Posts

প্রবন্ধ

মহামানব হজরত মুহাম্মদ (সা.)

September 16, 2024

ফারদিন ফেরদৌস

89
View

আজ ১২ রবিউল আওয়াল। 
দিনটি ইসলাম ধর্মের সর্বশেষ নবী ও রাসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.) জন্ম ও ওফাতের পুণ্য স্মৃতিময় ক্ষণ। ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে পৃথিবীর আলো বাতাসে আবির্ভূত হন এই মহামানব। ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনেই তিনি শারীরিকভাবে লোকান্তরিত হন। রয়ে যায় তাঁর প্রবর্তিত ধর্ম ও আদর্শ। ওফাত দিবসের শোক ছাপিয়ে এতদাঞ্চলে জন্মদিনটাকে স্মরণ করতে এদিন 'ঈদে মিলাদুন্নবী(সা.) হিসেবে পালিত হয়। যদিও খোদ মুসলিম পণ্ডিতদের মধ্যেও নবীজী (সা.)'র জন্ম ও মৃত্যু দিবস নিয়ে মতদ্বৈততা রয়েছে।

দিনটি আমাদের মুসলমানদের কাছে পুণ্যময় ও আশীর্বাদধন্য। বাল্যেই পক্ষ বিপক্ষ নির্বিশেষে সবার কাছে 'আল আমিন' হিসেবে নবীজী নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন। পরের উপকার ছিল তাঁর অন্যতম অভীপ্সা।

ন্যায়নিষ্ঠা, সততা, সত্যবাদিতা, ক্ষমাশীলতা, বিনয়, সহিষ্ণুতা, সহমর্মিতা, শান্তিবাদিতাসহ সমুদয় সদগুণ তিনি আত্মস্থ করেছিলেন। নবুয়তপ্রাপ্তির পর বিশ্বমানবতার মুক্তি ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠাই হয় তাঁর পরম ব্রত। মানবিক গুণাবলী চর্চা এবং তা শিষ্যদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম ও অদ্বিতীয়।

তিনি শেষ নবী। এ ব্যাপারে কুরআনিক ভাষ্যও তেমন সাক্ষ্য দেয়‌। ৩৩ নাম্বার সুরা আল আহযাব(জোট) এর ৪০ নাম্বার ভার্সে বলা হয়েছে...
مَا کَانَ مُحَمَّدٌ اَبَاۤ  اَحَدٍ مِّنۡ رِّجَالِکُمۡ وَ لٰکِنۡ رَّسُوۡلَ اللّٰہِ وَ خَاتَمَ 
النَّبِیّٖنَ ؕ وَ  کَانَ اللّٰہُ  بِکُلِّ شَیۡءٍ عَلِیۡمًا ﴿٪۴۰﴾
মা-কা-না মুহাম্মাদুন আবা আহাদিম মিররিজা-লিকুম ওয়ালা-কির রাছূলাল্লা-হি ওয়া খাতামান নাবিইয়ীনা ওয়াকা-নাল্লা-হু বিকুল্লি শাইয়িন ‘আলীমা-।
মুহাম্মাদ (সাঃ) তোমাদের মধ্যেকার কোন পুরুষের পিতা নয়, কিন্তু (সে) আল্লাহর রসূল এবং শেষ নবী। আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বজ্ঞাতা।

¶ রাসুলের শানে 'কাশিদা' তথা না'ত লিখেছিলেন ফার্সি কবি শেখ সাদী। 
বালাগাল উলা বি কামা-লি হি
কাশাফাদ দুজা বি জামা-লি হি
হাছুনাত জামিউ খিছ-লি হি'।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, কবির প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিলো একটি রুবাই লেখা। রুবাই নির্দিষ্ট ছন্দোবদ্ধ চার লাইনের ফার্সি কবিতা। ওপরের এই তিনটি লাইন লেখার পর শেখ সাদী অনেকক্ষণ ভেবেও চতুর্থ লাইনটি মেলাতে পারছিলেন না। অগত্যা ঘুমিয়ে পড়েন। জানা যায়, রাসুলে কারীম স্বয়ং নিজে কবির স্বপ্নে এসে বলে দিলেন চতুর্থ লাইনটি...
সাল্লু আলাইহি ওয়া আলি হি'।

বাঙালি কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ তাঁর “সকল প্রশংসা তাঁর” কাব্যগ্রন্থে এর রূপান্তর করেন এভাবে:
'তাবৎ পূর্ণতা নিয়ে শীর্ষে হয়েছেন উপনীত, 
অপার সৌন্দর্যে তিনি আলো করেছেন তমসাকে, 
আশ্চর্য চরিত্র তাঁর অতুলন সৌন্দর্যে মন্ডিত, 
রাহমাতুল্লিল আ’লামীন-হাজার সালাম তাঁকে।'

¶ এমন একজন মহামানবকে নিয়ে সারাবিশ্বে গেল বছর এইসময় মুসলিমদের মধ্যে একধরণের উত্তেজনা ও ক্ষোভ চলছিল। 'ফ্রিডম অব স্পিচ' বা ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশনস'র নাম করে ফ্রান্সের ব্যঙ্গাত্মক পত্রিকা শার্লি এবদোতে কার্টুন ছাপা হয়েছে। বলা হচ্ছিল আমাদের প্রিয় নবী(সা.) এর প্রতিচিত্র এটা। এই নিয়ে এক মুসলিম উগ্রবাদীর হাতে মুক্তচিন্তক শিক্ষকও খুন হয়েছেন।

তখন লিখেছিলাম, স্মরণকালের ইতিহাসে প্রফেট মুহাম্মদ (সা.) একমাত্র ব্যক্তি যার কোনো ছবি, প্রতিকৃতি বা ভাস্কর্য নেই। মধ্যযুগে অনেক মুসলিম শিল্পী কুরআন হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী নবীজীর প্রতিকৃতি আঁকবার চেষ্টা করেছিলেন। সেসময় সেটা নিয়ে অবশ্য মিছিল মিটিং খুনোখুনির ঘটনা ঘটেনি।  

আমাদের কথা হলো যে মহামানবের কোনো প্রতিচিত্র দুনিয়াতে নাই, সেই মানুষটির কার্টুন এঁকে দিলেই তা মুহাম্মদ(সা.) হয়ে যায় না। এমনটা বিশ্বাস করার কোনো যুক্তিগ্রাহ্য কারণও নেই। বরং পাত্তা না দিলেই ওই পত্রিকা ও কার্টুনিস্ট হাওয়ায় মিলিয়ে যেত।

আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন এ ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন ১৫ নাম্বার সুরা আল হিজর(পাথুরে পাহাড়) ৯৫ নাম্বার আয়াতে...
اِنَّا کَفَیۡنٰکَ الۡمُسۡتَہۡزِءِیۡنَ ﴿ۙ۹۵﴾
ইন্না-কাফাইনা-কাল মুছতাহঝিঈন।
আমিই যথেষ্ট তোমার জন্য, বিদ্রুপকারীদের বিরুদ্ধে।

যে কাজটি মহান স্রষ্টা নিজে করবেন বলে জানিয়ে রেখেছেন, সেই বিষয়টিতে আমরা ধৈর্য ধরতে পারতাম। খোদার ওপর খোদগারি না করে আল্লাহ্'র ওপর ভরসা করতে পারতাম।

ফ্রান্সে ৭০ লাখ মুসলিম বাস করে। শত শত মসজিদ আছে সেখানে। আমরা যখন ঢালাওভাবে ফ্রান্সের ধ্বংস কামনা করছি, তখন আসলে নিজেরা নিজেদেরই ধ্বংস কামনা করছি। ক্ষমা ও সহনশীলতার আইকন আমাদের নবীজী কি এমনটা করতে বলতেন?

কখনোই না। আজকে যার ধ্বংস কামনা করছি তিনি মৃত্যুর আগে ভিন্ন চরিত্রের হবেন না তা কি আমরা নির্নয় করবার ক্ষমতা রাখি?

যে মহামানবকে নিয়ে বিশ্বের অধিকাংশ মহামনীষীরা ইতিবাচক মন্তব্য করেছেন তাঁর অনুসারীদের আরো প্রজ্ঞাময় ও ধৈর্যশীল হওয়াটাই শোভন ও সমীচিন ছিল। খুন, জখম, জ্বালাও, পোড়াও বা মিছিল মিটিং দিয়ে কি আদৌ নবীজীর আদর্শ সমুন্নত থাকে? বরং ভালোবেসে মানুষকে সত্য ও সুন্দরের পথে আহ্বান করাই হলো নবীজীর সত্যিকারের আদর্শ। উদারনৈতিকতা শিকেয় তুলে রেখে ঘৃণ্য ধর্মান্ধতা কখনোই প্রকৃত ধর্মাচার হতে পারে না।

প্রতিবাদ হোক গঠনমূলক, হিংসাত্বক নয়। দূতাবাস ঘেরাওয়ের নামে পুলিশকে ব্যতিব্যস্ত রাখা, রাস্তা বন্ধ করে দেয়া, বর্জনের নামে নিজের দেশের পোশাক শিল্পকে ঝুঁকিতে ফেলা এবং সেদেশে বসবাসরত আমাদের নাগরিকদের দুর্বিপাকে ফেলবার কোনো যৌক্তিকতা নাই।

সর্বোপরি কোনো একটি বিশেষ কার্টুনচিত্রই যে, আমাদের মহানবী(সা.) নন -এই প্রতীতি আমাদের সবার মনে জাগরুক থাকুক।

¶ ভারত থেকে প্রকাশিত ‘হেরিটেজ টাইমস’ পত্রিকায় ব্রিটেনে বসবাসরত পেশাগত চিকিৎসক এবং লেখক, সংগ্রাহক ও গবেষক ড. মোহাম্মদ সিদ্দিক (এম এস সিদ্দিক) ‘দি বুক- দি সেয়িংস অব মুহাম্মদ (সা.) অ্যান্ড টলস্টয়’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ লেখেন।

এই প্রবন্ধ মতে, উনিশ এবং বিংশ শতকের শুরুতে মুসলমান বুদ্ধিজীবীরা পশ্চিমা বিশ্বে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনী প্রচারে সচেষ্ট হন। এর মধ্যে ১৮৯১ সালে ‘দি স্পিরিট অব ইসলাম’ বইটি লিখেন। তারপর ১৯০৫ সালে প্রকাশিত হয় স্যার আবদুল্লাহ আল মামুন আল সোহরাওয়ার্দী রচিত ‘দি সেয়িংস অব মুহাম্মদ (সা.)’। এ বইটি বিভিন্ন পশ্চিমা মনীষীকে প্রভাবিত করেছিল, যার অন্যতম জগৎখ্যাত লেখক লিও টলস্টয়।

এই বইয়ের সূত্র ধরে টলস্টয় ও মামুন আল সোহরাওয়ার্দীর মধ্যে বেশ কিছু চিঠি বিনিময় হয়। ওই প্রবন্ধ মতে, টলস্টয় মহানবী (সা.)-এর বাণী বা হাদিস সমৃদ্ধ এই বই রাশিয়ার জনগণের জন্য রাশিয়ান ভাষায় অনুবাদ করতে চেয়েছিলেন। জীবনের শেষভাগে টলস্টয় এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করেন। পারিবারিক ও রাষ্ট্রীয় চাপে তিনি ধর্মের মাঝে প্রশান্তি খুঁজতে শুরু করেন।

ডা. এম এস সিদ্দিকের প্রবন্ধের আরও দাবি, শেষ জীবনে টলস্টয় হাতেগোনা যে কয়েকটি বই পড়তেন, তার অন্যতম ছিল মহানবী (সা.)-এর বাণী নিয়ে রচিত এই বই। মামুন আল সোহরাওয়ার্দীর ভাগিনা এবং এদেশের গণতন্ত্রের মানসপুত্র খ্যাত হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ভাই হাসান শহীদ সোহরাওয়ার্দী মস্কোর ওমেন্স ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজি বিষয়ে অধ্যাপনাকালে লিও টলস্টয়ের কন্যা আলেকজান্ডার টলস্টয়ের সাক্ষাৎ পান। জীবনের শেষভাগে টলস্টয়কে সঙ্গ দেন এই কন্যা এবং তার সেক্রেটারি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।

১৯১০ সালের নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে এক শীতের রাতে অজানার উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বেরিয়ে যান লিও টলস্টয়। এরপর ২০ নভেম্বর ১৯১০ তারিখে দক্ষিণ রাশিয়ার এস্টাপোভো রেলস্টেশনে তাকে পড়ে থাকতে দেখেন স্টেশন মাস্টার। সেখানেই তার মৃত্যু ঘটে। তবে মৃত্যুর সময় তার লম্বা শীতের কোটের পকেটে পাওয়া যায় একটি বই। যার নাম ‘দি সেয়িংস অব মুহাম্মদ (সা.)’ অর্থাৎ হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বাণী বা হাদিস।  

সেই বাণীর অন্যতমটি ছিল, মনের জিহাদই বড় জিহাদ।' অথচ আমরা ধর্ম অবমাননার ছলে মানুষ খুন পুড়িয়ে দেয়াকে ইসলামী জিহাদ ঠাওরাচ্ছি। আমাদের নবীজীর ইসলাম কখনোই এমন উগ্র ও কট্রর ছিল না। একশ্রেণীর স্বার্থান্ধ ধর্মের মধ্যে বিষযুক্ত রাজনীতি ঢুকিয়ে দিয়ে মানুষকে অতল অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছে। নবীজীর আলোক শিখা থেকে বঞ্চিত করছে। নবীজী এমন আলেম ওলামার অন্ধ অনুসারী হতে বারণ করেছেন।

¶ ঢাকা থেকে প্রকাশিত দি ডেইলি স্টার পত্রিকার মাসিক প্রকাশনা ‘দি ফোরাম’-এর আগস্ট ২০১০ সংখ্যায় ‘গান্ধী অ্যান্ড ইসলাম’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। সৈয়দ আশরাফ আলীর লেখা এই প্রবন্ধ মতে, মহাত্মা গান্ধী মহানবী (সা.) সম্পর্কে জানতে এতই আগ্রহী ছিলেন যে, যখন তিনি (গান্ধী) মহানবী (সা.) সম্পর্কিত পড়ার মতো কিছু পেতেন না, তখন খুবই দুঃখ অনুভব করতেন। গান্ধীর মতে, আমি শ্রেষ্ঠতম সেই মানুষের জীবন সম্পর্কেও আরও জানতে চাই, যিনি আজ কোটি মানুষের হৃদয়ে প্রভাব বিস্তার করে আছেন। আমি নিশ্চিত যে, এর নেপথ্যে তরবারি বা গায়ের জোরে নয়, বরং মহানবী (সা.)-এর সারল্য, আত্মত্যাগ, দৃঢ়সংকল্প, ভক্ত ও অনুসারীদের প্রতি মমত্ববোধ, সৎসাহস সর্বোপরি নিজের উদ্দেশে ও সৃষ্টিকর্তার ওপর অগাধ আস্থা তাঁকে এই সাফল্য এনে দিয়েছিল। আমি যখন মহানবী (সা.)-এর ওপর দ্বিতীয় বইটি পড়া শেষ করি, তখন আমার মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে এই ভেবে যে, হায়! এই মহান মানুষটিকে আরও জানার জন্য কিছু (বই) আর নেই।

মহাত্মা গান্ধী মহানবী (সা.) সম্পর্কে আরও বলেন, তিনি দারিদ্র্যের মাঝে দিন অতিবাহিত করেছেন, অথচ তাঁর সামনে ছিল অগাধ ধনসম্পদ লাভের সুযোগ। আমি যখন তাঁর নিজের, পরিবার এবং অনুসারীদের অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশা ও দারিদ্র্যের কথা অবগত হয়েছি, তখন আমার চোখ ভিজে যায়। তিনি স্রষ্টার প্রতি একনিষ্ঠ ও অনুগত ছিলেন, সর্বদা স্রষ্টাকে ভয় করতেন এবং তাঁর মনে ছিল মানবজাতির জন্য প্রবল মায়া-মমতা।

আল্লামা স্যার আবদুল্লাহ আল মাসুম আল সোহরাওয়ার্দী সংকলিত হাদিসগ্রন্থ পড়ে গান্ধী এতই মুগ্ধ হন যে, এই হাদিস তথা মহানবী (সা.)-এর বাণীকে তিনি কেবল মুসলমান নয়, সমগ্র মানবজাতির জন্য অমূল্য সম্পদ বলে উল্লেখ করেন।

¶ ১৯৩২ সালের মে মাসে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইরাকের একটি বেদুইন শিবির পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। সেখানে এক মুসলিম উপজাতি নেতা তাঁকে বলেন,

‘আমাদের মহানবী(সা.) বলেছেন, তিনিই সত্যিকারের মুসলমান, যাঁর বাক্য বা কর্মের দ্বারা তাঁর ভ্রাতৃপ্রতিম মানুষগুলোর ন্যূনতম ক্ষতিসাধনও হয় না।’

এমন কথায় বিস্মিত হয়ে কবি তাঁর ডায়েরিতে লিখে নিয়েছিলেন,
‘চমকে উঠলুম। বুঝলুম তার কথাগুলোই মানবতার মূল কথা।’

¶ ১৯৩৪ সালের ২৪ জানুয়ারি তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের (অবিভক্ত) লাহোর (বর্তমানে পাকিস্তান) থেকে প্রকাশিত ‘দি লাইট’ ম্যাগাজিনে ভারতে ভ্রমণরত জর্জ বার্নার্ড শর একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। দুর্লভ এই সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন ‘দি লাইট’ ম্যাগাজিনের বোম্বে প্রতিনিধি মনির হেইন্দাদে। এই সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে ইসলাম এবং হজরত মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে জর্জ বার্নার্ড শ বলেন, আমি সব সময়ই হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে একজন অন্যতম ও বিশ্বের পয়গাম্বর হিসেবে গণ্য করি।

ব্রিটিশ শিক্ষক ও জনপ্রিয় লেখক আর বোসওর্থ স্মিথ রচিত ‘মোহাম্মদ অ্যান্ড মোহমেডিজম’ গ্রন্থে বলেন, তিনি ছিলেন একাধারে একজন রাষ্ট্রনায়ক (সিজার) ও ধর্মগুরু (পোপ) তবে তিনি ছিলেন কোনো প্রকার চাওয়া-পাওয়া বা ভন্ডামির ঊর্ধ্বে থাকা ধর্মগুরু (পোপ) এবং বিশাল সৈন্যদলবিহীন শাসক (সিজার)। কোনো প্রকার নিয়মিত সৈন্য, দেহরক্ষী, রাজপ্রাসাদ এবং নিয়মিত আয় বা রাজস্ব গ্রহণ ছাড়াই যদি কোনো শাসকের ঐশ্বরিক বা অলৌকিক ক্ষমতাবলে শাসন পরিচালনার অধিকার বা দাবি থাকে, তবে তা ছিল একমাত্র তাঁর। কোনো প্রকার সরকারি দলিল ও দালিলিক সাহায্য ছাড়াই মুহাম্মদ (সা.) সব ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন।

¶ মার্কিন লেখক, জীবনী রচয়িতা, ইতিহাসবিদ ও স্পেনে নিযুক্ত আমেরিকার প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত ওয়াশিংটন ইরভিং রচিত ‘দি লাইফ অব মোহমেদ’ গ্রন্থে বলা হয়, ‘সামরিক ক্ষেত্রে জয়জয়কার তাঁর মাঝে কোনো গৌরব বা নিরর্থক অহংকার জন্ম দেয়নি, যা কেবল স্বার্থপরদের মাঝে জন্ম দেয়। তিনি যখন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন, তখনো তার ব্যবহার অসহায় অবস্থায় থাকা মানুষের মতো সারল্য এবং সাধারণ বেশভূষা পরিধানের প্রবণতা দেখা যায়। তিনি রাজকীয় শিষ্টাচার থেকে দূরে ছিলেন। কোনো কক্ষে প্রবেশের পর তার প্রতি অস্বাভাবিক প্রশংসা উচ্চারণ কবলে তিনি অসন্তুষ্ট হতেন।’

¶ ভারতীয় দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপক, গবেষক ও লেখক কে এস রামকৃষ্ণ রাও রচিত ‘দি প্রফেট অব ইসলাম’ গ্রন্থে লেখক বলেন, 'হজরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন একজন অনুকরণীয় মানুষ বা নিখুঁত মডেল। বহু মাত্রিক কর্মক্ষেত্রে এবং মানবতার সব শাখায় তিনি ছিলেন সর্বৈসর্বা বা বীর। সব মানুষের মাঝে ভ্রাতৃত্ববোধ বজায় রাখার রীতি এবং সব মানুষের মাঝে সাম্য সৃষ্টির তত্ত্ব ঘোষণা ও প্রচারের মধ্য দিয়ে মুহাম্মদ (সা.) সমাজে মানবতাকে উচ্চস্তরে স্থান করে দিয়েছেন।’

¶ মাইকেল এইচ হার্ট রচিত 'বিশ্ব সেরা ১০০ মনীষী' গ্রন্থের প্রথম পার্সোনালিটি হলেন নবী মুহাম্মদ (সা.)।

এখন যেসব অর্বাচীনরা ইসলামের শেষ নবী মুহাম্মদ (সা.)কে নানা ছুঁতোয় নেগেটিভলি উপস্থাপন করতে চান তারা কি উপরোল্লেখিত লেখক, গবেষক, পলিটিশান ও মহামনীষীদের তুল্যমূল্যে এতটুকু অগ্রগণ্য? কখনোই না। অতএব অখ্যাত অজ্ঞেয় কোনো বিরূপ সমালোচকের আজেবাজে কথায় একজন সত্যিকারের নবীপ্রেমী কখনোই তেতে ওঠতে পারে না। বরং যে ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার পরাকাষ্ঠা আমাদেরকে নবীজী শিখিয়েছেন সেটাই হোক আমাদের অনন্য বাতিঘর, অতুল্য আলোকবর্তিকা।

আজ আমাদের ধর্মপুরুষ পবিত্রমানব ও সবার কামলীওয়ালা মুহাম্মদ মোস্তফা(সা.) এর শুভ জন্মদিনে কবি কাজী নজরুল ইসলাম আমার মন ও মননে নবী প্রশস্তির সুর হয়ে বাজছেন।

ক. 
মোহাম্মদ নাম জপেছিলি বুলবুলি তুই আগে।
তাই কি রে তোর কন্ঠের গান এমন মধুর লাগে।।
ওরে গোলাব নিরিবিলি
(বুঝি) নবীর কদম ছুঁইয়েছিলি
(তাই) তাঁর কদমের খোশবু আজ ও তোর আতরে জাগে।।

মোর নবীরে লুকিয়ে দেখে
তাঁর পেশানীর জ্যোতি মেখে
ওরে ও চাঁদ, রাঙ্গলী কি তুই গভীর অনুরাগে।।

ওরে ভ্রমর, তুই কি প্রথম
চুমেছিলি নবীর কদম,
আজও গুনগুনিয়ে সেই খুশী কি জানাস রে গুলবাগে।

খ.
হেরা হ’তে হেলে দুলে
নুরানী তনু ও কে আসে, হায়!
সারা দুনিয়ার হেরেমের পর্দা
খুলে খুলে যায়-
সে যে আমার কামলিওয়ালা
কামলিওয়ালা।।

তার ভাবে বিভোল রাঙা পায়ের তলে
পর্বত জঙ্গল টলমল টলে,
খোরমা খেজুর বাদাম জাফরানী ফুল
ঝ’রে ঝ’রে যায়।।
সে যে আমার কামলিওয়ালা
কামলিওয়ালা।।

আসমানে মেঘ চলে ছায়া দিতে,
পাহাড়ের অঁসু গলে ঝর্ণার পানিতে,
বিজলী চায় মালা হ’তে
পূর্ণিমা চাঁদ তাঁর মুকুট হ’তে চায়।
সে যে আমার কামলীওয়ালা
কামলিওয়ালা।।

..............
তথ্যসূত্র:
দ্য ডেইলি স্টার
প্রথম আলো
বাংলাদেশ প্রতিদিন
বিবিসি
বিশ্বের সেরা ১০০ মনীষী-মাইকেল এইচ হার্ট
সিরাতুন্নবী(সা.)
কবি কাজী নজরুল ইসলাম

পবিত্র কুরআন শরীফ

............................
লেখক: সাংবাদিক

*লেখাটির রচনাকাল: ২০ অক্টোবর ২০২১ | ১২ রবিউল আউয়াল ১৪৪৩

Comments

    Please login to post comment. Login