Posts

গল্প

সাক্ষাৎকার

September 13, 2024

তৌকির আজাদ

74
View

বিখ্যাত কথা সাহিত্যিক আব্দুল মনসুর সাহেবের একান্ত সাক্ষাৎকার নিতে আমি তাঁর ইস্কাটনের বাড়িতে পৌঁছেছি। 

এটা বাড়ি ঠিকই কিন্তু নিজের বাড়ি না। এযুগে শহরে নিজের বাড়ি আর কয়জনের হয়! আমার বলা উচিত আমি লেখকের ফ্ল্যাটে এসেছি। আধুনিক ড্রয়িংরুমে বসে আছি। 

আমার সাথে আমার বন্ধু আলোকচিত্রকার সাখাওয়াত এমনিতেই কম কথার আর বেশি কাজের মানুষ সে নিজের যন্ত্রপাতি সেট করতে ব্যস্ত। 

আমি দেয়ালের অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্টের ভিজ্যুয়াল ভাষা দেখে দৃশ্যমান পৃথিবীর ভিন্ন স্বতন্ত্রতা বোঝার চেষ্টা করছি। বেশি কিছু বুঝতে পারছি না। শিল্পী বিশাল সাদা ক্যানভাসের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন রং ঢেলে দিয়েছেন মনে হচ্ছে। কিন্তু কাজটা এমন ভাবে করেছেন একেকবার দেখে মনে হচ্ছে কোনো অল্প বয়সের যুবতী চেয়ে আছে ঠিক তখনই লজিক বলছে এটা ছড়ানো-ছিটানো রং ছাড়া কিছুই না। 

তবে সে যাইহোক, দেখতে বেশ ভালো লাগছে। 

ঘরের একপাশে বুকশেলফের দিকে তাকিয়ে দেখলাম আহমদ ছফা রচনাবলি সাজানো সাথে বিভিন্ন বিদেশি লেখকের বইও রয়েছে। সেলফে বইয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন শোপিস সাজানো। 

একবার ভাবলাম উঠে গিয়ে অন্য বইগুলো দেখি, যা ভাবা তাই কাজ - আমি উঠে দাঁড়াতেই একটা ১২/১৩ বছরের ছেলে এসে উপস্থিত। 

রাজপুত্রের মতো চেহারা সম্ভবত মন্সুর সাহেবের ছেলে। সে সালাম দিয়ে বলল, আঙ্কেল, আপনারা ভেতরে আসুন বাবা বারান্দায় অপেক্ষা করছে।

আমি হেসে জিজ্ঞেস করলাম বাবু কি নাম তোমার? সে বলল, আমি ঐক্য। 

বাহ! চমৎকার তো, আচ্ছা ঐক্য, তোমার কি অনেক বন্ধু? 

ঐক্য বলল, যদি সবাই কে অনেক বলা সম্ভব হয় তবে সবাই আমার বন্ধু। 

উত্তর শুনে আমার বেশ ভালো লাগলো। সে আবার বলল চলুন বাবা অপেক্ষা করতে পছন্দ করেন না।

বারান্দায় এসে দেখলাম মনসুর সাহেব চা বা কফি খাচ্ছেন আমাদের জন্যও নাস্তার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। 

আমাদের দেখে আব্দুল মনসুর সাহেব কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বললেন, ‘ বসুন বসুন, সাংবাদিকদের তো আমি ভয় পাই, শুনেছি সাংবাদিক নাকি সাংঘাতিক’। 

আমি বললাম, ‘কি যে বলেন স্যার, আমরা তো ...’ 

তিনি আমাদের কিছু বলতে না দিয়ে আবারো বললেন, ‘আপনারা জাতির জন্যে মূল্যবান কাজটা করেন সেটা হচ্ছে আমাদের কাছে সব রকম তথ্য পৌঁছে দেন, কিন্তু বুঝলেন জনগণ প্রায়ই ভেজাল তথ্য পেয়ে যে বিভ্রান্ত হচ্ছে না, আপনারা সে দাবি কি করতে পারবেন? 

তিনি আরো বললেন, আমাদের এসব বিষয়ে আরো সচেতন হতে হবে। পৃথিবীতে যুগে যুগে অনেক তথ্য যুদ্ধ চলেছে এখনো চলছে। 

আমাদের দেশের বিদ্যমান কাঠামো বা সিস্টেমের পরিবর্তন যেমন জরুরি ঠিক সেভাবেই আমাদের তথ্য সম্পদ আমাদেরই রক্ষা করতে হবে।

তবে আজ এসব কথা থাক। 

রফিক সাহেব আমরা আমাদের কাজটা করি’। 

আমি বললাম, ‘জি স্যার, অবশ্যই’। 

আমি সাখাও্য়াতের দিকে তাকালাম, দেখলাম সে সব রেডি করে অপেক্ষা করছে।

আমি প্রথম প্রশ্ন করলাম, ‘স্যার আপনি লেখা শুরু করলেন কেনো বা আপনার লেখার পেছনে লেখনীর প্রেরণা হিসেবে কি কাজ করেছে’?

‘ দেখুন, লেখালেখি করার একটা তাড়নার ব্যাপার তো আছেই, সে তাড়নাই মূলত প্রেরণা জাগিয়েছে। আমি মূলত না পারতে লিখি। 

আর তাছাড়া আমার বলার কথা অনেক কিন্তু শোনার মানুষ আর কই বলুন, এক জীবনে আমরা কি আমাদের সব কথা বলে শেষ করতে পারি? 

কত কথাই তো না বলা হয়ে থাকে। আবার এ কথাও ঠিক সব কথা বলাটাও সমস্যা। 

আমি যে কথা গুলো বলতে চাই সেগুলো প্রাথমিকভাবে আমি আমার সৃষ্ট বা আমার দেখা সমাজজীবনে ঘটতে থাকা জীবন বা মনুষ্য জীবন অর্থাৎ যাপিত মুহূর্তে গুলির যেই বিস্ময়কর বৈশিষ্ট্যময় বৈচিত্র্য থেকে থাকে সেখান থেকেই আমি জীবন দেখতে থাকি আর এভাবেই আমার কল্পিত চরিত্র করি এবং প্রতিটি চরিত্রে, নিজেকে উপস্থিত করার মধ্য দিয়ে আমার কথা গুলি বলার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা মাত্র।

আর, সেসব বকবকানি পড়ে পাঠক যদি আনন্দ পেয়ে থেকে আনন্দিত আমি লিখে আনন্দ পাই। 

আমাদের জীবনে আনন্দটাই মূল চাবিকাঠি। 

আমরা আমাদের জীবনযাত্রায় নানা কাজের ছলে ক্রমাগত আনন্দ থেকে যেন বঞ্চিত না হই সেটা আমাদের লক্ষ রাখতে হবে’।

দ্বিতীয় প্রশ্ন,

আপনার এ পর্যন্ত, মোমবাতি, পেন্সিল, স্মৃতি স্বপ্ন, কে , দিগন্ত , ছায়াদের পথ ধরে এই ছয়টা উপন্যাস লিখেছেন। 

তবে, এগুলোর মধ্যে ‘ছায়াদের পথ ধরে’ আপনার সব থেকে আলোচিত উপন্যাস। ছায়াদের পথ ধারে এই উপন্যাসের সাথে অন্যগুলোর পার্থক্য কোথায় বা পাঠক মহলে এটা পছন্দের কারণ হিসেবে আপনি কোন বিশেষত্বের কথা বলবেন ?

দেখেন, ‘ মানুষ অনুকরণ প্রিয় বা বলতে পারেন আমাদের মস্তিষ্ক অনুকরণ করে শিখতে পছন্দ করে। আমার ছায়াদের পথ ধরে উপন্যাসের চরিত্রগুলোর মধ্যে পাঠক সম্ভবত নিজের ছায়ার মিল খুঁজে পেয়েছেন বা এখনো পাচ্ছেন। 

আমার মনে হয় সেটাই সম্ভবত প্রধান কারণ’।

চরিত্রের কথা যখন বলছেন আমার প্রশ্ন আপনি আপনার চরিত্র নির্মাণ কি করে করেন বা চরিত্র নির্মাণের সময় কোন কোন বিষয়ের দিকে বেশি খেয়াল করতে হয়?

‘আমি মূলত চরিত্র খুঁজে পাই পোস্টার থেকে। তবে বেশির ভাগ সময় জীবন থেকে। আমরা শুধু মুখ দিয়ে কথা বলি না।

আমাদের শরীর কথা বলে, আমাদের পোশাক কথা বলে, আমাদের হাসি কান্না রাগ ইত্যাদি বিবিধ বিষয় কথা বলে, সব থেকে বেশি কথা বলে আমাদের চোখ। 

আমি মানুষ দেখে নিজ কল্পনায় মানুষের চরিত্র কেমন সেটা ভেবে বা ভাবনার খেয়ালে চরিত্র আঁকি বা তৈরি করি। 

আমরা নিজেদের চোখে যেভাবে করে আমাদের চারিপাশ কে দেখি ঠিক একই ভাবে অন্য কেউ কি করে তার নিজ পৃথিবীকে দেখছে সেটা অন্যের চোখে দেখার চেষ্টা করি’।

তৃতীয় প্রশ্ন,

বর্তমান প্রজন্মের কথা কি বলবেন? প্রযুক্তি যেই গতিতে উন্নত হচ্ছে তাতে আমাদের কাগজের বই থেকে ডিজিটাল মাধ্যমে বই পড়তে বেশি উৎসাহী - এ ব্যাপারে আপনার মতামত কি?

‘ এখানে আমাদের মনে রাখতে হবে নতুন প্রজন্ম আমাদের কাছে সবসময় নতুনত্ব পাওয়ার দাবিদার। আমাদের অতীত প্রজন্ম আমাদের জন্য সভ্যতা যেটুকু এগিয়ে দিয়ে গেছে আমরা সেখান থেকে আরো সামনের দিকে অগ্রসর করতে বা করার তাগিদে আমাদের জ্ঞান বুদ্ধি বা সেটার বিশ্লেষণ দিয়ে আরো একটু এগিয়ে দিয়েছি এখনো দিচ্ছি ঠিক একই ভাবে এই প্রজন্ম নবীনরা আরো নবীনদের এগিয়ে দিবেন এটাই উচিত। 

মনে রাখা দরকার এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া, একই সাথে অনেক গুলো প্রজন্ম এক সাথে এগুচ্ছে। আর প্রযুক্তির ক্রমবিকাশ তো খুবই ভাল বিষয়। 

আমি মনে করি লোকে বই কাগজে পড়ুক বা ডিজিটাল মাধ্যমে, বই পড়লেই হবে – মানুষ হতে হলে বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই’।

আচ্ছা, আপনি এ দেশীয় কার কার লেখা পড়েন ? বা কার লেখা ভাল লাগে ?

‘আসলে আমি সব লেখকের লেখা কম বেশি পড়ি। ঠিক আলাদা করে কারো লেখার কথা উল্লেখ করা অনুচিত বলে মনে করি। সব লেখকেরই আলাদা আলাদা নিজস্ব ধরণ রয়েছে আমি সেটা বোঝার চেষ্টা করি। আমরা যারা সচেতন পাঠক, আমরা সবাই লেখার ভেতরে লেখক কে খোঁজার একপ্রকার প্রবণতা অনুভব করি সেটা যেই হোক না কেন। এ ব্যাপারে এর বেশি বলতে চাই না’।

সেটা ঠিক, তো, কলকাতার লেখকদের ও তাঁদের লেখা নিয়ে আপনার ভাবনা কি?

‘ এটা কঠিন প্রশ্ন। ভাষার সাথে আঞ্চলিকতার বা অঞ্চল ভিত্তিক একটা বিষয় আপনি নিশ্চয়ই লক্ষ করে থাকবেন। 

এটাকে ভাষার জাদু বলতে পারেন।

আমরা যেভাবে কথা বলি আমাদের মস্তিষ্ক. আমাদের মন. আমাদের দেহ. আমাদের চিন্তা. এই সবকিছুই কথার সাথে জড়িত।

স্থানভেদে ভাষা চয়নের এই পরিবর্তন আপনি খেয়াল করতে পারবেন। আমি এতো অল্প সময়ে এই বিশদ ব্যাখ্যা করে হয়ত বুঝাতে পারছি না। 

তবে, কলকাতার লেখা এবং লেখক দুইই ভালো। 

তাঁরা, তাঁদের সমাজ এবং সময় কে যথেষ্ট ভাল ভাবে তুলে ধরেছে। আমার মতে, ভাষার ব্যবহারের দিক থেকে কলকাতা যদি যুক্তরাজ্য হয় আমাদের বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র’।

পরবর্তী প্রশ্ন, সাহিত্য আমাদের সমাজ কাঠামোকে কেমন প্রভাবিত করছে? আপনার কি মনে হয় সমাজ চেতনায় শিল্প-সাহিত্যের অবস্থান কেমন?

‘ এটা খুবই ভাল প্রশ্ন। সাহিত্য আমাদের সমাজ কাঠামোর এক শ্রেণিকে প্রভাবিত করছে। 

কিন্তু, সেই নির্দিষ্ট শ্রেণি, যাদের কাজই হচ্ছে সমাজ গঠন এবং সমাজ কাঠামোকে সেভাবে প্রভাবিত করতে পারছে না বা করতে দেয়া হচ্ছে না। 

বই তো অনেক রকম আছে কিন্তু একটা ভাল বই কীভাবে চিনবেন সে জন্য আমাদের - 'আমাদের'কে গাইড করবে কে!  

আজকাল যোগাযোগ মাধ্যম গুলোতে অনেক সুবিধার পেছনে যেই অসুবিধা গুলো রয়েছে সেটা হচ্ছে আমাদের প্রতিক্রিয়াশীল সমাজ ব্যবস্থা এবং এই প্রতিক্রিয়াশীলতা যেমন আমাদের অধিকার ঠিক এর অপব্যবহার রোধে আমাদের আরো ভাল করে সচেতন হতে হবে এবং একই সাথে নির্ভরযোগ্য সোর্স বা উৎস সামগ্রিক জনগোষ্ঠীর জন্য সহজ করতে হবে। 

মূলত আমরা একটা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি এবং এই পরিবর্তনের শেষ নেই তবে একটা সীমারেখা আছে সেখানে পৌঁছাতে আরো কিছু সময় দরকার। 

আমাদের সমাজ চেতনায় যে মানবিক বোধ উদয় হতে হবে সে জন্য শিল্প-সাহিত্যের বিপ্লব দরকার। 

জাতিসংঘের একটা সমীকরণে উল্লেখ করা 

আছে দেশের প্রতি অর্থবছরে শিক্ষা খেতে ৬% বাজেট বরাদ্দ করতে হয় সেখানে আমাদের দেশে এই খেতে ২% বেশি বরাদ্দ হচ্ছে না। 

একটা পুরোনো কথা বলা উচিত কিন্তু কথাটা আসলে সব সময়ের জন্যই নতুন – শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড আর জাতিকে মাথা তুলে দাঁড়াতে হলে শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নের কোন বিকল্প নেই এবং একই সাথে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে’।

আমার পরবর্তী প্রশ্ন, নতুনরা যারা লিখছে বা ইচ্ছা আছে লেখার তাদের প্রতি আপনার কোন সাজেশন?

‘হ্যাঁ অবশ্যই। ইদানীং অনেক নতুন লেখক নাম করছেন। অতীতের তুলনায় এখন অনেক সুযোগ রয়েছে। ইন্টারনেট নামক বস্তু আমাদের জ্ঞান অর্জনের পরিধিকে ব্যাপক করেছে। 

চাইলেই জানা সম্ভব। তাই চাইতে জানতে হবে। কি করে শিখতে হয় সেটা শিখতে হবে। 

তবে, লেখার ক্ষেত্রে দেখতে জানতে হবে। আমাদের জীবনটাই আসল চলমান গল্প আর জীবন থেকে লেখার রসদ তৈরি করে নিতে হবে’।

শেষ প্রশ্ন, আপনার নিজের আর আপনার লেখা নিয়ে ভবিষ্যৎ ভাবনা কি ? 

‘আমি আমার কথা গুলো লিখে রেখে যেতে চাই। আমি না থাকলেও আমার চিন্তা আমার চেতনা কাগজের পাতায় কম্পিউটার পর্দায় টিকে থাকুক সেটা আমি চাই। পাঠকের মনে এক বিন্ধু জায়গা করে নিতে পারাটাই আমার জীবনের অন্যতম সাফল্য বলে আমি মনে করি। 

আমি লিখছি, আরো লিখব, যতক্ষণ সম্ভব হবে ততক্ষণ লিখতে থাকবো। এইতো’।

সাক্ষাৎকার শেষে আমরা আব্দুল মনসুর সাহেবের বাসা থেকে বেরুলাম। গন্তব্য পত্রিকা অফিস।

একজন লেখকের জীবনের গল্প বা গল্পের জীবন কখনোই লিখে শেষ করা সম্ভব না। জীবন এক সময় থমকে যাবে তারপর হয়ত অন্য কোন অদেখা জীবন থাকলেও থেকে থাকতে পারে কিন্তু, গল্পের জীবন যতদিন মানুষ আছে ঠিক ততদিন পর্যন্ত থাকছে। 

এটাই সত্য ~ একগুচ্ছ কমল আলো।

Comments

    Please login to post comment. Login