পোস্টস

চিন্তা

বাংলাদেশের নবজাগরণ পৃথিবীময় ছড়াতে মব-জাস্টিস ঠেকানো ফরজ

২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪

শাহাদাত সুফল - Shahadat Supol

মব জাস্টিসকে জাঙ্গল জাস্টিসও বলা হয়ে থাকে, যার মাধ্যমে এক্সট্রা জুডিশিয়াল কিলিং পর্যন্ত ঘটে। এটি কোনো সভ্য সমাজের কাজ হতে পারে না। আইনের ভাষায়ও এটি স্রেফ অবৈধ নয়, জঘন্য কাজও বটে। পরিবর্তন মানে কেবল কিছু মানুষকে সরিয়ে অন্যকিছু মানুষকে জায়গা করে দেয়া নয়। বরং কাজ ও কাজের ধরণের, এবং সেগুলোর ব্যবস্থার পরিবর্তনও বৈকি। 

 

কেউ যদি কোনো সুনির্দিষ্ট অপরাধ করে থাকে, তার জন্যে আইন আছে, আদালত আছে। রাষ্ট্রের ফৌজদারী কার্যবিধি ও দণ্ডবিধিসহ অন্যান্য প্রাসঙ্গিক আইনানুযায়ী তার বিচার হবে। আপনি আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া মানে আদালত অবমাননা করা, এবং এগজিস্টিং আইনী কাঠামোর দিকে বৃদ্ধাঙ্গুলী উড্ডীন করার শামিল বৈ অন্যকিছু নয়।

 

সংস্কারের জন্যে আলোচনা কিংবা গঠনমূলক সমালোচনা হতেই পারে, এবং তা জারী রাখাটাও জরুরি। এবং তা করাটা সময়ের ফরজ কাজ বললেও অত্যুক্তি হবে না। কিন্তু আপনি সেই ফরজ কাজ করতে গিয়ে হারাম কাজ করতে পারেন না। 

 

আইনী পরিভাষায় একটা ম্যাক্সিম আছে- "every person must be presumed innocent until proven guilty". এর মানে হলো এই যে, আদালতের কার্যবিধি অনুসারে আপনি একজন অভিযুক্ত ব্যক্তিকে তখনই অপরাধী বলতে পারবেন, যখন আদালত রায়ের মাধ্যমে উক্ত ব্যক্তিকে অপরাধী শনাক্ত করবেন, এবং ঘোষণা করবেন। তার পুর্বে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আপনি শুধুই "নিষ্পাপ অভিযুক্ত" হিশেবেই অভিহিত করতে পারেন। 

 

একটি দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রাম ও রক্তীম রাজপথের কণ্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দেবার মধ্য দিয়ে যে মুক্তির দিশা আমরা দেখেছি গত ৫-ই আগষ্ট, তা হেলায় হারালে চলবে না। এমন সুযোগ জাতীয় জীবনে পাবার জন্যে যুগ-যুগ অপেক্ষা করতে হয়। এই ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ফলে যে অপেক্ষার প্রহর ভাঙলো, এই প্রহরকেই কাজে লাগাতে হবে- সর্বোতভাবে যৌথ-প্রচেষ্টায়। 

 

যারা এমন সোনালী সময়কে নস্যাৎ করবার জন্যে নটোরিয়াস মব জাস্টিসের এন্তেজাম করছে, তাদের সচেতনতার সহিত প্রতিরোধ করতে হবে। আমরা আমাদের দেশে কোনো হিংস্রতাকে স্থান দিতে প্রস্তুত নই। একটি উদার মানবিক বাংলাদেশ আমাদের আকাঙ্খা। এই আকাঙ্খা বাস্তবায়নে যারা কাজ করতে প্রস্তুত, শুধু তারাই বিরাজ করবে, এবং বাকীদের কিভাবে রিকনসিলিয়েশন করা যায়, সেদিকে গুরুত্বের সহিত নজর দিতে হবে। 

 

আপনাদের ভুলে গেলে চলবে না- রাষ্ট্র সবার, আপনার একার না। এই রাষ্ট্রে আপনার মতের মানুষ যেমন থাকবে, আপনার বিরোধীরাও বসবাস করবে। সবাই রাষ্ট্রের নাগরিক। রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের আইনের সম্মুখে দন্ডায়মান সবাই ষোলোআনার অধিকারী। কেউ বারো আনা কিংবা তারচেয়ে কম কিংবা বেশি কিছু পাবার এখতিয়ার রাখেন না। 

 

এমন অস্বাভাবিক সময়ে লেখাটি লিখতে হচ্ছে, যখন রাষ্ট্রের আমূল পরিবর্তন কিংবা সংস্কারের কাজ চলমান। তবু নাগরিক হিশেবে আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে- বাতিলের পূর্বে যা কিছু অবশিষ্ট থাকে, তা পরম মান্য। আপনি যদি নিজেকে তার উর্ধ্বে মনে করেন, তবে বোঝা যাবে আইনের শাসনের প্রতি আপনি অঙ্গিকারবদ্ধ নন। 

 

সেই কৈফিয়ত দিয়েই ৭২'র সংবিধানের অনুচ্ছেদ-২৭'র ভাষ্য ধার করছি। অনুচ্ছেদ-২৭ বলছে, "All citizens are equal before law and are entitled to equal protection of law". বাংলায়- "সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী"। তারমানে হলো- যিনি বা যারাই এই রাষ্ট্রের নাগরিক হবেন, তারাই বিদ্দমান আইনের দৃষ্টিতে সমান হিশেবে বিবেচিত হবেন, এবং আইন তাদের সমভাবে আশ্রয় ও নিরাপত্তা প্রদান করবে। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র কিংবা জাত-পাত নির্বিশেষে প্রত্যেক নাগরিক সমভাবে স্বীকৃত হবেন। কেউ কারো ধর্মীয়, গোত্রীয়, বর্ণীয়, এবং রাজনৈতিক পরিচয়ের দরুন ভিন্নভাবে স্বীকৃত হবেন না। সমান মানে সমান। 

 

এবং এই একই সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, "আমরা যাহাতে স্বাধীন সত্তায় সমৃদ্ধি লাভ করিতে পারি এবং মানবজাতির প্রগতিশীল আশা-আকাঙ্খার সহিত সঙ্গতি রক্ষা করিয়া আন্তর্জাতিক শান্তি ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে পূর্ণ ভূমিকা পালন করিতে পারি, সেইজন্য বাংলাদেশের জনগণের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তিস্বরূপ এই সংবিধানের প্রাধান্য অক্ষুণ্ন রাখা এবং ইহার রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তাবিধান আমাদের পবিত্র কর্তব্য"; সুতরাং নাগরিক হিশেবে আপনারই নয় শুধু আমাদের সবার পবিত্র দায়িত্ব হলো- সংবিধানানুযায়ী আপনি যে কেবল মৌলিক অধিকারের সুবিধা ভোগ করবেন, তা নয়; আপনার কিছু পবিত্র দায়িত্বও বর্ণিত হয়েছে এই সংবিধানে। সুনাগরিক হিশেবে আপনি তা মানতে সাংবিধানিক আইনানুযায়ী স্বীকৃত। এখন আপনি যদি তা না মানেন, তবে বিশ্বাসঘাতকতা হিশেবে চিহ্নিত হতে পারে আপনার কর্মকান্ড। 

 

বলে রাখা ভালো, আইন দিয়ে ধরে বেঁধে নীতিগত জায়গা পরিবর্তন সম্ভব নয় সবসময়। চর্চা সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ। এজন্যে আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসের নাম- প্রথা। ইউরোপ আমেরিকায় লিখিত আইনের চেয়ে কাস্টোমারি ল কিংবা প্রথাগত আইনের সিগনিফিক্যান্স নজরে পড়ে সবচেয়ে বেশি। সেজন্যে আইনের প্রতি নাগরিকের মান্যতা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই মান্যতা কিভাবে ডেভেলপ করা যাবে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে আমাদের। আর সেজন্যেই আইনী কাঠামো পরিবর্তনের পাশাপাশি মনস্তাত্ত্বিক পরিকাঠামোর পরিবর্তন কিংবা পরিবর্ধন ফরজে পরিণত হয়েছে রীতিমতো। 

আমাদের মনে রাখতে হবে, আমূল পরিবর্তন মানে অবকাঠামো কিংবা পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন কেবল নয়, ইন্ডিভিজুয়ালের মনস্তাত্ত্বিক জায়গা এবং কালেক্টিভ ফ্যাসিজমের পাশাপাশি ইন্ডিভিজুয়ালের ফ্যাসিজমেরও মূলোৎপাটন করতে হবে। এবং পতিত স্বৈরশাসকের স্থান অন্যজন এসে দখল করতেও কার্পণ্য করবে না, যদি না এসব আইন বহির্ভূত কার্যকলাপ বন্ধ হয়, মব জাস্টিস কিংবা জাঙ্গল জাস্টিস বন্ধ হয়, এবং পরিশেষে একদল মানবিক দায়িত্বশীল শাসকের আবির্ভাব এবং মানবিক, মর্যাদাবান ও দায়িত্বশীল নাগরিকের উত্থান ঘটে; এবং তার মাধ্যমেই আমরা পেতে পারি একটি উদার মানবিক মর্যাদাবীরোচিত রাষ্ট্র- বাংলাদেশ, যার নবজাগরণের ছোঁয়া ছড়াতে পারি তাবৎ পৃথিবীময়।

 

শাহাদাত সুফল 

কবি ও সংবিধান গবেষক