কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে আমি আমার কন্যাদের নিয়ে যাওয়া এখন আর নিরাপদ বোধ করব না। ছাত্র-জনতার কাছে পুলিশ রিজেক্টেড হয়ে পড়ায় এখন মোরাল পুলিশিং এর দায়িত্ব পালনের অভিযোগ উঠছে ছাত্র শিবিরের ছেলেদের বিরুদ্ধে। শর্ট ড্রেস পরায় জনৈক এক নারীকে সৈকতে যেভাবে জনসমক্ষে কয়েকডজন ভিডিও ক্যামেরার সামনে কান ধরে উঠবস করানো হলো, কেউ কেউ লাঠি দিয়ে পেটাতে আসল, কেউবা 'কান ধর *গী' বলে মনের উদগ্র অবদমন মেটালো; তাতে ওই সৈকত ভ্রমণের রুচি মরে গেল। ওই বিচে আমি যদি আমার দুই কন্যার হাত ধরে হাঁটি, আমার স্ত্রী হাতে হাত রাখি; নিশ্চিত অশালীন মন্তব্যের শিকার হতে হবে। কন্যাদের কাছে বিব্রত হতে হবে। ওরাও ভয় পাবে। এই যে আপনাদের দেখে আমরা ভয় পাচ্ছি -এটা দিয়ে আপনাদের আসলে কী অর্জন হবে?
আপনাদের ভিডিওগুলো ইতোমধ্যে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছে। ফার্স্ট ওয়ার্ল্ডের কোনো নারী আর কেন আসবে আপনাদের বিচ দেখতে? একদিকে তাদের গায়ের রঙে আপনারা সিডিউসড হয়ে পড়বেন। অন্যদিকে তাদের নিজস্ব ঢঙের পোশাক দেখেই আপনারা হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলবেন। বিশ্বের সবচেয়ে বড় মুসলিম কান্ট্রি ইন্দোনেশিয়ার নাম শুনেননি আপনারা? ইউটিউবে দেখে নিয়ে মানুষের সাথে ম্যানারিজমটা শিখে নিন। জেনে নিন আমাদের মুসলিমদের ফাদার কান্ট্রি সৌদি আরবের প্রাইম মিনিস্টার মুহাম্মদ বিন সালমানের হাজার কোটি ডলারে বানানো নিঅম সিটির সমুদ্র সৈকত কেমন হচ্ছে!
৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর জামায়াতের আমির ডাঃ শফিকুর রহমানের বিভিন্ন ফোরামে দেয়া বক্তব্যে হিপনোটাইজ হয়ে পড়েছিলাম। এখনো আমাদের ঘোর কাটেনি। মানুষ এত সুন্দর করে কথা বলতে পারেন কিভাবে? এতটা উদার ও ক্ষমাশীল হওয়া যায়? জানি না এমন পরহেজগার আমির এতগুলো তরুণের দ্বারা একজন নারীর এমন অপমান কী চোখে দেখবেন? মানুষ ভুল করলে তার ব্যাপারে আইনে প্রতিকার চাওয়ার বহু পন্থা আছে। মব জাস্টিস মানবাধিকার রক্ষা ও সভ্যতাকে এগিয়ে নেয়ার বড় প্রতিবন্ধকতা।
বুঝে নিয়েছি আপনারা হয়ত দিয়ে নারীর অসম্মানকে জাস্টিফিকেশন দিতে ধর্মকে জুজু মানছেন। কথা দিচ্ছি আপনারা ক্ষমতায় যান, সংবিধান বাতিল করেন, গণতন্ত্র তাড়িয়ে দেন; আপনাদের মোরাল পুলিশিং মেনে নিতে বাধ্য থাকব। তার আগ পর্যন্ত সর্বমানুষের স্বাধীন চলাচলে আপনাদের উদারনৈতিক সমর্থন ও সংহতি দাবি করছি। এখনো বিশ্বাস করি দেশে আপনারাই সবচেয়ে গোছানো ও সংঘবদ্ধ দল। হীন কাজ করে কেন খামোখা বদনাম কুড়াবেন?
আমাদের উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠতম মহাকাব্য রামায়ণ। শক্তিধর মহারাজ রাবণ ধ্বংস হয়েছিলেন সীতা অপহরণের কারণে। অপরদিকে মহাভারতে বর্ণিত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কৌরবদের পরাজয়ের অন্যতম বড় কারণ দ্র্রৌপদীর বস্ত্র হরণ। যা না ঘটলে হয়তো এতটা ক্রোধ বা জেদ দেখাতো না পান্ডবরা।
ইসলামের ইতিহাসেও আমরা দেখি নারীর অপমান মানেই পরাজয় ডেকে আনা।
নারীর সম্ভ্রম রক্ষায় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার ইতিহাস পাওয়া যায় ইসলামিক হিস্টরিতে। যে যুদ্ধটি সংঘটিত হয়েছিল ‘বনু কাইনুকা’ নামের একটি গোত্রের সঙ্গে।
আবু আওন থেকে ইবনে হিশাম বর্ণনা করেছেন, একদিন জনৈকা মুসলিম নারী বনুু কাইনুকা গোত্রের বাজারে দুধ বিক্রি করে বিশেষ কোনো প্রয়োজনে এক ইহুদি স্বর্ণকারের কাছে গিয়ে বসে পড়েন। কয়েকজন দুর্বৃত্ত ইহুদি তাঁর মুখের নেকাব খোলানোর অপচেষ্টা করে, তাতে ওই নারী অস্বীকৃতি জানান। ওই স্বর্ণকার গোপনে মুসলিম নারীটির (অগোচরে) পরিহিত বস্ত্রের এক প্রান্ত তার পিঠের ওপরে গিঁট দিয়ে দেয়, তিনি তা বুঝতেই পারলেন না। ফলে তিনি উঠতে গিয়ে বিবস্ত্র হয়ে পড়েন। এ ভদ্র মহিলাকে বিবস্ত্র অবস্থায় প্রত্যক্ষ করে স্বর্ণকার ও তার সতীর্থরা হো হো করে হেসে উঠে হাততালি দিতে থাকে। মহিলাটি ক্ষোভে ও লজ্জায় মৃতপ্রায় হয়ে আর্তনাদ করতে লাগলেন।
পরবর্তীতে এই ঘটনার রেশ ধরে শুরু হওয়া যুদ্ধে ওই স্বর্ণকারের বংশ 'বনু কাইনুকা' রাসূল (সা.) এর নেতৃত্বে থাকা মুসলিমদের হাতে শোচনীয় পরাজয় হয়।
এইজন্যই আমরা বলি মায়েরা জিতলে জয়ী হয় মানুষ। নারীর অপমান মানে সভ্যতার অভিশাপ। পুরাণকথা বা ধর্মীয় ইতিহাস এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নাই। আমরা যতটুকু করব তার ফল ভোগ করতে হবে এটাই চিরায়ত সত্য। আমরা সবাই যেন বিষয়টা খেয়াল রাখি।
লেখকঃ সাংবাদিক
১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪