পোস্টস

সমালোচনা

আমাদের স্বাধীনতার সীমা কতদূর?

১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪

ফারদিন ফেরদৌস

আমরা আসলে কোন দেশের নাগরিক? নিখিল ভারত, ৪৭ পরবর্তী পাকিস্তান, একাত্তরের বাংলাদেশ নাকি ২ হাজার ২৪ এর বৈষম্যহীন বাংলাদেশের? এক অর্থে আমরা সবদেশেরই নাগরিক। পূর্বপুরুষের রক্তকে অস্বীকার করবার জো তো কারোরই নেই।

তারপরও অতীত ঐতিহ্য ও ইতিহাসকে মেনে নিয়েই এই প্রশ্নটার স্পষ্টিকরণ দরকার আছে যে, আমার দেশের সুনির্দিষ্ট ভাবাদর্শ ঠিক কোনটা?

মুক্তিযোদ্ধা কর্ণেল অলি আহমদ জোর দিয়ে দেশের বিদ্যমান জাতীয় সংগীত 'আমার সোনার বাংলা' বাতিলের দাবি তুলেছেন।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস কিংবা সরকারের তরফে এখন আর একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ শব্দটি উচ্চারিত হয় না। স্বাধীনতা যুদ্ধের পুরোধা ব্যক্তিত্ব মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, শেখ মুজিব, মেজর জিয়া বা তাজউদ্দীন আহমদের নাম কেউ মুখে নেন না। আপনাদের ভাষায় ৩০ লাখ না হোক, ৩ লাখই ধরে নিচ্ছি। একাত্তর জেনোসাইডে শহীদ তিনলাখ মানুষ কি এই জাতির কেউ না? বাংলাদেশের রূপকার মহান বীরদেরকে বিস্মৃত করবার অভিপ্রায় আমাদেরকে ঠিক কী অর্জন এনে দেবে?

সবিশেষ ঘটনা ঘটেছে গতকাল। জাতীয় প্রসক্লাবে নবাব সলিমুল্লাহ একাডেমির আয়োজনে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর মৃত্যুবার্ষিকী পালন অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেছেন, ‘পাকিস্তান না থাকলে বাংলাদেশের সৃষ্টি হতো না। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ আমাদের জাতির পিতা’

ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত নাগরিক পরিষদের আহ্বায়ক মো. সামসুদ্দিন বলেছেন, '৫ আগস্ট আমাদের বিজয় দিবস, এটিই আমাদের স্বাধীনতা দিবস!'

আমাদের মত হলো, ভারতের গুজরাটি বংশদ্ভুত আইনজীবী, রাজনীতিবিদ, নিখিল ভারত মুসলিম লীগের অন্যতম নেতা ও পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ আলি জিন্নাহভাইয়ের মৃত্যুবার্ষিকী বাংলাদেশে স্মরণ না করতে পারার কিছু নাই। কিন্তু এটা যদি হয় বাঙালিয়ানা বাদ দিয়ে পাকিস্তানি ভাবাদর্শ প্রতিষ্ঠার বাহানা -তাহলে এই অভিপ্রায় বিরোধিতা করবার মানুষ এখনো এদেশে আছে। পাকিস্তান বাঙালিদের বিরুদ্ধে চরমমাত্রার বৈষম্য, দুঃশাসন ও মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছিল বলেই আমরা আলাদা হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলাম। মিস্টার জিন্নাহ ভিনদেশী ভাষা আমাদের ওপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলেন বলেই বায়ান্নের ছাত্র-জনতা জানবাজি রেখে তীব্র প্রতিবাদ গড়ে তুলেছিল।

আপনি যদি উগ্র জাতীয়তাবাদী হন, তাহলে বলবেন পাকিস্তানের বাবায়ে কওম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহকে স্মরণ করা যাবে না। আর যদি রবীন্দ্রদর্শনে অনুপ্রাণিত হয়ে আন্তর্জাতিকতাবাদে বিশ্বাসী হন তাহলে অতি অবশ্যই জিন্নাহজিকে স্মরণ করা যাবে।

এমনকি বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষিত মাথায় রেখেও উর্দু ভাষার রসে মজা যাবে। উর্দুতে বিস্তর সুসাহিত্য ও বৈশ্বিকমানের চলচ্চিত্র আছে। ভারতের গুজরাটের দুই বরেণ্য ব্যক্তিত্বের একজন ভারতের ফাদার অব দ্য নেশন মহাত্মা গান্ধী অপরজন পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ। যে পাকিস্তানের পূর্বাংশ এখন হালের বাংলাদেশ।

বিশ্বায়নকে মেনে নিয়েও নিজেদের দেশের ফান্ডামেন্টাল যে মটোগুলো এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে বলবৎ আছে সেসবের আলোকে নিশ্চায়ন করতে হবে, আমাদের স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, জাতীয় সংগীত, জাতির পিতা কোনটা?

এর উত্তর যদি এমন হয় যে, সরকার তো বিজয় দিবস বা স্বাধীনতা দিবস নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো কোনো ন্যারেটিভ হাজির করেনি। তাহলে আমাদের পাল্টা প্রশ্ন হবে যারা এদিকসেদিক 'মনে যাহা লয় তাহা'ই দাবি করছে, তাদের ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় বয়ান বা ব্যবস্থা কী?

শেষ কথাগুলো এমন হতে পারে যে, দেশ সংস্কারের যে স্বপ্ন নিয়ে আইনের শাসনকে পাত্তা না দেয়া আওয়ামী লীগ তাড়াও আন্দোলন হলো, আমাদের বিচিত্র কর্মকান্ডে খুব সহসাই যদি ওই আওয়ামী লীগের কোর্টে বল চলে যায় তাহলে জুলাই বিপ্লবের অর্জন কী দিয়ে নিষ্পন্ন করা যাবে?

লেখক: সাংবাদিক 
১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪