পোস্টস

চিন্তা

গ্লোবাল ওয়ার্মিং এবং আকাশ যাত্রা

৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন

আমি প্রত্যেকবার প্লেনে উঠলেই আল্লাহ আল্লাহ করতে থাকি, কখন নামবো। টেনশনে আমার হাতের তালু পায়ের তালু ঘেমে উঠে। যাত্রার পুরো সময়টাতেই তীব্র মানসিক চাপ নিয়ে প্লেনে বসে থাকি। আমার যখনই মনে হয়, এই বড় কোলবালিশের মতো জিনিসটা আকাশে হাজার হাজার ফিট উপর দিয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। নিচে পানিতে ভরা সমুদ্র, নয়তো জঙ্গল কিংবা উঁচু উঁচু পাহাড়। একবার পড়ে গেলেই, কর্ম-সারা। তখনই পালপিটিশন শুরু হয়ে যায়।

প্লেন থেকে নামার পরপর ভাবি, নারে বাবা — এই জিনিসে আর কোন দিন উঠবো না। কিন্তু, তারপরও উঠতে হয়, এছাড়া হাজার মাইল পাড়ি দেওয়ার আর কোন সহজ উপায় নেই।

আমার এই প্লেনভীতির কারণেই, পৃথিবীর অনেক দেশে ট্র্যাভেল করা হয়ে উঠেনি। সামনেও হবে না। কিন্তু, কি আর করার।

যাইহোক, যে কারণে আজকে এটা লিখছি। এই মাত্র কদিন আগে, মে মাসের ২১ তারিখে লন্ডন থেকে সিঙ্গাপুর এয়ালাইন্সের একটা প্লেন উড়াল দিলো সিঙ্গাপুর যাবে বলে। সবকিছু বেশ ভালোই ছিলো, সুন্দর মতো প্রায় পৌঁছে গিয়েছিলো সিঙ্গাপুরে। কিন্তু, মায়ানমারের কাছে এসেই হঠাৎ একটা তীব্র ঝাঁকি খেয়ে গেলো।

তখন সুন্দর পরিস্কার আকাশ। তেমন মেঘ নেই। ফ্লাইটের ভেতরের যাত্রীরা আরাম করে বসেছে সকালের নাস্তা করার জন্য। ওয়েদার ভালো বলে, সিটবেল্ট বাঁধার কোন এলার্ট নেই। যে যার মতো আরাম করে খাচ্ছে, কেউ কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে। এমন সময় দুম করে হালকা একটা ঝাঁকি দিয়েই প্লেন নেমে গেলো কয়েকশ ফিট নিচে। আবার মুহূর্তেই উঠে গেলো উপরে। প্রায় নব্বই সেকেন্ড ধরে চলল এই তান্ডব।

ব্যাপারটা কেমন ছিলো বোঝার জন্য, আপনি শুধু ভাবেন — আপনাকে কেউ একটা টিনের কৌটায় ভরে দেড় মিনিট জোরে জোরে ঝাঁকাচ্ছে। একদম জাম ঘামানোর মতোন করে। পেটের নাড়িভুঁড়ি সব উল্টে বেরিয়ে আসার কথা। ঠিক এমনটাই হয়েছিলো সেদিন।

বেশ কয়েক বছর আগের ঘটনা। আমি তখন থাইল্যান্ড থেকে বাংলাদেশে ফিরে আসছিলাম ঈদের ছুটিতে আনন্দভ্রমণ শেষ করে। বাংলাদেশ বিমান নাকি থাই এয়ারলাইন্স ছিলো এই মুহূর্তে আমার ঠিক মনে পড়ছে না। ঠিক এই রকম, মায়ানমারের উপর দিয়ে উড়ে যাবার সময় হঠাৎ মনে হলো প্লেন স্যাট করে অনেক নিচে পড়ে গেলো। আমার পেটের মধ্যে কেমন যেন একটা শূন্য শূন্য অনুভূতি খেলে গেলো। এমনিতেই ভয়ে কাঠ হয়ে বসে ছিলাম। তারমধ্যে আবার এই কান্ড। মুহূর্তেই আমার কপালে ঘামের শিশির বিন্দু জমে গেলো। যাইহোক, পরে আর কোন সমস্যা হয়নি সেদিন। প্লেন থেকে নেমে আল্লাহর নাম নিয়ে বুকে একটা ফুঁ দিয়ে দিয়েছিলাম। বেঁচে থাকার আনন্দ এক অদ্ভুত আনন্দ।

যাক, সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের কথায় ফিরে আসি। সেই নব্বই মিনিটে প্লেনের ভেতর সবকিছু লন্ডভন্ড করে দিয়েছিলো এই মারাত্মক এয়ার টার্বুলেন্স। যারা তখন সিটবেল্ট বাঁধা ছিলো, তারা তেমন ব্যথা পায়নি। কিন্তু, বেশিরভাগ যাত্রীর তখন সিটবেল্ট বাঁধা ছিলো না। ফলে যেটা হয়েছে, সজোরে তাদের মাথা ঠুকে গেছে উপরের লাগেজ ক্যাবিনেটে। কারো মাথা ফেটে গেছে, কারো ব্রেইনে আঘাত লেগেছে, কারো কারো মেরুদণ্ডে প্রচণ্ড ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। ভয়ঙ্কর একটা ঘটনা, যেটা ছিলো পুরোপুরো অপ্রত্যাশিত। প্লেনের কেউ কখনো ভাবেইনি দুম করে এমন একটা ব্যাপার ঘটে যাবে। কপাল ভালো পাইলট দ্রুত প্লেন চালিয়ে ব্যাংককে প্লেনটাকে ইমারজেন্সি ল্যান্ডিং করিয়ে নেন। তারপরও, অনেকটুকু ক্ষতি হয়ে গিয়েছে এর ভেতরেরই।

এখন কথা হলো, এই ব্যাপারটা ঘটলো কেন। যারা নিয়মিত প্লেনে যাতায়াত করেন তারা সবাই জানেন এয়ার টার্বুলেন্স খুবই একটা স্বাভাবিক ঘটনা। আকাশে প্লেন চলতে চলতে যদি কোন ঘন মেঘের ভেতর ঢুকে পড়ে, কিংবা ঝড়ের ভেতর পড়ে, তখন একটু এয়ার বাম্পিং হয়। মানে প্লেন একটু দোলাদুলি করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মাত্রাটা খুব কম থাকে, আর অল্প সময়ের ভেতরে সব ঠিক হয়ে যায়।

ওয়েদার বেশি খারাপ থাকলে সেটা প্লেনের রাডারে আগে থেকেই ধরা পড়ে, তখন পাইলট প্লেন মেঘের উপরে নিয়ে যায় কিংবা নিচে নিয়ে যায় আগে থেকেই। তখন আর ঝড়ের ভেতর বা মেঘের ভেতর ঢুকতে হয় না। কিন্তু, কাহিনী হলো যদি আকাশে মেঘ না থাকে, একদম পরিস্কার, তখন কি এয়ার টার্বুলেন্স হতে পারে? উত্তর হলো – হ্যাঁ। আর ভয়টা এখানেই।

এমন পরিস্কার আকাশ থাকলে প্লেনের রাডারও মেঘ খুঁজে পায় না, কোন ঝড়ের সংকেত পায় না। পাইলট আরামসে প্লেন চালিয়ে যেতে থাকে, আর তারপর ডিকবাজির খেলা শুরু হয়ে যায় আকাশে। এই টাইপের টার্বুলেন্সগুলোকে বলে – “ক্লিন এয়ার টার্বুলেন্স”। ঝকঝকে পরিস্কার আকাশে, মৃদু মৃদু বাতাসে, রোম্যান্টিক অবস্থায় প্রকৃতি কষে চাবুক চালিয়ে দিতে পারে। ধারণা করা হচ্ছে, এবার সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের এই ফ্লাইটের (SQ321) সাথে এই ব্যাপারটাই ঘটেছিলো।

দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, গবেষণায় দেখা যাচ্ছে সামনের দিনগুলোতে আকাশে এমন ঘটনা আরো ঘটবে। এর মূল কারণ – গ্লোবাল ওয়ার্মিং। জলবায়ুর এই তীব্র প্রচণ্ডতার জন্য এমনিতেই পৃথিবী গরমে তেতে উঠছে। আর এই তেতে উঠা গরম বাতাস, অনিয়ন্ত্রিত জলীয়বাষ্প আকাশে তৈরি করছে অপ্রত্যাশিত বায়ু প্রবাহ, মেঘ আর ঝড়ের। কিছু দেখাও যায় না, বোঝাও যায় না – কিন্তু, মুহূর্তেই লঙ্কাকাণ্ড ঘটিয়ে দিয়ে চলে যায়।

বাসা বাড়িতে থাকলে ভূমিকম্প হলে দৌড়ে বাড়ি থেকে বের হবার একটা রাস্তা থাকে, কিন্তু আকাশে এইরকমের কম্পাকম্পি হলে বের হবার জন্য কোন রাস্তা নেই।

বৈশ্বিক উষ্ণতার এই বৈরী প্রভাব যে আর কোথায় কোথায় দেখতে হবে কে জানে।

২১ মে ২০২৪ - এ সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের আহত, নিহত এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছি।

.
.

মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন
২৫ মে ২০২৪
ঢাকা।

.
.

তথ্যসূত্রঃ

১। সিএনএন
২। দ্যা গার্ডিয়ান
৩। বিবিসি
৪। রিসার্চ পেপারঃ Evidence for Large Increases in Clear-Air Turbulence Over the Past Four Decades 
(https://agupubs.onlinelibrary.wiley.com/doi/10.1029/2023gl103814)

.
.

Facebook Profile: Mohammad Anowar Hossain

Website: anowarstories.com