শব্দগত অর্থে ‘সুশাসন’ মানে ভাল বা উত্তম শাসন। সুশাসন একটি বিমূর্ত ব্যাপক ধারনা। ইহা কতকগুলো গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য মণ্ডিত। ইহা শাসক ও শাসিতের সম্পৃক্ততায় ধন্য। এ প্রজাবৎসল সরকারের মঙ্গলকর, কল্যাণপ্রদায়ী এক শাসন ব্যবস্থা, যা দেশকল্যাণ ও প্রজা হিতৈষণায় উদ্বোধিত ও উৎসর্গিত। দেশের উন্নতি, প্রগতি, সর্ব প্রকার সমৃদ্ধ ও সুন্দর জীবনের লালন-পালন ও বিকাশের জন্য সুশাসন একান্ত প্রয়োজন। সবার দুয়ারে সুখি ও আনন্দ মুখর জীবন উপহারের জন্য সুশাসনের বিকল্প নেই।
এখানে শাসক ও শাসিতের সম্পর্ক বর্তমান নয়---বন্ধুর সম্পর্ক বিদ্যমান। এক্ষনে শাসক-শাসিতের মধ্যে গতিশীল, শান্তিময়, অর্থপূর্ণ ও মর্যাদাবান সুষম ও ভারসাম্য পূর্ণ এমন এক অবস্থা বিদ্যমান যা অধিকার ও দায়িত্বের বলয়ে আবর্তিত। উভয়ের আশার আলোর মিছিল এক জায়গা থেকে উৎপত্তি এবং উৎসারিত হয়ে একই অভিমুখে শুভ গতিময় ও গতি স্বচ্ছন্দ হয়। দুয়ের স্বপ্নের শতদল এক জায়গা থেকে পাখা মেলে। উভয়ের চিন্তা চেতনা, মনন ও প্রচেষ্টা একই উৎসমুল থেকে, একই মঙ্গল আকাংখায় গতি চঞ্চলও বিচিত্র ধারার দুগ্ধ স্রোতস্বিনী রুপে প্রবাহিত হয়। অবিশ্যি শাসকের দিগন্ত বিস্তৃত, বহুব্যাপি উর্বর চিন্তাচেতনা ও হিতৈষণা আরও উৎকর্ষ পরিক্রমার বহু মাত্রিকতায় পরিক্রমণ করে।
সরকারের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও দায়িত্ব বোধ দ্বারা পরিচালিত শাসন ক্রিয়া পরিচালনাই অনেকাংশে সুশাসন। তাই সুশাসনের বৈশিষ্ট্য হিসেবে লক্ষ করা যায়--- সরকারের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক মুল্যবোধে উদ্বোধিত শাসন ব্যবস্থা, জনগণের কাছে গ্রহণ যোগ্যতা, স্বাধীন প্রচার মাধ্যম ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, অবাধ তথ্য প্রবাহ, ফ্রি ও ফেয়ার (Free and Fair) সকলের বা সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহনের ইলেকশন, আইনের শাসন, দক্ষ ও স্বাধীন বিচারবিভাগ, দক্ষ ও শক্তিশালী বিরোধী দল, জনবান্ধব, জনজীবন ঘনিষ্ট, কল্যাণমূলক ও আমলাতান্ত্রিক এবং অন্যান্য প্রভাবমুক্ত প্রশাসন, সৎ ও যোগ্য পুলিশপ্রশাসন, স্থিতিশীল রাজনৈতিক অবস্থা, দুর্নীতির মূলোৎপাটন, সুষম অর্থ ব্যবস্থা, সমতা, যোগ্য, পুষ্টিকর, সুশৃখল ও বৈষম্যহীন শিক্ষা ব্যবস্থা, আইনের শাসন,সংবিধানের অনুসৃতি ও প্রাধান্য, বিবিধ। উল্লেখ্য, রাজনৈতিক দল সমূহের মধ্যে সুস্থ গণতান্ত্রিক চর্চা থাকতে হবে। দলের ভেতরে সমালোচনার সাহস ও পরমত সহনশীলতা থাকতে হবে। যে দলের মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চা নেই, সে দল ক্ষমতায় গেলেও দেশবাসীকে গণতন্ত্রের প্রসাদ ক্ষীর পাইয়ে দিতে পারবে না। মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে সকলের প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। সকল ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ও পক্ষপাতমূলক বিবেচনা পরিত্যাজ্য। সাম্প্রদায়িক সমপ্রীতি বজায় থাকবে। রাষ্ট্র কোন বিশেষ ধর্মের পৃষ্ঠপোষক হবে না। জনগন সচেতন ও শ্রমনিষ্ঠ হবে। শাসক দেশপ্রেমিক হবেন।
এত ক্ষুদ্র লেখায় সকল পয়েন্টের বিস্তৃত আলোচনা সম্ভব নয়। তবুও কিছুটা আলোচনা করতে প্রয়াসী হবো। হতে পারে তা কিছুটা দ্বিরুক্ত। শাসন ব্যবস্থার মুল কেন্দ্র বিন্দুতে অবস্থান করে জনগণ। তাই তাদের কল্যাণই অগ্রগণ্য। জনগণের মৌলিক ও মানবাধিকার সংরক্ষণ ও পূরণ নিশিত করতে হবে। দক্ষ ও শক্তিশালী দুর্নীতি কমিশন, স্বচ্ছতা, দৃঢ়তা এবং সততার সাথে ভুমিকা পালনের মাধ্যমে সকল স্তর থেকে দুর্নীতি, ঘুষ বা উৎকোচ তিরোঁহিত করবে। বিচার বিভাগ শাসন বিভাগ থেকে স্বতন্ত্র ও স্বাধীন ভাবে নিরপেক্ষ ভুমিকা পালন করবে। আইনজীবীরা যথাযত ভুমিকা পালন করবেন। বিচারের বানী নিভৃতে না কেঁদে প্রসন্ন ও সন্তুষ্টির হাঁসি হাসবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে বিচার বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগসমূহ ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তায় বলিষ্ঠ, প্রত্যয়ী ও ন্যায়নিষ্ঠ কর্ম সম্পাদন করবে। জনপ্রতিনিধিত্বমূলক আইন জনকল্যাণে বাস্তবায়িত, কার্যকর হবে ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন চরিতার্থ হবে। মেরুদণ্ড, বিবেকের অনুশাসনে শাসিত কর্ম তৎপর মানুষ তৈয়ার করতে হবে। স্বার্থপর, পদলেহী, তোষামত প্রিয়, ভীরু কাপুরুষ দ্বারা সুশাসন সম্ভব নয়।
প্রাথমিক শিক্ষা থেকে উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থার স্তর বিন্যাস ভেঙ্গে শিক্ষাকে একই সমতলে আনতে হবে। সর্বজনীন শিক্ষানীতি প্রণয়ন করতে হবে। উন্নত পাঠ্যসুচির মধ্যে উন্নত জাতির প্রতিচ্ছবি পরিদৃষ্ট হয়। তাই উন্নত পাঠ্যসূচি তৈরি আবশ্যক। শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি ও রাজনৈতিক বিবেচনা পরিত্যাজ্য। মেধাই হবে শিক্ষক নিয়োগের মানদণ্ড। বিদ্যাপীঠ কখনও বিদ্যা বিপণীর গ্লানি বহন করবে না। বিদ্যাপীঠ সনদ বিতরণের কারখানা হবে না, মানুষ তৈরির কারখানা হবে। শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড---যেমন সত্য, শিক্ষার মেরুদণ্ড হলেন যোগ্য শিক্ষক তা, তেমনি সত্য। নারীশিক্ষা ও দেশের অনগ্রসর অংশের শিক্ষাকে উৎসাহিত করতে হবে। সকল ক্ষেত্রে নারী পুরুষ পরস্পর পরস্পরের প্রতিপক্ষ না হয়ে পরিপূরক হবে। সরকারি, সাংবিধানিক পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধা ও যোগ্যতাই হবে নিয়োগের মানদণ্ড, কোন বিনিময় ও কোন বিশেষ বিবেচনা নয়। সবার সুযোগের সমতা থাকতে হবে। সংসদে ও সংসদের বাইরে দক্ষ ও শক্তিশালী বিরোঁধী দল থাকবে। শুধু বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা নয়--- অর্থবহ, গঠন মূলক আলোচনা সমালোচনার অবতারনা হবে। জাতীয় সাধারন স্বার্থে সকলের ঐকমত্য ও সমপ্রচেষ্টা থাকতে হবে। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যোগ্য, দক্ষ ও মেধাবী রাজনৈতিক নেতৃত্ব সৃষ্টি হবে। সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা বিদ্যমান থাকবে। ক্ষমতাশীল দল ও বিরোধী দলের মধ্যে সৌহার্দ ও সম্প্রতি বিদ্যমান থাকবে। শাসকের চরিত্র কোমলে কঠিনে গঠিত হবে। ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে, দপ্তরে দপ্তরে, প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠানে দেশের কল্যাণ, উন্নয়ন ও প্রগতির লক্ষে শুভ প্রতিযোগিতার মনোভাব নিয়ে সবাই মঙ্গলময় ভুমিকায় অবতীর্ণ হবে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারসাম্যপূর্ণ ও প্রশংসনীয় ভুমিকা পালনের মধ্য দিয়ে তাদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকবে। বন্ধুসুলভঁ কূটনৈতিক সম্পর্ক ও সুষম ভারসাম্যপূর্ণ, মর্যাদাবান আন্তর্জাতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হবে। আদর্শ ও শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বিদ্যমান থাকবে। সুষ্ঠু, নিরলস ও শক্তিশালী স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র ব্যবস্থা ক্রিয়াশীল থাকবে। সুষ্ঠু ভুমি ব্যবস্থা কার্যকর থাকবে। প্রত্যেকেই যার যার অবস্থান থেকে দায়িত্বশীল ভুমিকা পালন করবে। শাসক বা শাসকশ্রেণী দেশের প্রচলিত ধর্মসমূহ সম্পর্কে উদার মনোভাব পোষণ করবেন যাতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় থাকে।
আর্থসামাজিক সমস্যার সমাধান করতে হবে। অর্থনৈতিক ও সমস্যার বিশ্লেষণ এবং উহার সর্বোত্তম সমাধান করে দেশের উন্নতি ও প্রগতি ত্বরান্বিত করতে হবে। দারিদ্যে কোন সম্মান নেই। ধন বৈষম্য দূর করতে হবে। ধনী আরও ধনী, গরীব আরও গরীব হবে না। সরকারকে এবিষয়ে সুষ্ঠু নীতি মালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, বেকার সমস্যার চেয়ে বড় শত্রু নেই। দারিদ্র্য অন্যান্য সমস্যার প্রসুতি। দারিদ্রের দুষ্ট চক্ত্র থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সবার মধ্যে আশা ও উদ্যম সৃষ্টি করতে হবে। কৃষি মানে শুধু মাঠে শস্য ফলানো নয়, এর পরিধি ব্যাপক। কৃষি পরিধি ভুক্ত সবকিছুর সার্বিক উন্নয়ন করতে হবে, আধুনিক কৃষিতে আধুনিকতা অবলম্বন করে উৎপাদন বাড়াতে হবে। আমদানি রপ্তানী নীতিমালা সহ সংশ্লিষ্ট সকল কিছু জোরদার করতে হবে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে তৎপর হতে হবে। রাজনীতিসহ অন্যান্য বিষয়ে স্থিতিশীলতা আনতে হবে। আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির সর্বোত্তম ও সর্বোৎকৃষ্ট ব্যবহার ও প্রয়োগ ঘটাতে হবে। জনগণকে জন সম্পদে পরিণত করতে হবে। এবিষয়ে বেসরকারি সংগঠনকে সাগ্রহে এগিয়ে আসতে হবে ও ভুমিকা তৎপর হতে হবে। নূতন উদ্যোক্তা সৃষ্টি করতে হবে। জনবান্ধব ব্যাংক বীমা জন গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিয়োজিত থাকবে। সহজ শর্তে সুলভে ঋণ প্রদান ও কর্মস্থান করতে হবে। সম্পদের সুষম ব্যবহার ও বণ্টন নিশ্চিত করতে হবে। কার্যকর ও ত্বরিত পরিবহন ব্যবস্থা ও যোগাযোগ ব্যবস্থা দ্রুততর করতে হবে। শ্রমের গতিশীলতা বাড়াতে হবে। মালিক শ্রমিকের মধ্যেকার অসন্তোষ দূর করতে হবে। শহর ও গ্রামের বৈষম্য দূর করতে হবে। সরকারকে সাহিত্য- সংস্কৃতি, শিল্প এবং বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে হবে। বই পড়ার মাধ্যমে জাতির মধ্য প্রাণ সঞ্চার করতে হবে। বই পড়া তো মানুষ ছেড়েই দিয়েছে। প্রানান্ত চেষ্টা করে লেখকগণ বিশেষ করে প্রতিভাবান নূতন লেখকেরা বই প্রকাশ করতে পারছেন না। তাঁরা টাকা পাবেন কোথায়? প্রতিভার অপমৃত্য ঘটছে। সুষ্ঠু নীতিমালা প্রণয়ন করে বই প্রকাশের ব্যবস্থা করতে হবে। মেধা ও আত্মিক মৃত্য হলে জাতি বাচবে না। সরকার হল মেধার লালক ও পালক। সরকারকে মেধা ও সৃজনশীলতার অপমৃত্যু রোধ করতে হবে। এতে গোটা বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। দেশের বুদ্ধি, মেধা ও প্রতিভাকে যথা সম্ভব দেশের কাজে ও উন্নয়নে লাগাতে হবে। দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের আবিষ্কার, উত্তোলন ও এর সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। দেশীয় শিল্পের বিকাশ ঘটাতে হবে। জাতীয় আয় ও প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হবে। বিতর্ক, সভা সমিতি, সেমিনার প্রভৃতির আয়োজন করে শাসন কার্যে জনসমর্থন ও জন সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা হল সুশাসনের জন্য শাসক ও শাসিতের ইচ্ছা ও দৃঢ় সংকল্প থাকতে হবে। বৃদ্ধ বৃদ্ধাদের নাভিশ্বাস বন্ধ করতে হবে। পরিবেশের উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের নিশ্চিত করে দক্ষ ও কর্মঠ জাতি গঠন করতে হবে। দেশে শান্তি ও সর্বপ্রকার স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হবে। দেশ থেকে সন্ত্রাস নির্মূল করতে হবে। সমস্ত কুসস্কার, অজ্ঞতা ও অন্ধ বিশাসের মুলে কুঠারাঘাত করতে হবে। দেশের সর্ব-উচ্চ আইন হল দেশের সংবিধান। এর প্রাধান্য স্বীকৃত ও মান্য নিশ্চিত করতে হবে। সংবিধানকে হাসপাতালে ‘নিবিড় পর্যবেক্ষণে’ রেখে সুশাসন প্রতিষ্ঠার আশা দুরাশা মাত্র। শাসক ও প্রজাদের সদিচ্ছা ও ইতিবাচক ভুমিকার মধ্য দিয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। জীবনের গতি চাঞ্চল্য, প্রানবন্ত, সমৃদ্ধ, সুস্থ, উন্নত ও স্বাভাবিক জীবনাচরণের জন্য সুশাসন অপরিহার্য। সবাই মিলে সর্বাত্মক চেষ্টায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সার্বিক উন্নতির জন্য সুশাসনের বিকল্প নেই। সবার নিরলস ও নিঃস্বার্থ প্রচেষ্টায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা হউক।