পোস্টস

চিন্তা

আসুন সকলের মধ্যে নিজেকে অনুভব করি

৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

ফারদিন ফেরদৌস

স্বাভাবিকতার পরিবর্তে দেশ একটি অন্তর্বর্তী সময় পার করছে। ছাত্র-জনতার বৃহৎ আন্দোলনের দমকা হাওয়ায় হার্ডলাইনার রেজিম সরে গেছে। হাজার মানুষ শহীদ হয়েছেন। মারাত্মক জখম হয়েছেন তারও অধিক। সবার মাথায় এখন উত্তুঙ্গ বারুদ। একটু ঘষাতেই দাউ দাউ আগুন জ্বলে যাচ্ছে। আন্দোলনের ট্রমা থেকে কেউ বের হতে পারেনি। মাত্র তো ত্রিশ দিন পার হলো। আরেকটু সময় দিন নিশ্চয় মবসকল সুস্থির পিপলে পরিণত হবে।

তাই বলছি কেউ কৃত্রিম সংকট তৈরি করবেন না। ভুলের ফাঁদে পা দেবেন না। অল্পবয়সী যে হিন্দু ছেলেটি ব্ল্যাসফেমির অভিযোগে ব্যাপক মারধোরের শিকার হয়ে হসপিটালাইজড আছে, চোখ জখম হয়েছে, তার হয়ত প্রাণ বেঁচে গেল। অন্যত্র এমনতর ঘটনায় নিমিষে প্রাণহানির ঘটনা ঘটলেও অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না। আগুনের এইসময় কাউকে দোষারোপ করে লাভ হবে না। জিজ্ঞাসু মন নিয়ে আইনশৃঙ্খলা দেখার যেমন সময় না এখন, তেমনি নৈতিকতার কথা বলারও কোনো অর্থ নেই। কোথাও কেউ ভালো নেই। কোনো সিস্টেমই ঠিকঠাক কাজ করছে না। মবোক্রেসি, মব জাস্টিস সকলই সভ্যতার অন্তরায়। মানবাধিকার রক্ষায় সর্বোতভাবেই আইনের শাসন দরকার। সুনামি থামুক অতঃপর এমনতর সভ্যতার গল্প করা যাবে।

তাই বলি কি আমার সনাতন ধর্মাবলম্বী বন্ধু-বান্ধব, কলীগ, শুভানুধ্যায়ী, পরিচিত, ফেসবুক বন্ধু সবার কাছে আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ প্লিজ নিজেদের কোমলমতি সন্তানদের সামলে রাখবেন। সোশ্যাল হ্যান্ডেলে কী লিখে না লিখে খেয়াল রাখবেন। বাচ্চারা কেন ভিন্নধর্মের মহামানবদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করবে? পৃথিবীর সকল ধর্মকেই সম্মান করতে শেখাতে হবে। মনে রাখতে হবে ধর্মগুলো আইনের অন্যতম উৎস। মহামানবদের কথার ভুল ধরবার সুযোগ তৈরি করা মানে ওই আইনের প্রতিই অশ্রদ্ধা পোষণ করবার নামান্তর।

আমি মুসলিম হয়েও ভিন্নধর্ম ও মানুষের প্রতি সমান সম্মান পোষণ করি। যিশু, বৌদ্ধ, শ্রীকৃষ্ণ বা নানকের প্রতি ন্যূনতম অশ্রদ্ধা পোষণ করবার কথা কল্পনাতেও আসেনি কখনো। আমার পালিত ধর্ম, পারিবারিক মূল্যবোধ ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আমাকে এই সভ্যতাটুকু শিখিয়েছে। যারা মহানুভবতা, ঔদার্য, মায়া-মমতা ও ভালোবাসা শিখেনি বা শিখতে চায় না তাদের কথা আলাদা।

পবিত্র কুরআন শরীফে আল্লাহ্ সুবহানাহু তাআলা বলেছেন, এরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে যাদের ইবাদাত (পূজা-অর্চনা) করে তোমরা তাদেরকে গালাগালি করো না, তাহলে তারা অজ্ঞতা বশতঃ বৈরীভাবে আল্লাহকেই গালাগালি দিতে শুরু করবে। আমিতো এ রূপেই প্রতিটি জনগোষ্ঠীর জন্য তাদের ‘আমলকে চাকচিক্যময় করে দিয়েছি। শেষ পর্যন্ত তাদেরকে তাদের রবের কাছে ফিরে যেতে হবে, তখন তারা কী কী কাজ করেছিল তা তিনি তাদেরকে জানিয়ে দিবেন। (সূরা আল -আনাম(গৃহপালিত পশু), ১০৮)।

আমি আমার ধর্ম প্রপারলি মেনে চলতে চাই বলেই অন্যধর্মের কোনো বিধিবিধানের ওপর বিদ্বেষ পোষণ করি না, গালাগালিও করব না। আমার সম্প্রদায়ের কেউ যদি ধর্মীয় নির্দেশনা অমান্য করে ভিন্নমতাদর্শীদের গালাগাল করে সেটি একান্তই তার ব্যক্তিগত দায় হিসেবে গণ্য করতে হবে। ধর্ম বা ধর্মের প্রচারককে টেনে এনে নিন্দার লক্ষ্যবস্তু করলে সেটি কোনোপক্ষেই কোনো ভালো ফল বয়ে আনবে না।

বিদায় হজের ভাষণে আল্লাহ্'র রাসুল (সা.) বলেছেন, জেনে রেখ! অপরাধীই অপরাধ কর্মের জন্য দায়ী ও দোষী। ছেলের অপরাধের জন্য বাবা এবং বাবার অপরাধের জন্য ছেলে অপরাধী নয়। (সুনানে তিরমিজি)।

তাই যে কোনো পরিস্থিতিতেই কোনো দল বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে ঘৃণা ছড়ানো থেকে বিরত থাকতে হবে। সবাইকে অপরাধী সাব্যস্ত করা থেকে বিরত থাকতে হবে -এটাই ইসলামের শিক্ষা।

হজরত সুফিয়ান ইবনে সালিম (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘জেনে রেখ! কোনো মুসলমান যদি অমুসলিম নাগরিকের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন করে, কোনো অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ করে, তার কোনো জিনিস বা সহায়-সম্পদ জোরপূর্বক কেড়ে নেয়; তবে কেয়ামতের দিন আল্লাহর বিচারের কাঠগড়ায় আমি তাদের বিপক্ষে অমুসলিমদের পক্ষে অবস্থান করব।’ (আবু দাউদ)।

আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে কোনো অমুসলিম নাগরিককে হত্যা করল, সে জান্নাতের সুগন্ধও পাবে না, অথচ তার সুগন্ধ ৪০ বছরের রাস্তার দূরত্ব থেকেও পাওয়া যায়।’ (বুখারি, হাদিস : ২৯৯৫)।

সুতরাং আমার ধর্ম আমাকে ভিন্নধর্মের মানুষের প্রতি এতটুকু ঘৃণা করতে শেখায় না, কারো প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করতে নির্দেশ দেয় না, কাউকে অন্যায়ভাবে খুন করবার প্ররোচনা দেয় না; এটাই পরম সত্য।

প্লিজ এই সত্যটুকু মেনে নিয়ে ও মনে নিয়ে ইসলামিজমের প্রতি সহমর্মিতা পোষণ করলেই বরং সবার সুন্দর সহাবস্থান নিশ্চিত করা যায়। আমরা মানুষকে ঘৃণা করতে কেন ধর্মকে উপলক্ষ বানাবো? পৃথিবীর যেকোনো মানুষ কিংবা মহামানবকে কেন বিদ্বেষ ও হিংসার লক্ষ্যে পরিণত করব?

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অবশ্যপাঠ্য ধর্মগ্রন্থ উপনিষদের ঈষোপনিষদ পার্টে আছে... 
"যস্তু সর্ব্বাণি ভূতান্যাত্মন্যেবানুপশ্যতি। সৰ্ব্বভূতেষু চাত্মানং ততো ন বিজুগুপ্সতে।”
অর্থাৎ যখন জীব সকলের মধ্যে নিজেকে অনুভব করবে এবং সকল জীবকে নিজের মধ্যে অনুভব করবে, তখন হিংসা সরে গিয়ে অহিংসভাবে তার হৃদয় পূর্ণ হবে।

লেখক: সাংবাদিক
৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪