণ শ্রমিক, চা শ্রমিক, আইটি শ্রমিক, কৃষক, শিক্ষক ইত্যাদি বিভিন্ন পেশার মানুষের নিজস্ব গণতান্ত্রিক সংগঠন থাকবে। আবার এইসব সংগঠনের অংশগ্রহণে একটি কেন্দ্রীয় সংগঠন থাকতে পারে যা পরিচালিত হবে ঐসব পেশার সাধারণ সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে। সংগঠন যত শক্তিশালী হবে, অধিকার আদায়ের দর-কষাকষিতে সাফল্য আসার সম্ভাবনাও তত বাড়বে। শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ করা এবং সফলভাবে সংগঠন পরিচালনার জন্য প্রাথমিক ভাবে বুদ্ধি পরামর্শ ও অন্যান্য সহায়তার জন্য সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মানবাধিকার সংগঠন গুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে। পর্যায়ক্রমে এই ধরনের সংগঠন জাতীয় সমস্যা সমাধানেও জনবান্ধব ভূমিকা রাখতে পারবে।
রাষ্ট্রের পাল্লা স্বভাবতই পুঁজির দিকে ঝুঁকে থাকে, যত দিন যায় পুঁজির পাল্লা ততই ভারী হতে থাকে। রাষ্ট্রও হয়ে উঠে পুঁজির অন্ধ পূজারী, নিতে থাকে একপাক্ষিক হঠকারী পদক্ষেপ। তাই ভারসাম্য রক্ষার জন্য জনবান্ধব শক্তিশালী গণসংগঠনের কোনো বিকল্প নেই।
তথ্য সূত্র
তৈরি পোশাকশিল্পে শ্রমিকের সংখ্যা আসলে কত(২৫ জুন ২০২৪) - https://www.prothomalo.com/business/industry/1i3102ut2e
রপ্তানি আয়ের ৮৬ ভাগ আসে পোশাক খাত থেকে(২১ আগস্ট ২০২৩) - https://samakal.com/economics/article/191377/
ধর্মঘটের সুযোগ চায় শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ(০১ মে ২০২৩) - https://www.banglatribune.com/politics/other-politics/796744/
UGTT in Tunisia receives Nobel Peace Prize(9 October, 2015) - https://www.industriall-union.org/ugtt-in-tunisia-receives-nobel-peace-prize
ধর্মঘটের সুযোগ চায় শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ - https://www.banglatribune.com/politics/other-politics/796744/
সংখ্যা বাড়লেও শ্রমিক অধিকার রক্ষায় পিছিয়ে ট্রেড ইউনিয়ন - https://bangla.thedailystar.net/business/news-577066