ধর্মের আধ্যাত্মিকতায় মজে ভক্তের মন। মহিমা উদ্ভাসিত হলে অন্তরে প্রশান্তির ফল্গুধারা বয়। আমরা তেমন ভক্ত জীবন দিয়ে যাকে ভালোবাসি সেই মহামানবের আজ জন্মদিন। শুভ হোক ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)। সাড়ে চৌদ্দ শ বছর পেরিয়ে গেল, দিন দিন এই মানুষটির ভক্ত ও অনুরাগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। কেন?
মানবীয় সভ্যতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাতিঘর তিনি। যুগে যুগে বহু মনীষী সভ্যতা বদলে দিতে নিজস্ব ধ্যান ও জ্ঞান দিয়ে পৃথিবীকে সাজিয়েছেন। আইন প্রণেতা ও রক্ষক হয়ে উঠেছেন। আমাদের মুসলিমদের কাছে সেসব মহামনীষীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম মানুষ হলেন হযরত মুহাম্মদ (সা.)।
ইবনে ইসহাক রচিত শহীদ আখন্দের অনুবাদে সিরাতে রাসুলুল্লাহ (সা.) গ্রন্থের ৯১ পৃষ্ঠায় লেখক বলেছেন, কিংবদন্তি আছে (সত্য-মিথ্যা আল্লাহ্ জানেন), রাসুলুল্লাহর (সা.) মা আমিনা বিনতে ওয়াহাব প্রায়ই বলতেন, রাসুলুল্লাহকে (সা.) গর্ভে ধারণ করা অবস্থায় একটি কন্ঠ তাঁকে বলত, 'আপনি এই জাতির রাজাধিরাজকে গর্ভে ধারণ করে আছেন। তাঁর জন্মের পর আপনি বলবেন, সমস্ত হিংসুকের বদনজর থেকে তাকে আমি অদ্বিতীয়ের হেফাজতে সোপর্দ করলাম; তাঁর নাম রাখবেন মোহাম্মদ।'
যখন তিনি তাঁকে গর্ভে ধারণ করেছিলেন, তাঁর দেহ থেকে একটা আলো বেরোত। সেই আলোয় তিনি সিরিয়ার বুসরার প্রাসাদ দেখতে পেতেন।
১২ রবিউল আউয়াল সোমবার রাসুল (সা.) জন্মগ্রহণ করেন। ইয়াসরিবের এক দুর্গের চূড়া থেকে গলার সমস্ত জোর দিয়ে প্রাণপণে চিৎকার করছিলেন এক ইহুদি, 'এই ইহুদির দল।' সব লোক ছুটে এল। তারাও চিৎকার করে বলল, 'কী হচ্ছে এসব, অ্যাঁ? কী হয়েছে? সেই ইহুদি জবাব দিলেন, 'আজ রাতে এক তারকার উদয় হয়েছে, সেই তারকার নিচে জন্মগ্রহণ করবে আহমদ।'
ছেলের জন্মের পর সংবাদ পেয়ে দাদু মুত্তালিব এসে নাতিকে কোলে তুলে নিলেন। মা আমিনা তাঁর ওপর দৈব নির্দেশনার কথা জানালেন। কথিত আছে, আবদুল মুত্তালিব তখন রাসুল (সা.)কে কাবাঘরের মাঝখানে থাকা হুবালের কাছে নিয়ে গেলেন। সেখানে দাঁড়িয়ে তিনি আল্লাহর কাছে শোকরগোজারি করলেন এই অপূর্ব উপহারের জন্য।
তৎকালীন আরবের প্রথা অনুযায়ী ধাত্রী-মা হালিমার কাছে লালিত পালিত হলেন শিশু মোহাম্মদ (সা.)। হালিমা স্বামী এবং ছোট বাচ্চা নিয়ে নিজের দেশ থেকে তাঁর গোত্রের জন্য মেয়েদের সঙ্গে লালন করার মতো বাচ্চার অনুসন্ধানে বেরিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য, বাচ্চা পেলে তার ধাত্রী-মা হবেন। দুর্ভিক্ষের বছর ছিল সেটা। তাঁদের সহায়-সম্বল কিছু ছিল না। এক ফোঁটা দুধ ছিল না স্তনে তাঁর। এক চুমুক দুধ দিতে পারেনি উটও। ক্ষুধার্ত শিশুর কান্নায় সারা রাত কারো ঘুম হয়নি। চলৎশক্তিহীন উটের পিঠে চড়ে মক্কায় পৌঁছতে হলো সবার পরে। সবাই চাইছিল এমন শিশুকে নিতে যার বাবা মায়ের কাছ থেকে কিছু নগদ অর্থ প্রাপ্তির আশা ছিল। মোহাম্মদ (সা.)কে গ্রহণ করার জন্য সবাইকে অনুরোধ করা হলো। কিন্তু যেই শুনলেন তিনি এতিম, কেউ তাঁকে নিতে রাজি হলো না।
হালিমাও অনাগ্রহ দেখালেন নিজের অসহায়ত্ব বিবেচনায়। কিন্তু সবাই একটা করে বাচ্চা পেয়ে গেলেও, পেলেন না শুধু হালিমা। কিন্তু বাচ্চা ছাড়া তিনি দেশে ফিরে যাবেন? এটা হয় না। স্বামীকে হালিমা বললেন, আমার ভালো লাগছে না, আমি বরং সেই এতিম বাচ্চাকেই নেব। সবচেয়ে নিঃস্ব ও সহায়-সম্বলহীন হালিমার কোলেই জায়গা পেলেন বরকতময় মুহাম্মদ (সা.)।
হালিমা যেই তাঁকে বুকে চেপে ধরলেন, সমস্ত বুক ভরে গেল দুধে। বুক থেকে দুধ উপচে পড়ছিল তাঁর। পরম পরিতৃপ্তি ভরে সেই দুধ পান করে শীতল হলেন মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর দুধভাই আব্দুল্লাহ। অনাহারে ঘুমহীন থাকা হালিমার নিজের ছেলেটিও অনেকদিন পর ঘুমাল। হালিমার স্বামী উঠে উটের কাছে গেলেন। কী অবাক কাণ্ড! তার বাটভর্তিও দুধ। পেট ভরে দুধ খেয়ে তৃপ্ত হয়ে অনেকদিন পর রাতে ঘুম হলো সবার।
সকালে স্বামী বললেন, 'তুমি জানো হালিমা, তুমি এক প্রিয় বস্তু গ্রহণ করেছ?'
হালিমা বললেন, আলহামদুলিল্লাহ! আমার তাই মনে হচ্ছে।
ঠিক এভাবেই জীবনের শুরুতে একটি পরিবার এবং ক্রমান্বয়ে বিশ্ববাসীর জন্য রহমতস্বরূপ হাজির হলেন নবী মুহাম্মদ (সা.)।
বাংলা ভাষায় এই মহামানবকে নিয়ে সবচেয়ে প্রভাববিস্তারি প্রশস্তি গেয়েছেন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বহু গানে তিনি নবীবন্দনা করেছেন। এরমধ্যে শ্রেষ্ঠতম গান হলো...
হেরা হতে হেলে দুলে নুরানী তনু ও কে আসে হায়
সারা দুনিয়ার হেরেমের পর্দা খুলে খুলে যায়
সে যে আমার কামলিওয়ালা কামলিওয়ালা॥
তাঁর ভাবে বিভোল রাঙা পায়ের তলে
পর্বত জঙ্গম টলমল টলে
খোরমা খেজুর বাদাম জাফরানি ফুল
ঝরে ঝরে যায়॥
আসমানের মেঘ চলে ছায়া দিতে
পাহাড়ের আঁশু গলে ঝরনার পানিতে
বিজলি চায় মালা হতে
পূর্ণিমার চাঁদ তার মুকুট হতে চায়॥
আরবি-বাংলা অভিধানে কামলিওয়ালা শব্দটির দুটি অর্থ পাওয়া যায়: প্রথমত কম্বল -আবৃত, কম্বল- পরিহিত। দ্বিতীয়ত কম্বলধারী ব্যক্তি। এক কথায় ‘কামলিওয়ালা’ শব্দের অর্থ সুফি। যিনি কামেল লোক, যিনি সাধনায় সিদ্ধ হয়েছেন এবং পরিপূর্ণতা লাভ করেছেন।
হেরা পর্বতের গুহায় ধ্যান সেরে আল্লাহর অস্বিত্ব সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়ে সাধনায় সিদ্ধ হয়ে পরিপূর্ণতা লাভ করে হেলেদুলে মহানবী মক্কায় ফিরছেন। ‘হেলেদুলে’ শব্দবন্ধটি থেকেই অনুমান করা যায় কী নির্ভার হয়ে তিনি তাঁর ভক্তের মাঝে মিশে গিয়ে সাধারণের সঙ্গে নিজের দূরত্ব ঘুচিয়ে দিচ্ছেন।
নূরানী-তনু এই শব্দবন্ধটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ন। নূরানী শব্দটি ফারসি। এর মানে উজ্জ্বল, স্বর্গীয় আলোকপ্রাপ্ত। তনু মানে শরীর। এমনভাবে আরবি-ফারসির বাংলায়ন করবার শক্তি নজরুল ছাড়া আর কার আছে? ইসলামী পুরাণের সৃষ্টিতত্ত্বে আছে, আল্লাহ তাআ'লা সবার আগে মহানবীর নূর সৃষ্টি করেছেন।
গানটির 'সারা দুনিয়ার হেরেমের পর্দা খুলে খুলে যায়' চরণটিতে হেরেম শব্দটি আরবি হরম শব্দটি থেকে উদ্ভূত। আরবি-বাংলা অভিধানে হেরেম শব্দের মানে তিনটি। অন্দরমহল, পবিত্র স্থান ও নারী। অন্দরমহলের নারীদের অকারণে পর্দা দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। এখন সেই পর্দা খুলে যাবে। আরব জাহানে অসাধারণ একজন সুফি এসেছেন। যাঁর আত্মিক বিকাশ হয়েছে, সিদ্ধিপ্রাপ্ত যিনি মুক্ত হয়েছেন। এবার অন্যদেরও মুক্ত করবেন। ইসলামের ইতিহাস সাক্ষী মহানবী (সা.) মেয়েশিশু হত্যা রোধ করেছিলেন।
কবি কাজী নজরুল ইসলাম গীতিকবি হিসেবে কতটা আধ্যাত্মবাদ লালন করতেন এবং নিজের গানে আরবি-ফারসি ভাষার সাবলীল ব্যবহার করতে পারতেন এই গীতিকবিতাটি এর সবিশেষ উদাহরণ।
নবীজীর (সা.) অমৃত আলোকের পরম্পরাই যেন এই বাংলায় বয়ে নিয়ে এসেছেন কবি নজরুল। মানবতাবাদী সর্বজনের কবি হয়েও নজরুল তাই মুসলিমদের প্রাণের মানুষ।
কবি কাজী নজরুল ইসলামের আগে আমাদের এই মাটির আরেক মিস্টিক পুরুষ লালন ফকির নবীজী (সা.)কে গান গেয়েছেন...
নবী দীনের রাসুল খোদার মকবুল
ভুল করিলে মরবি প্রাণে, হারাবি দুই কূল।
অপর একটি গানে লালন ফকির বলেন...
পারে কে যাবি নবীর নৌকাতে আয়।
রূপকাষ্ঠের নৌকাখানি নাই ডুবার ভয়।।
পৃথিবী এক অলীক মায়া। অল্প ক'দিনের জন্যই বিচরণ। আসল ঠিকানায় যেতে হলে নবীর নৌকায় উঠতে হবে। যে নৌকাখানির ডুবার ভয় নাই। এভাবে বাংলার লোককবি চৌদ্দ শ বছর আগের এক মহান মানুষের মহিমা বর্ণনা করছেন।
ফকির লালন শাহ্ তাঁর আরেকটি গানে বলেন...
মদিনায় রাসুল নামে কে এলো ভাই।।
কায়াধারী হয়ে কেন তাঁর ছায়া নাই।।
কী দিব তুলনা তারে,
খুঁজে পাইনে এ সংসারে,
মেঘে যার ছায়া ধরে
ধুপের সময়।।
জগতে তুলনারহিত এই মানুষটিকে ছায়া দিতে মেঘও স্থির হয়ে যেত। কালান্তরে যিনি নিজেই হয়ে উঠেছিলেন বিশ্বমানবতার অতুল ছায়া। বিশ্ববিধাতার প্রেরিত এই প্রবাদপুরুষকে ঠিক চিনেছিলেন মহাত্মা লালন সাঁই।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের দিকপাল এবং আমাদের জাতীয় সংগীতের রচয়িতা নোবেল লরিয়েট রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও আমাদের মহানবী (সা.) এর জীবনদর্শনে মুগ্ধ ছিলেন।
জীবনের একেবারে শেষপর্বে পারস্য, ইরাক এবং সিংহল ভ্রমণের সময় মানুষের পারস্পরিক ভেদাভেদ ও উগ্র জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে তাঁর বিতৃষ্ণা খুব তীব্র হয়েছিল। তবে বিভিন্ন রাষ্ট্র পরিভ্রমণ করে মানবজাতির মধ্যে বহুবিধ বিভাজন সৃষ্টির হীনতা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের নিজের মতও সুদৃঢ় হয়।
১৯৩২ সালের মে মাসে রবিঠাকুর ইরাকের একটি বেদুইন শিবিরে গিয়েছিলেন। সেখানে এক মুসলিম উপজাতি নেতা তাঁকে বলেন,
‘আমাদের মহানবী বলেছেন, তিনিই সত্যিকারের মুসলমান, যাঁর বাক্য বা কর্মের দ্বারা তাঁর ভ্রাতৃপ্রতিম মানুষগুলোর ন্যূনতম ক্ষতিসাধনও হয় না।’
এমন কথায় বিস্মিত হয়ে কবি তাঁর ডায়েরিতে লিখে নিয়েছিলেন,
‘চমকে উঠলুম। বুঝলুম তার কথাগুলোই মানবতার মূল কথা।’
পারস্যে নবী মুহাম্মদ (সা.) এর আদর্শ অনুসরণে গড়ে ওঠা ইসলামী ঐতিহ্যের সান্নিধ্যে গিয়ে রবিঠাকুর এই মহত্তম উপলব্ধিতে স্থির হন যে, 'ভালো হও, ভালোবাসো এবং ভালো করো -এইটেই পথ।'
বাংলাদেশের বর্তমান অস্থির সময়ে ধণিকশ্রেণির কথিত শিক্ষিত যুবাদের বিপথগামিতার কালে, ধর্ম নিয়ে ভয়াল অসহিষ্ণুতা ও অস্থির বাড়াবাড়ির এই সময়; আমাদের কামলিওয়ালা মহানবীর (সা.) আপ্তবাক্য বড় প্রাসঙ্গিক এবং তাঁর জীবনদর্শনই অনুকরণীয়।
ইয়া রাসুল সালাম আলাইকা।
লেখক: সাংবাদিক
১২ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ |
১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪
তথ্যসূত্র:
সিরাতে রাসুলুল্লাহ (সা.) -ইবনে ইসহাক
'বাংলা ভাষায় আরবী ফারসী তুর্কী হিন্দী উর্দু শব্দের অভিধান’ -সম্পাদনা কাজী রফিকুল হক | বাংলা একাডেমি
পারস্য যাত্রী -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
Songs of Lalon Shah - Abu Rushd
Sufism | Islamic mysticism -Britannica
https://plato.stanford.edu/entries/arabic-islamic-mysticism/