পোস্টস

গল্প

অপেক্ষা

৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

তৌকির আজাদ

 

 

যখন আমি আমার চেতনা ফিরে পেলাম তখন বড় রাস্তার কতশত গাড়ির হর্ন এসে আমার কানে লাগলো। শব্দগুলো স্বাভাবিকের থেকে তীক্ষ্ণ মনে হচ্ছে। বেশ কিছু গাড়ি, মটোর সাইকেল, ২/৩ টা বাস জটলা করে থেমে আছে। না এটার কারণ রাস্তার যানজট না - একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে।

 

একটু সম্বিত ফিরে পেতেই দেখলাম রফিক নিজের মটর সাইকেল থেকে আট দশ গজ দূরে পরে আছে। আমাদের বাইক যে মাইক্রোবাসটিকে পেছন থেকে ধাক্কা দিয়েছে সেটা দেখতে পেলাম। গাড়ির পেছনের গ্লাসটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। ঘটনার ঠিক আগে যেই ট্রাকটা দেখেছিলাম সেটার টিকিটাও দেখতে পেলাম না। রাস্তার কংক্রিটে শুধু তাজা লাল রক্তের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে।

 

সময়টা বিকেলের শেষ ভাগ। দুপুরের তীব্র সূর্যের উত্তপ্ত সাদা আলো এখন লালচে আভা ছড়াচ্ছে। রাস্তায় লেগে থাকা লাল রক্ত প্রতীকী রূপে প্রকৃতির নিজ শোভায় তার একই তালে তাল মিলিয়ে সৌন্দর্য বর্ধন করতে চাইছে। আরো

 

একটি কর্মব্যস্ত দিনের শেষে মানুষ গুলো যে উৎসুক চোখে দুর্ঘটনাটি দেখে বাড়ি ফিরছে তাঁদের মনে একটি শোকের স্মৃতি জায়গা করে নিয়েছে। তবে সবার বেলায় না । কেউ কেউ এদিকে একবার দেখেই মুখ ফিরিয়ে চলে যাচ্ছে। বাকিদের মধ্যেও দেখলাম কর্মহীন মানুষের সংখ্যা বেশি। ওদের কাজ নেই, পেট চলার বা চালানোর পথ সংকুচিত কিন্তু তাদের মনে মানবতা ্আছে।

 

মটরসাইকেল টার দিকে খায়াল করলাম, দেখলাম দুই-তিন জন মিলে মটরসাইকেল উঠিয়েছেন। কয়েকজন লোক মাইক্রোবাস চালকের সাথে কথা বলছেন। গাড়িটার ভেতর থেকে একটা ১৫-১৬ বছরের মেয়ের কান্না শুনতে পাচ্ছি। মেয়েটির মা, তাঁকে ধারে শান্ত করার চেষ্টা করছেন। 

কর্তব্যরত ট্র‍্যাফিক সার্জেন্ট তাঁদের সাথে কথা বলছে। কিন্তু আমার দিকে কেউ এখন পর্যন্ত এগিয়ে আসে নাই। আমি ভাবছি কেউ আমার সাথে কোন কথা বলছে না কেন? আমার কি করা উচিত বুঝতে পারছি না। আগে রফিকের কাছে যাওয়া দরকার। ওর বেশি কিছু হয়নিতো!

 

রফিক আমার ছোট বেলার বন্ধু। মাত্র তিন মাস আগে রফিক বিয়ে করেছে। শান্তার সাথে রফিকের পরিচয় সেই কলেজ জীবন থেকে। কলেজ থেকে দুইজন একসাথে ঘুরতে ঘুরতে ঠিক কখন একে ওপরের প্রেমে পরেছে সেটা জানা দায় আমাদের জীবনটা কেমন যেন স্বপ্নের মতো। এ রকম সৌভাগ্য সবার হয় না। আজ দুপুরেই, শান্তা, আমার পছন্দের মুরগির ভুনা খিচুড়ি , বেগুন ভাজি আর সরিষা ভর্তা দিয়ে খাইয়েছে। শান্তা খুব সম্ভবত সন্তানসম্ভবা। যদিও ওরা এখন পর্যন্ত কাউকে কিছু জানায় নি। তবে আমার ধারণা ঠিক নাকি ভুল সেটা জানি না ~ তবে খবরটা আসলেই খুশির।

 

এই সময় রফিকের কিছু হলে আমি কি জবাব দিব শান্তাকে! মনস্থির করলাম এখন এতো সব ভাবার সময় না। রফিকের অবস্থা জানতে হবে।

 

আমি রফিকের দিকে এগুচ্ছি। মটর বাইকটা মাইক্রোবাসটার কাছেই। আমি দেখলাম কয়েকজন লোক ধরাধরি করে মাইক্রবাসের পেছন থেকে একটা বডি বের করছে। বডি ভাবছি কেনো? লোকটা কে? তিনি কি বেঁচে আছেন? ভাল করে দেখতে পাচ্ছি না। লোকটার জিন্সের প্যান্ট আমার পরিধৃত পেন্টের সাথে মিলছে। শুধু পেন্টের বিভিন্ন স্থানে লাল রক্তের ছাপ। আমি আগে সেদিকে এগিয়ে গেলাম প্রথমবারের মতো লক্ষ করলাম আমি মানুষের ভিড় না ঠেলেই মানুষের ভেতর দিয়ে একেবারে মাইক্রোবাসের পেছনে এসে পৌঁছুলামা. কি করে সম্ভব সে ভাবনা টা আমার মনে উকি দিলো। কিন্তু কি করে সম্ভব! আমি স্তব্ধ হয়ে দেখছি এই রক্তাক্ত শরীরটা আমার নিজের। আমি আর বেঁচে নেই কিন্তু আমি বেঁচে আছি আমার চেতনায়।

 

আমি! মৃত্যু এবং বেঁচে থাকার মাঝে অবস্থান করছি। খুব বুঝতে পারছি দেহ বিহীন এই বেঁচে থাকার জীবন একদম ভিন্ন রকম। কিন্তু এখন সাতপাঁচ ভাবার সময় নয়। রফিকের কাছে যেতে হবে। আমার রফিককে প্রয়োজন। আমার মৃত শরীরটা কাপড় দিয়ে ডেকে রাখা হয়েছে। আমার রক্তে কাপড়টা ভিজে কেমন যেন সুন্দর দেখাচ্ছে। জীবনের সমাপ্তির সাথে সাথে কি আমার পূর্ব জীবন এর ধ্যানধারণা বা সৌন্দর্যের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেছে?

 

আমি রফিকের কাছে গেলাম। রফিকের কানের কাছে গিয়ে বললাম, ‘ রফিক উঠ, তোমাকে উঠতে হবে, এখন তোমার অনেক কাজ।‘ আমি রফিকের কপালের যে স্থানে ভাঙা কাঁচের টুকরা লেগে কেটে গিয়েছিল সেখানে স্পর্শ করলাম। তার সঙ্গে সঙ্গে আমি রফিকের মনের ভেতরটা দেখতে পেলাম। রফিক আর শান্তার কিছু স্মৃতি ভেসে উঠলো। রফিক তার অবচেতন মনে শান্তাকে নিয়ে ভাবছে।

 

আমি বললাম, ‘ রফিক শুনতে পাচ্ছ, রফিক, ও রফিক শুনতে পাচ্ছ?’ রফিক বলল, কে ? আমি বললাম, আমি! আমি তোমার সারোয়ার ভাই। রফিক বলল, সারোয়ার ভাই, আপনি এখানে কি করছেন, আপনি আমাকে ঘুমাতে দেন। দেখছেন তো শান্তা আজ হলুদ শাড়িটা পরেছে। মনে নেই আপনাকে নিয়েই তো শাড়িটা কিনেছিলাম। শান্তা রান্না দেখতে গেছে। জানেন সারোয়ার ভাই, শান্তার রান্না শেষ হলে আমরা ঘুরতে বেরুবো কিন্তু কোথায় যাব বুঝতে পারছি না। একটা কোনো ভালো রেস্তোরাঁ সাজেস্ট করতে পারবেন সারোয়ার ভাই। আমি বললাম, রফিক তুমি স্বপ্ন দেখছ এটা বুঝতে পারছো? রফিক বললও হ্যাঁ সারোয়ার ভাই। আমি বললাম, তবে ভেবে বলো, তোমার স্বপ্নে আমি কি করছি। রফিক বলল, তাই তো! আপনি আমার ভেতর কী করছেন? আপনি এখান থেকে যান। আমি বললাম, রফিক আমি বেশিক্ষণ থাকবো না। তুমি আমার কাছে এসো। রফিক বলল, না! আমি যাব না। আপনি আমাকে ডাকছেন কেন? আমি বললাম, রফিক, তুমি আর আমি একসাথে বাড়ি ফিরছিলাম। আমাদের বাইক অ্যাকসিডেন্ট করেছে।

 

রফিক আমি আর বেঁচে নেই। ওরা আমার শরীরটা অবহেলায় ফেলে রেখেছে। রফিক বললও সারোয়ার ভাই এসব কি বলছেন? আপনি বেঁচে না থাকলে এখানে আমার সাথে কি করছেন? আমি বললাম, রফিক তুমি ভুলে যাচ্ছ তুমি স্বপ্ন দেখছিলে, তুমি ঘুমচ্ছ, আমি তোমার স্বপ্নে তোমাকে আমার মৃত্যুর খবর জানাতে আসছি। আমার কথা শুনে রফিক আরো গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।

 

আমার মনে হল এভাবে আমি রফিককে জাগাতে পারবো না। রফিকের পাশে তিন/চার জন লোক রফিকের মাথায় মুখে পানি ঢালছে। আমি রফিককে আবার ডেকে বললাম, রফিক, আমি চলে যাচ্ছি, এখন তোমার স্বপ্ন দেখা শেষ। তুমি এখন জেগে উঠবে। রফিক বললও, না। সারোয়ার ভাই আপনি থাকুন, সারোয়ার ভাই, সারোয়ার ভাই ...

 

রফিক এভাবে কয়েকবার ডাকল কিন্তু আমি আর তার ডাকে সাড়া দিলাম না। পানির ঝাপটা রফিকের মুখে পড়তেই সে জেগে উঠলো। রফিকের জ্ঞান ফিরতেই রফিক আমার মৃত দেহের দিকে এগিয়ে গেলো। আমাকে ধরে কাঁদতে শুরু করলো। আমি এই দৃশ্য আর সহ্য করতে পারছি না। আমার পাশে আমি দাঁড়িয়ে আমাকে দেখছি। একবার ভাবলাম রফিককে বলি আর কান্নাকাটি করতে হবে না। আমি রফিককে স্পর্শ করতে চেষ্টা করলাম কিন্তু পারলাম না। এবার আর আগের মতো আমি ওর ভেতর ঢুকতে পারলাম না। তবে কি এখানেই আমার অপার্থিব যাত্রার শুরু ?

 

অ্যাম্বুলেন্স এসেছে। রফিক এখন আগের থেকে শান্ত। নিজেকে শক্ত করতে পেরেছে। অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরে আমি রফিকের পাশেই বসেছি। কিন্তু সে আর আমাকে দেখতে পারছে না। তবে আমি সব দেখতে পাচ্ছি, শুনতে পাচ্ছি, বলছি কিন্তু কেউ শুনতে পারছে না। অ্যাম্বুলেন্স চলার সাথে সাথে আমার কালো ছায়ার শরীর ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। আমি আর সহ্য করতে না পেরে গাড়ির দরজা ভেদ করে অ্যাম্বুলেন্স থেকে বের হয়ে গেলাম।

 

আমাকে ছেড়ে আমার শরীর দূরে চলে যাচ্ছে। অথচ আমি কিছু করতে পারছি না।

 

আমার মৃত্যুর পাঁচ বছর পেরিয়েছে। এখন আমি বাতাসে ভেসে বেড়াই। আমাকে কে যেন আমার নাম ধরে ডাকে!

 

কিন্তু কোন দিক থেকে ডাকে বা কোন দিকে যেতে হবে আমি সেটা বুঝতে পারি না। আমি দিকবেদিক ছুটে বেড়াই।

 

আমাদের সমাজে আমার মতো অনেকেই আছে যাদের অপঘাতে মৃত্যু হয়েছে কিন্তু কারোর মুক্তি হয়নি। আমরা মানুষের সমাজে ঘুরে বেড়াই কখনো আলো হয়ে কখনো ছায়া হয়ে আবার কখনো শব্দ তরঙ্গ হয়ে কখনো বা গন্ধ হয়ে। মাঝে মাঝে মানুষ আমাদের মিষ্টি গন্ধ ভেবে আনন্দ পায়। তখন আমাদের ভাল লাগে। আমরা ফিসফিস করে দুষ্টামি করে মানুষকে কত কি বলি।

 

কেউ কেউ আমাদের কথা শুনে, কেউ খেয়াল করে আবার কেউ খেয়াল করে না। কেউ উত্তর দেয়-কেউ দেয় না।

 

আমাদের অদৃশ্য জীবন বেঁচে থাকার জীবনের মতই অপেক্ষার। আমরাও সবার মত অপেক্ষারত আছি। অপেক্ষার ফাঁকে ফাঁকে আমি রফিকদের বাড়ি যাই। ওদের প্রথম সন্তান সুজন এর সাথে খেলি। আজ সুজনে’র পাঁচ বছর হবে। রফিক আর শান্তা ইদানীং খুব চিন্তিত থাকে সুজনকে নিয়ে। সুজন একা একা খেলে, একা একা কথা বলে, অন্য কারো সাথে সে কথা বলে না। আসলে আমি কথা বলতে দেই না!

 

সেদিন যদি রফিক একটু সাবধানে কথা না বলে ঠিক করে রাস্তা দেখে বাইক চালাত তবে আজ আমারও ঘরে স্ত্রী থাকতো, রফিক আর শান্তার মত ফুটফুটে সন্তান থাকতো। তাই আমি ...।

 

এসব কথা থাক। কথা গুলোও অপেক্ষা করুক। যেভাবে আমি বা আমরা অপেক্ষা করছি অনিবার্য সত্য মৃত্যু আর মুক্তির অপেক্ষায়।