পোস্টস

ফিকশন

ডায়োনাইসিস

৭ মে ২০২৪

ফারহান আবিদ

মূল লেখক ফারহান আবিদ

- ভাই বেনসন হইবো? 
- না। 
- কি হইবো?
- গোল্ডলিফ, নেভি...
- হইছে দেন, একটা গোল্ডলিফ দেন। 
নিজেকে অনেকটা অপ্রতিরোধ্য রাবণের মত ভাবতে ভাবতে আলেক এগিয়ে যায় মধ্যরাতের শহরতলীর গলিপথে। সে জানে কোথায় যাবে, কোথায় যেতে হবে। কেমন করে যাবে সেটা বোঝার মত অবস্থায় কতটুকু আছে সেটা বোঝা যাচ্ছে না। এখান থেকে ভরা জ্যামের সময়ে আলেকের বাসায় যেতে ২/৩ ঘন্টা লেগে যায়। এখন বাজে রাত ১২:৪৫। যেতে অস্বাভাবিক কম সময় লাগবে ঠিক। কিন্তু কেমন করে যাবে সেটা ঘুণাক্ষরেও বুঝে উঠতে পারছে না। এই গলিপথ বেয়ে কতক্ষণে মেইনরোড পৌঁছবে, আলেকের এই মূহুর্তের অবস্থা সেই হিসাবটুকুও করতে পারছে না। অনিয়মিত শ্বাসের ওঠানামার সাথে টেনশন মিলে কেমন একটা দলা পাকানো ঘাম ক্রমাগত মগজ পর্যন্ত ভিজিয়ে দিচ্ছে। গোল্ডলিফটা শেষের দিকে। আরো সিগারেট নেবার বুদ্ধি তখন মাথায় কাজ করেনি। এখন আর আশেপাশে সিগারেটের দোকানের টিকি পর্যন্ত নেই। আরও টেনশন নিয়ে টলতে টলতে অবশেষে মেইন রোডের দেখা পেল। না, মেইনরোড না এটা সার্ভিস রোড। আলেকের মাথা খুব কম কাজ করছে। শেয়ারের সিএনজি দেখে উঠেই পড়ছিল। কি মনে করে প্রশ্ন করল,
- কোন দিকে যাইবো?
- কাঠের পুল
- বাসস্ট্যান্ড যাইবো না?
- না
অগত্যা হাইওয়ে পার হওয়ে আসলো। সিএনজি দাঁড়ানো আছে একটা। লোক ডাকছে। আলেকের সিগারেট টা এখন আবার জরুরি হয়ে পড়ল, দোকানের দেখা পেয়ে। কয়েকটা কিনে নিল। সিএনজিটা তখনও ডাকছে।
- বাসস্ট্যান্ড যাইবো না?
ভাবখানা এমন যেন প্রতিদিন এই সময়ে সে এখান থেকেই বাড়ি ফেরে। 
- হ যাইবো
আলেক উঠে পড়ে। গরম-বৃষ্টির এই সময়টাতে অসহিষ্ণু রাতগুলো ওর ভাল লাগে। বাতাসে কেমন একটা পৃথিবীর সব প্রেম জিতে যাওয়ার আনন্দ। আকাশে সেই আনন্দের ক্ষণে ক্ষণে পুড়ে ওঠা বাজি। যখন মন চায় এক মিলি সেকেন্ড অথবা মাইক্রো সেকেন্ডের জন্য পৃথিবীকে দেখিয়ে দেয়া যায় তার যাবতীয় অন্ধকার অথবা কদর্যতা। হাইওয়ের বাতাস, বাতাসের চুল ছুঁয়ে যাওয়া, বন্ধ চোখে মূহুর্তের মোক্ষ লাভের আশ, এসবই আলেকের বুকের ভেতর পর্যন্ত ছুঁয়ে যায়। ও ভাবতে থাকে ঠিক এই মূহুর্তে যদি সব ছেড়ে চলে যেতে পারতো ওর মত সুখী আর কেউ হত না। অথচ পৃথিবী জানে বাড়িতে ওর পানে চেয়ে আছে দুই জোড়া চোখ। আলেকের কলিজা ছেঁড়া মেয়ে জয়িতা আর চোখের মণি বউ সুপ্রিয়া।
বাসস্ট্যান্ডে নেমে পাগলের মত বাস খুঁজতে থাকে। এত রাতে বাসের সংখ্যা নগণ্য, তাও আবার ঐ একটা রুটের বাস। এদিকে ওর শরীর সায় দিতে চাচ্ছে না। তার উপর সেরের উপর সোয়া সের সেই টেনশন। চোখ বন্ধ হয়ে আসতে চাচ্ছে। অথচ এই চোখ বন্ধ হয়ে আসা আলেকের কত প্রিয়! বউকে বলতো,
- সোনা, আমি আর অন্য কোন খানে যাবো না, অন্য কিছু করব না। মাঝেমাঝে অমন চোখ বুঁজে বুঁজে আসবে। আমি তোমার কোলে এসে শুইয়া পড়বো। আমারে ঘুম পাড়ায়া দিতে হইবো না! খালি তোমার কোলে ভাসান দিয়া রাইখো! 
আলেক একটা ঘোরের ভেতর দিয়ে কুড়িল-বনানী-কাকরাইল পার হয়ে যায়। বাস থেকে কিভাবে নামলো মনে করতে পারে না। মেইন রোড থেকে অল্প হাঁটা পথ ওর বাসা। কানাগলির শেষ মাথায়। আলেক সমস্ত শরীরের আশা-স্বপ্ন সব দিয়ে কলিংবেল বাজায়। আবার বাজায়। সুপ্রিয়া আসছে আলেক বুঝতে পারে। ওর মনে হয় পৃথিবী বুঝি মাত্র সৃষ্টি হল! ওর মনে হয় সুপ্রিয়া দরোজাটা খুললেই আলেক ওর কৃতকর্মের থেকে অনেক নিরাপদ আরেকটা নতুন পৃথিবীতে চলে যাবে। আলেকের মুখে অনেকক্ষণ পর একটু ধবধবে আলো পড়ল। কি সুন্দর চোখ জোড়া নিয়ে সুপ্রিয়া তাকিয়ে আছে। যেন নতুন করে একটা গোটা জীবনের গল্প বলতে চাচ্ছে আলেককে। পরক্ষণেই আলেকের বন্ধ হয়ে আসতে থাকা চোখ জয়িতাকে খোঁজা শুরু করে। সুপ্রিয়া আলেককে কোন রকম স্পর্শ করার সাথে সাথে তড়িতাহতের মত পড়ে যেতে লাগল। কিন্তু মনের ভেতর ও সংকল্পবদ্ধ জয়িতাকে ওর ছুঁতে হবেই। ঐ তো ঘরের দরজায় জয়িতা।
- জয়ি মা, বাবানের কাছে আয়!
জয়িতার শুধু ছায়াটা এগোতে থাকে। আলেক তাই দেখে। 
জয়িতার দুই হাতের আঁজলায় আলেকের মুখটা। সুপ্রিয়া কিংবা জয়িতা কারোর ডাকের সাড়া দিচ্ছে না আলেক। ওর মাথায় এখন হাইওয়ের অসহিষ্ণু রাতের বাতাস। এ এক পরম শান্তি।
শুধু একটা আক্ষেপ মনে,
- গ্লাসটা হাত বাড়িয়ে নেবার সময় যদি একবার বুঝতে পেতাম! 

ডায়োনাইসিস