মা, মাগো আমি ফার্স্ট ডিভিশন পেয়ে পাশ করেছিমা। ছেলের এমন চিৎকার শুনে রান্নাঘর থেকে ছুটে আসলেন মা রেনু বালা। মাকে দেখেই আবেগে আপ্লুত উজ্জ্বল দৌড়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে। ছেলে ও মায়ের আবেগঘন মুহুর্তে চারপাশ কেমন যেন নীরবহয়ে যায়। নীরবতা ভেঙেমা রেনু বালা ছেলেকে ছেড়ে ঘরে যায়। ঘর থেকে বের হয়ে ছেলেরহাতে দুটো নতুন পঞ্চাশ টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে মিষ্টি আনতে বলে। মানুষের কাছে জেনেছে কিছুদিন পরেই মাধ্যমিক পরীক্ষার রেজাল্ট হবে। তাই ছেলে পাশ করবে এই বিশ্বাস রেনু বালার ছিলো বলেই তো দুটো নতুন পঞ্চাশ টাকার নোট রেখে দিয়েছিল মানুষকে মিষ্টি খাওয়াতে হবে বলে।
ছেলেকে মিষ্টি আনতে পাঠিয়ে মা রেনু বালার মনে হতে থাকলো সেইসব দিনের কথা। অল্প বয়সে স্বামী হারানোর বেদনা বুকে চাপা দিয়ে রেনু বালার দিন কেটেছে একমাত্র ছেলেকে নিয়ে। ছেলেকে মানুষ করে বাপের স্বপ্ন পূরণ করতে পারলেই যেন জয়লাভ করবেন রেনু বালা।
গরীব বাবার ঘরে জন্ম নেওয়া উজ্জ্বল ছিলো বাবা মায়ের এক অসামান্য সম্পদ। লেখাপড়া শিখে বড় হয়ে বাবা মায়ের মুখ উজ্জ্বল করবে যে ছেলে তার নামতো উজ্জ্বল হওয়াই উচিৎ। আর এরকম ভাবনা থেকেই ছেলের নাম উজ্জ্বল রাখেন বাবা রতন রায়। শুরু থেকেই ছেলেকে নিয়ে এমন বিশ্বাস ছিলো রতন রেনু দম্পতির।
এলাকার গরীব দিনমজুর রতন মানুষের বাড়িতে কাজ করে যাপায় তা দিয়ে কোনরকম সংসারের খরচ চলে যায়। ছেলের স্কুলে ভর্তির পর থেকেই বাড়তি উপার্জন করতে মাঝেমাঝেই রতন রিকশা চালাতে ঢাকা শহরে যাওয়া শুরু করে। মেধাবী ছেলের পড়াশোনা যেন বাধাগ্রস্ত না হয় সেজন্য কোনো অভাব বুঝতে দিতেন না ছেলেকে। আর তাই এলাকায় কাজ না থাকলেই রতনকে যেতে হতো ঢাকা শহরে রিকশা চালাতে।
উজ্জ্বল তখন তৃতীয় শ্রেণিতেপড়ে। উজ্জ্বলের বাবা রতন ঢাকা শহরে গেছেন রিকশা চালাতে। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস। তিন দিন পরেই রতনকে ফিরে আসতে হয় লাশ হয়ে। সড়ক দূর্ঘটনায় নিহত হন রতন। সেই থেকে ছেলেকে মানুষ করার লড়াইটা একাই চালিয়ে যাচ্ছেন রেনু বালা।
মানুষের বাড়িতে কাজ করে, এর ওর কাছে হাত পেতে ছেলের পড়াশোনার খরচ জুগিয়েছেন রেনু বালা। উজ্জ্বল কতবার মায়ের কষ্ট দেখে পড়াশোনা ছেড়ে কাজ করতে চেয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু মায়ের ধমক আর শিক্ষকদের কথায় প্রতিবারই মায়ের কাছে হেরে যায় উজ্জ্বল। রেনু বালা তাকে বলতেন, তুই শুধু মন দিয়ে পড়াশোনা কর। আর মেধাবী শিক্ষার্থী হিসেবে শিক্ষকদের কাছে উজ্জ্বল ছিলো প্রিয় ছাত্র।
উজ্জ্বল মায়ের কষ্ট লাঘবে বড় চাকরি করবে সেই প্রত্যাশা নিয়ে আরও মনোযোগ দিয়ে পড়তে থাকে। কারণ, স্যার ক্লাসে বলেন বড় চাকরি পেতে হলে বেশি করে পড়তে হবে, ভালো ফলাফল করতে হবে। আর সেজন্যই উজ্জ্বল বেশি বেশি পড়তো যেন মায়ের কষ্ট লাঘবে বড় চাকরি করতে পারে সে।
উজ্জ্বল ঠিক কি রেজাল্ট করেছে সে বিষয়ে ধারণা নেই অশিক্ষিত মা রেনু বালার। তবে ছেলের উচ্ছাস আর প্রতিবেশীদের প্রশংসা দেখে মনে হচ্ছে ছেলে মায়ের মুখ উজ্জ্বল করার মতোই কিছু করেছে। পাড়ার সবাই যখন উজ্জ্বলের প্রশংসা করছে তখন মা হিসেবে রেনু বালার মনে যে সে কি আনন্দ।
এলাকার প্রতিটি মানুষের মুখে এখন কেবল উজ্জ্বলের নাম। স্থানীয় বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক চলে এসেছেন উজ্জ্বলদের বাড়িতে। ভাঙা বাড়িতে প্রধান শিক্ষককে বসতে দেওয়ার মতো অবস্থা নেই। এ নিয়ে রেনু বালার সংকোচ ও লজ্জা দেখে পিড়িতেই বসে পরেন প্রধান শিক্ষক। উনি এসেছেন উজ্জ্বল কীভাবে শহরের কলেজে ভর্তি হবে সে বিষয়ে কথা বলতে। একে তো টাকারঅভাব, তার ওপর ছেলেকে দূরে পাঠিয়ে দেওয়া যেন কিছুতেই রেনু বালা মেনে নিতে পারছেন না। কিন্তু ছেলেকে ভালো কলেজে পড়াতে হবে। তাছাড়া শহরে থেকে পড়াশোনার খরচের ভার বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিচ্ছে। এতো ভালো ফলাফল অজপাড়া গাঁয়ের এই বিদ্যালয় থেকে এর আগে কেউ কখনও করে নি। ২০ বছরের ইতিহাসে প্রথম যে ছেলেটার জন্য বিদ্যালয়ের এতো সুনাম হলো তার পড়াশোনা ভালো কোথাও হোক, আরও বড় জায়গায় বিদ্যালয়ের নাম ছড়িয়ে পড়ুক এতোটুকু চাওয়া থেকেই উজ্জ্বলের পড়াশোনার দায়িত্ব নিতে চায় বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
মানুষের বাড়িতে কাজ করে ছেলেকেএই পর্যন্ত নিয়ে আসা রেনু বালার চোখ খুশিতে চকচক করে উঠলো। ছেলের সুন্দর ভবিষ্যৎ চিন্তা করে শহরের বড়ো কলেজে ভর্তির জন্য পাঠিয়ে দিতে রাজী হলো। তাছাড়া উজ্জ্বল নিজেও স্বপ্ন দেখতো এসএসসি পাশ করে সে শহরের নামকরা ভালো কলেজে পড়বে। রেনু বালা শুধু বলেছিলেন মাকে যেন মাঝেমাঝেচিঠি লিখে জানায় সে কেমন আছে।
গ্রাম থেকে বিদায় নিয়ে উজ্জ্বল শহরে চলে যায়। দিনাজপুর সরকারি কলেজের আবাসিক হলে থাকার ব্যবস্থা হয়ে যায় তার। হলে উঠে উজ্জ্বল প্রথমে স্বাভাবিক হতে না পারলেও ধীরে ধীরে অভ্যস্থ হয়ে যায়। কীভাবে যেন রাজনৈতিক ছেলেদের কাছে ছাড় পেয়ে যায় উজ্জ্বল। অন্যরা যেখানে হলে থাকতে রাজনৈতিক বড় ভাইদের খুশি করতে ব্যস্ত, সেখানে সেই ভাইয়েরাই কেন যেন উজ্জ্বলকে স্নেহ করতেন ছোট ভাইয়ের মতো।
উজ্জ্বল মায়ের কাছে মাঝেমাঝেই চিঠি পাঠায়। চিঠির পাতা জুড়ে থাকে তার পড়াশোনা আর ভালো থাকার গল্প। পাশের বাড়ির ছোটন দাদা মাকে চিঠি পড়ে শোনায়। আবার ছোটন দাদা মায়ের কথাগুলো চিঠিতে লিখে দেয়।
গতকাল মায়ের চিঠি এসেছে। ছয়মাস ধরে বাড়ি যাওয়া হয় না বলে মা অভিমান করেছে। কিন্তু উজ্জ্বল মাকে কীভাবে বোঝাবে যে এখন পড়াশোনার ব্যাপক চাপ। সামনে প্রথম বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা। এখন কোনভাবেই বাড়িতে যাওয়া যাবে না। কিন্তু মাকে সরাসরি না করলেও মায়ের রাগ আর অভিমান দ্বিগুণ হয়ে যাবে। সে ছাড়া আর কেইবা আছে মায়ের? এমনভাবনা থেকেই মাকে চিঠি লিখে উজ্জ্বল। চিঠিতে জানায় সে এ মাসেই সময় করে মায়ের সাথে দেখা করতে আসবে। মা যেন এ নিয়ে একদম দুশ্চিন্তা না করে।
ছেলের এরকম চিঠি পেয়ে খুশিতে ভরে যায় রেনু বালার মন। ছেলে বাড়ি আসবে জেনে ছেলের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। আর ভাবতে থাকে ছেলের পছন্দের খাবারের যোগান কীভাবে দেওয়া যায়।
কলেজ ক্যাম্পাসে কি যেন বিষয়ে ছাত্রসংগঠনগুলো কয়েকদিন ধরেই হট্টগোল করছে। দুদিন ক্লাস বন্ধ রেখেছিল কলেজ কর্তৃপক্ষ। কিন্তু বিভিন্ন ক্লাসের পরীক্ষা আসন্ন। তাই আজকে আবার ক্লাস শুরু হয়েছে। ছাত্রসংগঠনগুলোর হট্টগোলও কমেছে গত দুদিনের তুলনায়।
ক্লাসের প্রথম সারির প্রথম বেঞ্চে বসেছিল উজ্জ্বল। হঠাৎ বাইরে গণ্ডগোলের শব্দ শুনতে পেয়ে শ্রেণি শিক্ষক সবাইকে নিরাপদে যেতে বললেন। যে যার মতো দৌড়ে পালাতে থাকলো। গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে। পরিস্থিতি যেন ভয়ানক হয়ে যাচ্ছে মুহুর্তের মধ্যেই। দৌড়ে পালাতে গিয়ে একটা গুলি এসে লাগে উজ্জ্বলের বুকে। মুহুর্তের মধ্যেই মাটিতে পরে যায় উজ্জ্বলের দেহ। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে ক্যাম্পাসেই।
উজ্জ্বলদের উঠানের ওপর একটা সাদা মাইক্রোবাস। উজ্জ্বল এসেছে শুনে রেনু বালা দৌড়ে ছুটে আসেন। শিক্ষক ও সহপাঠীদের একটা দল গাড়ি থেকে নেমে আসলে উজ্জ্বল কোথায় জানতে চান রেনু বালা। তাছাড়া উজ্জ্বল তো মাসের শেষের দিকে আসতে চেয়েছিল। এখন কেবল ১৫ তারিখ। রেনুবালা সবাইকে বসতে দিতে যখন ভাঙা চেয়ার নিয়ে ছোটাছুটি করছেন তখন গাড়ি থেকে নামানো হয় উজ্জ্বলের লাশ। তাজা রক্ত এখনো লেগে আছে উজ্জ্বলের শার্টে। রেনু বালা ছেলের নিথর দেহ দেখেই অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পরেন মাটিতে। অপমৃত্যু হয় রেনু বালার স্বপ্নের