গৌতম বুদ্ধ, অতীশ দীপঙ্কর, লালন ফকির আমাদের ছিলেন। আর ছিলেন ভাটি অঞ্চল সুনামগঞ্জের সাধক বাউল শাহ আব্দুল করিম। ধীরাইয়ের এই প্রাণপুরুষ -যার কথার জাদু ও সুরের ফিলোসফিতে মজে আছে আমাদের প্রজন্ম।
আমি ফুল বন্ধু ফুলের ভ্রমরা/
বসন্ত বাতাসে সইগো
বসন্ত বাতাসে
বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ
আমার বাড়ি আসে/
আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম/
আগের বাহাদুরি এখন গেল কই।
আহা এই মহান দার্শনিককে জীবদ্দশায় আমরা খুব বেশি দাম তো দেইইনি -উল্টো সমাজপতিরা তাঁকে গৃহছাড়া করে রেখেছিল। কী কষ্টই না তাঁকে দেয়া হয়েছে। কিন্তু কিছুই মনে করেননি তিনি। কারো প্রতি রাগ-বিরাগ, অভিমান বা অভিযোগ কিছুই নিজের আলোকিত অন্তরাত্মায় জমিয়ে রাখেননি। এমন সহজ ও সাদাসিধা মানুষই তো গভীর আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলতে পারেন,
আমি আছি আমার মাঝে/আমি করি আমার খবর/আমি থাকলে সোনার সংসার/আমি গেলে শূন্য বাসর।’
শাহ আব্দুল করিম আজীবন অভেদ মানুষের সন্ধান করেছিলেন। তাঁর কাছে সাম্যবাদী কবি কাজী নজরুল ইসলামের মতোই সব মানুষ ছিল সমান, এক মায়ের সন্তান। তাইতো তিনি অবলীলায় বলতে পেরেছেন, ‘এইসব নিয়ে দ্বন্দ্ব কেন/ কেউ হিন্দু কেউ মুসলমান/তুমিও মানুষ আমিও মানুষ/সবাই এক মায়ের সন্তান।’
শহুরে ব্যবসায়ী গাতক বাবুরা যখন এই মহামানবের খোঁজ পেল -তখন তারা ডেকেডুকে সম্মাননার ড্রামা করেছে। তাও প্রায় সবটাই নিজেদের স্বার্থে। আরবান তস্করেরা বাউলসম্রাট শাহ আব্দুল করিমের গান যতটা চুরি করে গায় তাঁর ন্যূনতম রয়ালটিও যদি এই শিল্পী বা তাঁর উত্তরাধিকাররা পেতেন তাদের অর্থনৈতিক দুঃখ থাকত না। যদিও অন্তরে চিরায়ত দাস্যভাব জিইয়ে রাখা বাউলমন বৈষয়িক অর্থে মজে না।
সুনামগঞ্জে তাঁকে সংবর্ধনা দেয়া হলো একবার। অনুষ্ঠানের শেষে জানানো হলো, এবারে বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের হাতে তুলে দেওয়া হবে তিন লাখ টাকার সম্মাননা চেক। আব্দুল করিম তখন বয়সের শেষপ্রান্তে। কর্ণ ও মন শতভাগ সেবা দিতে অপারগ। করিম নিজ কানে যা শুনলেন, তাতে তাঁর বিশ্বাস হলো না। পাশে বসা একমাত্র সন্তান জালালকে বললেন, জালাল ইতা কিতা কয়! তিন হাজার টাকা! এ তো অনেক টাকা! এত টাকা দিয়ে আমি কি করতাম!
শাহ করিমকে অবগত করানো হলো, টাকার অংকটা হাজার নয়, লাখ! তড়িতাহতের মতো ঝাঁকুনি দিয়ে শাহ আব্দুল করিম দাঁড়িয়ে গেলেন।
'তিন লাখ? সর্বনাশ, অত টাকা! এগুলো নিয়্যা আমরা কিতা করমু? আমরার টাকার দরকার নাই, মানুষ যে ভালোবাসা দিছে, সেইটাই বড় প্রাপ্তি।' চল চল বাড়ি চল। বলেই তিনি বেরিয়ে বাড়ির পথে হাঁটা দিলেন।'
প্রয়াত শিল্পী কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য বাউল শাহ আবদুল করিমকে একবার জিজ্ঞাসা করেছিলেন:
মানুষ আপনার গান বিকৃত সুরে গায়। আপনার সুর ছাড়া অন্য সুরে গায়। অনেকে আপনার নামটা পর্যন্ত বলে না। এসব দেখতে আপনার খারাপ লাগে না...?
শাহ আবদুল করিম বললেন:
কথা বোঝা গেলেই হইল...
আমার আর কিচ্ছু দরকার নাই...।
বিস্মিত কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য বললেন-
আপনার সৃষ্টি... আপনার গান। মানুষ আপনার সামনে বিকৃত করে গাইবে। আপনি কিছুই মনে করবেন না... এটা কোন কথা... এটার কোন অর্থ আছে...?
শাহ আবদুল করিম বললেন:
তুমি তো গান গাও...
আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দাও তো...
ধর তোমাকে একটা অনুষ্ঠানে ডাকা হলো। হাজার হাজার চেয়ার রাখা আছে কিন্তু গান শুনতে কোন মানুষ আসে নাই। শুধু সামনের সারিতে একটা মানুষ বসে আছে, গাইতে পারবা...?
কালিকাপ্রসাদ কিছুক্ষন ভেবে উত্তর দিলেন, না... পারব না...।
শাহ আবদুল করিম সহাস্যে বললেন:
আমি পারব। কারণ আমার গানটার ভেতর দিয়া আমি একটা আদর্শকে প্রচার করবার চাই। সেইটা একজন মানুষের কাছে হইলেও। সুর না থাকুক... নাম না থাকুক... সেই আদর্শটা থাকলেই হইল। আর কিছু দরকার নাই... সেজন্যই কইলাম শুধু গানের কথা বোঝা গেলেই আমি খুশি...।'
কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য জানতে চাইলেন-
সেই আদর্শটা কি?
শাহ আবদুল করিম মুচকি হেসে বললেন:
'একদিন এই পৃথিবীটা বাউলের হবে।'
এখন নামাজি বা বেনামাজি কে না শুনে শাহ আব্দুল করিমের গান? জীবদ্দশায় একবার ঈদের জামাতে শিল্পী করিম উপস্থিত ছিলেন বলে জনৈক মুসুল্লি তাঁর সাথে এক জামাতে নামাজ পড়তে অনীহা জানালেন। ওই মুসুল্লি ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা শাহ আব্দুল করিমের গান ছেড়ে দেয়ার দাবি তুললেন।
ইমাম সাহেবও কট্টরপন্থার স্রোতে গা ভাসালেন:
: গান ছাড়বা করিম?
শাহ আবদুল করিম প্রথমে নিশ্চুপ! ইমাম সাহেব আবারো একই কথা জিজ্ঞেস করলেন। মুসুল্লিরাও উত্তেজিত হচ্ছেন। এসময় শাহ আবদুল করিমের এক শুভাকাঙ্ক্ষী তাঁকে বললেন, আরে মিয়া আপাতত বলে দাও যে আর গান-বাজনা করব না। পরেরটা পরে দেখা যাবে। আজ ঈদের দিন। গণ্ডগোলটা থামুক।
কিন্তু শাহ আব্দুল করিম সোজা উঠে দাঁড়ালেন। স্পষ্ট করে সেই ঈদের জামাতে বললেন, আমি গান-বাজনা ছাড়া বাঁচতে পারবো না এবং গান-বাজনা ছাড়ব না। এই বলে তিনি সেই ঈদের জামাত ত্যাগ করলেন। একই কারণে তার স্ত্রী সরলা খাতুনের জানাজা পড়াতে রাজি হয়নি গ্রামবাসী ও গ্রামের মসজিদের সেই ইমাম।
বুকভরা এই কষ্ট আমৃত্যু তাঁকে বয়ে বেড়াতে হয়েছে।
অথচ শাহ আব্দুল করিমের জানাজায় ছিল হাজারো মানুষের উপস্থিতি। আজ পুরো বাঙালির অন্তরে জায়গা নিয়েছে সাধক আব্দুল করিমের দর্শন, মুখে মুখে ফিরছে তাঁর গান। দেশ নয় শুধু বিশ্বজুড়েই চর্চিত এখন আমাদের করিম।
লালন ফকির, হাছন রাজা, রাধারমণ, দূরবীন শাহ, উকিল মুন্সী, আরকুম শাহ, শিতালং শাহ এর যোগ্য উত্তরসূরী উজানধলের মাটির মানুষ শাহ আব্দুল করিমের সদিচ্ছা সার্থক হোক। পৃথিবীটা বাউল মানুষের মতো সত্য, সুন্দর ও সাদাসিধে হোক। জয়গুরু।
প্রয়াণ দিবসে অতল শ্রদ্ধা
প্রিয় শিল্পী শাহ আব্দুল করিম।
আপনার গান আমাদের প্রাণ।
কেনে পিরিতি বাড়াইলা রে বন্ধু,
ছাইড়া যাইবাই যদি...
লেখক: সাংবাদিক
১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪