মানুষের সীমাহীন অক্ষমতা আছে। তবু পৃথিবীতে যেটুকু সময়ের ফ্রেমে তাকে বেধে দেয়া হয় ওই সময়টুকু মহিমান্বিত করে রাখবার চেষ্টাটা অন্তত করা যায়। বিশ্বমানুষ যখন নানামুখী কসরত করছে মহানুভবতার কতটা শিখরে পৌঁছা যায় এটা নিয়ে, সেখানে আজকের বাংলাদেশিরা প্রধানতম ব্রত করে নিয়েছে কোন বাহানায় হন্তারক হয়ে উঠা যায়। ঘৃণা ও জিঘাংসা প্রকাশ করা যায়। কী অসহায়ত্ব আমাদের! কত অযোগ্য আমরা! নিরীহ দর্শন একটা পিপীলিকা বানানোর সাধ্যও আমাদের নেই, সেখানে আমরা কিনা কথায় কথায় মানুষ পিষে মারছি।
কল্পনা করা যায় অতি সংখ্যালঘু সাধুরা তাদের দয়াল গুরু মুর্শিদের মাজারের সাথে লেগে থাকছে বলে তাদেরকে কুপিয়ে প্রাণহরণ করা হচ্ছে। বুলডোজারে গুড়িয়ে দিয়েও সাধ মিটছে না সংখ্যাগুরুর, রীতিমতো আগুনে ঝলছে দেয়া হচ্ছে ভক্তের প্রিয়াস্পদ মুর্শিদের লোককৃত্যের স্মৃতিধাম। এসব কর্মকাণ্ড যারা করছে তাদের বিরুদ্ধে নাকি অন্তর্বর্তী সরকার কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের কার্যক্রম জারি রেখেছে। কোথায় সে কার্যকরণ? কেউ কিছু দেখেছে?
এই সুযোগে সাতক্ষীরায় এক প্রতিবন্ধী তরুণীকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে মেরেছে এক কাপুরুষ। প্রথম আলোর ১৪ সেপ্টেম্বরে পরিবেশিত খবর থেকে জানা যাচ্ছে, সাতক্ষীরায় বাড়ির সামনে দিয়ে জোরে গান বাজিয়ে যাওয়ার অভিযোগে এক প্রতিবন্ধী তরুণীকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ পাওয়া গেছে। শনিবার সকাল ১০টার দিকে সদরের লাবসা ইউনিয়নের থানাঘাটা মোড়ে এ ঘটনা ঘটে।
ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে পাঁচজনকে আটক করে র্যাবের কাছে হস্তান্তর করেছে এলাকাবাসী। নিহত তরুণীর নাম রজিনা সুলতানা (২০)। তিনি সাতক্ষীরা শহরের সুইড খাতিমুন্নেসা হানিফ লস্কর বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের ভোকেশনাল শ্রেণির ছাত্রী ছিল। তাঁর বাড়ি সাতক্ষীরা সদর উপজেলার থানাঘাটা এলাকায়। বাবার নাম রেজাউল করিম।
সদর উপজেলার থানাঘাটা গ্রামের ছখিনা খাতুন জানান, রজিনা সকাল ১০টার দিকে রাস্তা দিয়ে একটি স্পিকারে জোরে গান বাজিয়ে যাচ্ছিলেন। এ সময় একই এলাকার ইলিয়াস হোসেন তাঁর বাড়ির সামনে জোরে গান বাজানোর বিষয়ে অভিযোগ করে হাতুড়ি দিয়ে রজিনার মাথায় কয়েকটি আঘাত করে। এতে ঘটনাস্থলেই রজিনার মৃত্যু হয়। ইলিয়াস ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে স্থানীয়রা র্যাব-৬ সাতক্ষীরা ক্যাম্পে খবর দেয়। র্যাব সদস্যরা ঘটনাস্থল থেকে ইলিয়াস ও তাঁর বাবা একরামুল হোসেন, মাসহ পাঁচজনকে আটক করে।
গান শোনা না শোনা নিয়ে একজন স্বাভাবিক বোধসম্পন্ন মানুষের সাথে তর্ক করলেও নাহয় মানা যায়। যে নারী প্রতিবন্ধী তার প্রতিও কি আপনাদের দিলে রহম হতে পারত না? আপনারা নিজেদের জগতে জঙ্গুলে আইন কায়েম করে শুধু নিজেরা একাই বেঁচে থাকবেন? সহাবস্থান ও সম্প্রীতি না থাকা আপনাদের জরাগ্রস্ত ভুবনে এতটুকু ভিন্নমতাদর্শীরও জায়গা হবে না? আপনাদের ভুবনে প্রেম, ভালোবাসা, মায়া, উদারনৈতিকতা, সহনশীলতা, বিবেক ও বোধ বলে কিছুই থাকবে না? কারো মৃত্যুতে আপনাদের পাষাণ হৃদয় কেপে উঠে না? চোখে একফোঁটা অশ্রু নামে না? এ কোন যমদূতের ছোঁয়াচ পেয়ে গেলেন আপনারা?
আমরা তো আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্যই জানবাজি লড়াই করে চলছি। যেসব শাসক নিজেদের ছাড়া আর কারো কথা চিন্তা করত না, তাদেরকে বিদায় করে দিয়েছি। দেশটাকে তো আমরা সবাই সুস্থির অবস্থায় দেখতে চাই। যেখানে জাতি ধর্ম গোত্র বর্ণ নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবাই সবার প্রতি সহমর্মিতা পোষণ করবে। হিংসা ও হানাহানি বাদ দিয়ে ভালোবাসার কথা বলবে সবাই। যেখানে সবাই সমস্বরে প্রাণখুলে ডিএল রায় গাইবে, ' এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি /সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি।
আমরা ঠিক জানি না সত্য সুপথে না চলে এভাবে আমরা কোথায় হারাতে বসেছি। আমরা যে মানুষের জন্য কাঁদব সেই অনুভূতিটুকুও যেন অসার হয়ে যাচ্ছে। একজন নারী আপনাদের ভাষায় গান শুনবার পাপ করেছে বলে আপনারা নিষ্ঠুর, নির্মম ও নির্দয় জল্লাদ হয়ে উঠলেন। এতে করে যে পাপে আপনারা নিমজ্জিত হলেন, সেই পাপিষ্ঠের জায়গা কোন নরকে হবে?
শোকাভিভূত আমরা রজিনা সুলতানার দুর্বিপাকে পড়া পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাই। যেখানে যমদূত এতটা বেপরোয়া, সেখানে বিচারের কাজী বড়ই অচল। আমরা মহাকালের কাছে বিচার দিয়ে রাখলাম। মহান ঈশ্বর আমাদেরকে যেন মানুষরূপে গড়েন।
লেখক: সাংবাদিক
১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪