পোস্টস

চিন্তা

মিডলএইজ – টিনএইজ

৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন

আমি ছোটবেলায় যখন হুমায়ূন আহমেদের মিসির আলি সিরিজের গল্পগুলো পড়তাম, তখন মনে মনে যে মানুষটাকে দেখতে পেতাম সে ছিলো – চোখে পাতলা ফ্রেমের চশমা পরা, বৃদ্ধ একজন মানুষ। মাথার সামনের চুল পড়ে অর্ধেকটা জুড়ে টাক হয়ে আছে। বয়েসের শেষ সময়টায়, নিজের পছন্দ মত অমীমাংসিত কিছু রহস্যের জট খুলতে ব্যস্ত তিনি।

খুব ছোট করে বললে – বুদ্ধিদীপ্ত বুড়ো একজন মানুষ। বয়েস প্রায় সত্তরের কাছাকাছি। কদিন পরেই ওপারের ডাকে, অন্য জগতে চলে যাবেন।

কিন্তু, এই তো সেদিন… কি মনে করে যেন মিসির আলি সিরিজের পুরনো একটা বই নিয়ে বসেছি। হঠাৎ করেই একটা জায়গায় এসে চোখ আটকে গেলো। সেখানে লিখা উনার বয়েস – একচল্লিশ।

আমি ছোটখাটো একটা শক খেলাম।

ভাবলাম, একি… মাত্র একচল্লিশ। এতো চল্লিশ পেরোনো সদ্য যুবক। আমার নিজের বয়েসই তো পঁয়তাল্লিশ পেড়িয়ে গেছে। এই মানুষটা তো আমার থেকেও বয়েসে তরুণ। আর তাকেই কিনা আমি এতদিন বৃদ্ধ মানুষ ভেবে আসছি।
 

আমি মনে মনে বেশ লজ্জিত অনুভব করলাম।

.
আমার মনে হয়, পঁয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চান্ন, অদ্ভুত একটা সময়।

এই সময়টায় না নিজেকে বৃদ্ধ মনে হয়, না যুবক মনে হয়। বার্ধক্য আর যৌবনের মধ্যে কোথায় যেন একটা অস্পষ্ট রেখা। ঠিক যেমনটা আমি অনুভব করেছিলাম আমার টিনএইজ জীবনের শুরুতে।

তখন আমার বয়েস, বারো কি তের, প্রতিদিনই একটা দ্বিধাদ্বন্দ্বের ভেতর থাকতাম – আমি কি বড়, নাকি ছোট।

আমার আশেপাশের প্রায় সবাইকেই বলতে শুনতাম – তুমি এখন এইটা করতে পারবে না, তুমি এখনো অনেক ছোট।

আবার সেই মানুষগুলোই অন্য ক্ষেত্রে বলে বসতো, তুমি তো এখন অনেক বড় হয়ে গেছো, এটা তো তোমাকেই করতে করতে হবে… কিংবা, এতো বড় হইছো, এই সামান্য জিনিসটুকু বুঝতে পারছো না, আর কতো বড় হলে বুঝবা।

সারাক্ষণই আমি তখন বিভ্রান্ত – আমি কে? – ছোট, নাকি বড়?

আমি আবারও ঠিক একই রকমের বিভ্রান্তিতে আছি এখন।

একটু তারুণ্য ঘেঁষা কাজকারবার করলেই, আমার চারপাশে একটা হইহই উঠে যায় – বয়েস তো অনেক হইলো, আর কতো… এইবার একটু ম্যাচিউর হও। কতজন কানের পাশে ফিসফিস করে বলে গেলো, ভাই এইবার পুলাপাইনের মতোন ভাব নেয়া ছাড়েন…

আবার, যখন কোন ডাক্তারের কাছে যাই, সে বলে, এই ইয়াং বয়েসে আপনি এতো টেনশন নিচ্ছেন কেন? আরো বয়েস হোক তখন দেখা যাবে।

মাঝখানে কিছু দিন এক জিমে গেলাম। অল্প ওজনের দুইটা ডাম্বেল নিয়ে কসরত করছিলাম। পাশেই দেখি আমার চেয়ে সিনিয়ার একজন দুই হাতে দুইটা পঁচিশ কেজির ডাম্বেল নিয়ে সেই উঠানামা করতেছেন। আমার দিকে উনি তাকিয়ে হেসে দিয়ে বললেন, ব্রাদারের বয়েস কতো…

এইতো পঁয়তাল্লিশের আশপাশে, বললাম আমি।

আরে এই বয়েসে আপনি এই ওজন নিয়ে কি করেন। আমারে দেখেন, আমার বয়েস সাতষট্টি। আপনে তো মিয়া ইয়াং মানুষ, আরো ওজন নেন। কি ছোট ছোট জিনিস ওঠাইসেন, বলে উনি ইয়াহ ইয়াহ্ শব্দ করে ঘাম ঝরাতে শুরু করে দিলেন।

আমি পঁচিশ কেজির ডাম্বেলগুলোর দিকে অসহায় হয়ে তাকিয়ে রইলাম।

.

আবার কোন কলেজ কিংবা ইউনিভার্সিটির আশেপাশে চায়ের টঙের দোকানের বেঞ্চিতে বসলে – ছেলে মেয়েরা এসে ভেতরে ঢুকে বলে, আঙ্কেল একটু সাইড চাপেন। তখন আমি একই সাথে বিব্রত আর বিভ্রান্ত হয়ে যাই।

সেই ছোটবেলার মতো নিজেকেই নিজে আবার প্রশ্ন করি – আমি কে? – বৃদ্ধ, নাকি যুবক?

অনেক ভেবে চিন্তে মনে হলো, প্রত্যেকটা ছেলেমেয়ে একটা সময় যেমন বয়ঃসন্ধিকাল পার করে, সবার জন্যই সেটা – যৌবনারম্ভ।

ঠিক একই ভাবে, পঁয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চান্নতে এসে সবাই আরেকটা বয়ঃসন্ধিকালের ভেতর এসে পড়ে।

যদিও এই সময়ের কোন নাম নেই, তবুও ধরে নেই এটা আমার – মাঝবয়েসি কৈশোর, এটা আমার – মিডলএইজ টিনএইজ।
.
.

লিখাটা প্রথম আমার ফেসবুক ওয়ালে পাবলিশ করেছিলাম –


মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন
৩০ মার্চ ২০২৪
ঢাকা

Facebook Profile: Mohammad Anowar Hossain
Author Website: anowarstories.com

.
.