এক.
“এখন আপনি নেপালের সঙ্গে খেলা হলে নিশ্চিত জিতবেন কি না? বুকটা কিন্তু দুরুদুরু করে ওঠে। কারণ, আপনি নিশ্চিত না নেপালের সঙ্গে জিততে পারব কি না! আমরা নিজেদের দল নিয়ে প্রচুর দ্বিধায় থাকি। দলে সাকিব থাকুক, তামিম, রিয়াদ থাকুক, মুশফিক থাকুক; যে-ই থাকুক না কেন, আমরা খুব শঙ্কায় থাকি। এই পর্যায়ে আমরা নেমে এসেছি।”
কথাগুলো কোনো আমজনতা বা সাধারণ ক্রিকেটপ্রেমী কারোও না। এই কোট করা কথাগুলো দেশের খ্যাতিমান ক্রিকেট বিশ্লেষক নাজমুল আবেদীন ফাহিমের, যিনি গত ২১ আগস্ট বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) পরিচালক মনোনীত হয়েছেন। তাঁর মতো ব্যক্তি যখন এ ধরনের কথা বলেন, তখন এর ওজন থাকে অনেক বেশি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের ক্রিকেট এই পর্যায়ে কেন চলে এলো? উন্নতির বদলে অবনতির গ্রাফ কেন পুরোটা জুড়ে? আবার, নাজমুল আবেদীন ফাহিমের কথায় কেবলমাত্র জাতীয় দলের চিত্র ফুটে ওঠেছে। কিন্তু তৃণমূল ক্রিকেট, ক্রিকেটের পাইপলাইন, সাংগঠনিক চিত্র সব বিবেচনায় নিলে আমাদের ক্রিকেট যেন সঠিক ট্র্যাক থেকে ছিটকে পড়েছে!
দুই.
অভ্যাসগতভাবে বাংলাদেশের মানুষ খেলাধুলার প্রতি আগ্রহী। আর শুধুমাত্র ক্রিকেট বিবেচনায় নিলে আগ্রহ রীতিমতো উন্মাদনায় রূপ নেয়। কিন্তু এই বিপুল সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো যায়নি। আরও স্পষ্ট করে বললে, যারা দায়িত্বে ছিলেন, তারা সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর পথে হাঁটেননি; তারা চেয়েছেন কেবলমাত্র জাতীয় দল দিয়ে শর্টকাট কিছু সাফল্য। ব্যর্থতাকে আড়াল করতে তারা বারবার বোর্ডের অর্থকড়ির বিষয়টিকে সামনে এনেছেন ঢাল হিসেবে। বলেছেন, বিসিবি বিশ্বের অততম ধনী বোর্ড, আমাদের ৯০০ কোটি টাকার এফডিআর আছে, পুঞ্জীভূত তহবিল ছাড়িয়ে গেছে এক হাজার কোটি টাকা, এই-সেই নানা কথা। গত এক যুগে বিসিবির কোষাগার সমৃদ্ধ হয়েছে, এটা সত্য। কিন্তু এজন্য নাজমুল ইসলাম পাপনের নেতৃত্বাধীন বোর্ডকে তেমন কিছুই করতে হয়নি। সিংহভাগ অর্থই এসেছে আইসিসি আর এসিসি থেকে প্রাপ্ত লভ্যাংশ থেকে। আবার অর্থের ঝনঝনানি থাকলেও জাতীয় দলের সাফল্য কোথায়? মিরপুরে ‘স্পিন বধ্যভূমি’ বানিয়ে প্রতিপক্ষকে কয়েকবার ঘায়েল করা ছাড়া বড় সফলতা কোথায়? কিংবা ঘরোয়া ক্রিকেটের উন্নতিই বা কোথায়! কেবলমাত্র জাতীয় দলকে ফোকাসে রাখতে গিয়ে ঘরোয়া ক্রিকেট এখন ছন্নছাড়া। ঘরোয়া ক্রিকেটে মনোযোগ দেওয়ার পরিবর্তে বিসিবি সবচেয়ে বেশি অর্থ খরচ করেছে লজিস্টিকস অ্যান্ড প্রটোকল, বিপিএল আর ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগে। সঙ্গে কথিত ‘হাই প্রোফাইল’ বিদেশি কোচের পেছনে প্রতি মাসে ব্যয় হয়েছে হাজার হাজার ডলার। বিদেশি কোচ নিয়োগে আগ্রহের পেছনে ‘কমিশন বাণিজ্য’ কাজ করে বলে অভিযোগ আছে। তাও যদি সাফল্য আসতো!
ঘরোয়া ক্রিকেটে মনোযোগহীনতায় যা-তা কাণ্ড হয়েছে এখানে। ঢাকা লিগকে তো ছেলেখেলা বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রশ্নবিদ্ধ আম্পায়ারিং, ভোট বাড়াতে কাউন্সিলরশিপের জন্য যেমন তেমন দলকে ওপরে টেনে তোলা, ম্যাচের ফল পাল্টে দেওয়া, মানহীন পিচ, নির্দিষ্ট দলকে বিজয়ী করতে অপর দলের ব্যাটারদের পায়ে বল লাগলেই এলবিডব্লিউ দেওয়া--অনিয়মের যেন শেষ নেই। ঘরোয়া ক্রিকেটের এসব অনিয়মের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করে বিসিবিরই সাবেক সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী লিখেছিলেন, ‘এভাবেই ধ্বংস হচ্ছে আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেট’। এটা ২০১৯ সালের ঘটনা। এরপরও কিন্তু ঘরোয়া ক্রিকেটকে বাঁচাতে তৎপরতা দেখা যায়নি পাপন গংদের। জাতীয় দলের পাইপলাইনে সংকট। ভালো মানের ক্রিকেটার তৈরি হচ্ছেন না। এক তামিম ইকবাল না খেলায় জাতীয় দলের ওপেনিং নিয়ে ভজঘট অবস্থা দেখা দেয়! পাইপলাইন যে সমৃদ্ধ হবে, সেই ব্যবস্থাও করা হচ্ছে না। স্কুল ক্রিকেটকে প্রায় ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। ঢাকার বাইরে লিগ হয় কিনা, সেদিকে কোনো মনোযোগ ছিল না জালাল ইউনুসদের। বগুড়ার শহীদ চান্দু স্টেডিয়াম, খুলনার শেখ আবু নাসের স্টেডিয়াম, নারায়ণগঞ্জের খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়াম অলস পড়ে থাকে, নষ্ট হয় মূল্যবান জিনিসপত্র। এসব স্টেডিয়ামের সংস্কার, রক্ষণাবেক্ষণ কিংবা এগুলোতে খেলা রাখতে ইচ্ছুক ছিল না পাপন গং। বিপরীতে ‘নগদ নারায়ণের’ জন্য তারা ঢাকার পূর্বাচলে হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন স্টেডিয়াম নির্মাণে অত্যুৎসাহী ছিলেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে খুশি করতে নাজমুল ইসলাম পাপনরা মুজিববর্ষ উদযাপনে ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে কনসার্টের আয়োজন করেন। ক্রিকেটের সঙ্গে এই কনসার্টের কী যোগসূত্র ছিল? সমালোচনাও সহ্য করতেন না পাপনরা। বিসিবির সমালোচনা করায় জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক আমিনুল ইসলাম বুলবুলকে পর্যন্ত নানাভাবে হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। বিসিবির আর্থিক খাতে নানা অনিয়মের কথাও গোপন কিছু নয়।
তিন.
নানা অনিয়ম আর দুর্নীতিতে যারা জড়িত, তাদের বিচার কী হবে? তাদের মুখোশ কী ফাঁস হবে? আমরা আশান্বিত হতে পারি। বা বলা যায়, আমাদেরকে আশান্বিত করা হচ্ছে। করছেন পটপরিবর্তনের পর বর্তমান দায়িত্বপ্রাপ্তরা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া ‘যেখানে দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ আছে, এ বিষয়গুলো তদন্ত করব। এবং যাঁরা দায়ী, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। যে গঠনতন্ত্র আছে, ফেডারেশন আছে, সেটা যেন গণতান্ত্রিক হয়। একনায়কতন্ত্রের চর্চার যেন সুযোগ না থাকে, সেগুলো পুনর্গঠনের চিন্তাভাবনা আছে।’
অসাধুদের পর্দা ফাঁস হওয়া এই কারণে জরুরি, যাতে ভবিষ্যতে অন্য কেউ অনিয়মের গলি পথে পা বাড়াবার কথা চিন্তাও না করেন।
চার.
বিসিবি থেকে নাজমুল ইসলাম পাপনের যুগ শেষ। পরিস্থিতির কারণে পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন তিনি। সঙ্গে পরিচালক জালাল ইউনুস ও আহমেদ সাজ্জাদুল আলম ববি বিদায় নিয়েছেন। এ দুজনের স্থলে পরিচালক হিসেবে বোর্ডে জায়গা পেয়েছেন জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক ফারুক আহমেদ এবং ক্রিকেট কোচ ও বিশ্লেষক নাজমুল আবেদীন ফাহিম। বোর্ড সভায় নতুন সভাপতি মনোনীত হয়েছেন ফারুক। এই প্রথম দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা কেউ বিসিবির সভাপতি হলেন। তাঁর নেতৃত্বেই ১৯৯৪ সালে আইসিসি ট্রফি খেলে বাংলাদেশ। ফারুক ২০০৩ থেকে ২০০৭ সাল অবধি ছিলেন জাতীয় দলের প্রধান নির্বাচক। ওই সময়ে কার্ডিফে অস্ট্রেলিয়াবধ কিংবা বিশ্বকাপে ভারতকে উড়িয়ে দেওয়ার সুখস্মৃতি ছিল বাংলাদেশের। তামিম, সাকিব, মুশফিকরা এখন বড় তারকা। তাদেরকে জাতীয় দলে সুযোগ করে দিয়েছিলেন ফারুক। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে ফের জাতীয় দলের প্রধান নির্বাচকের দায়িত্ব পান তিনি। ২০১৬ সালের জুন অবধি ছিলেন। ওই সময়েও দারুণ ক্রিকেট খেলে জাতীয় দল। বিতর্কিত দ্বিস্তরবিশিষ্ট দল নির্বাচনের প্রতিবাদে তখন পদত্যাগ করেন ফারুক আহমেদ। এরপরও নানা সময়ে বিসিবির নানা অনিয়মের বিরুদ্ধে সচকিত ছিলেন এই সাবেক ক্রিকেটার।
মূলত এসবকিছুই আমাদেরকে নতুন স্বপ্নের ভেলায় ভেসে বেড়াতে হাওয়া যোগায়। দৃঢ়চেতা ফারুক আহমেদের নেতৃত্বে ইতিবাচকতায় বদলে যাওয়া বিসিবিকে পাওয়া যাবে, শুধু জাতীয় দল নয় বরঞ্চ ঘরোয়া ক্রিকেট পাবে পূর্ণ মনোযোগ, সাংগঠনিক থেকে অবকাঠামোÑসবখাতে ক্রিকেট পাবে নতুন ফুয়েল, বন্ধ হবে দুর্নীতি-অনিয়ম--এমন আশা তো দূরাশা নয়! ফারুক নিজেও জানেন কাজটা সহজ কিছু নয়। কিন্তু তিনি পিছু হটার লোক নন। ব্যক্তিত্ব, ক্রিকেটজ্ঞান, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তাকে ব্যতিক্রম করেছে। সভাপতির দায়িত্ব নেওয়ার পর ফারুক বলছিলেন, ‘আমরা সবাই জানি, বাংলাদেশের মতো একটা সম্ভাবনাময় দেশে আমাদের যতটুকু করার দরকার ছিল, ততটুকু করতে পারিনি। এটা বলার শেষে যেটা বলতে চাচ্ছি আমি, আমাদের সাফল্য একদম কম নয়। হয়তো কিছু পার্টিকুলার সেক্টরে আমরা আরও উন্নতি করার কথা ছিল, যেগুলো করতে পারিনি। এখন আমাদের দায়িত্ব এই সিস্টেমকে রিবিল্ড করা।’
নানামুখী চাপের কথা জেনেও দৃঢ়চেতা ফারুক, ‘অনেক সময় অনেক কাজ করা যায় না। অনেক ধরনের আউটসাইড প্রেশার থাকে। এবার আমি সভাপতি থাকা অবস্থায় যতটুকু সম্ভব সুন্দর সিস্টেম দাঁড় করাতে চাই। এটা পুরোনো কথা, একটা সিস্টেমের বিরুদ্ধে লড়াই করে আমি পদত্যাগ করেছিলাম। এটা আমার সবচেয়ে বেশি প্রায়োরিটি থাকবে, সিস্টেমটা আমি তৈরি করতে চাই।’ সিস্টেম তথা পদ্ধতিগত সংস্কার হবে কিনা, সঠিক পদ্ধতিতে বিসিবি কাজ করবে কিনা, তা আপাতত সময়ের জন্য তোলা থাকছে। অতি দ্রুত ক্রিকেট ফিরবে সঠিক ট্র্যাকে--এমনটা চাইতেই পারেন ক্রিকেটপ্রেমীরা।
(লেখাটি সর্বপ্রথম পাক্ষিক ক্রীড়াজগত পত্রিকার ১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ সংখ্যায় প্রকাশিত)