Posts

চিন্তা

ব্যাঙে দৌড়ায় সাপের পাল

September 21, 2024

ফারদিন ফেরদৌস

81
View

গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব হানিফ সংকেত পরিচালিত ইত্যাদির জুলাই ২০০৫ পর্বে পপগুরু আজম খান মকবুলের কথায় নিজের সুরে 'সময় এখন বর্ষাকাল' শিরোনামে একটি সংগীত পরিবেশন করেছিলেন। গানের কথাগুলো ছিল এমন...

সময় এখন বর্ষাকাল 
হরিণ খামচায় বাঘের গাল
একি হইল দুনিয়ার হাল
ব্যাঙে দৌড়ায় সাপের পাল
হায়রে হায় কী কপাল
উপরে খুঁটা নিচে চাল

হায়রে হায় মহাকাল
একে বলে কলিকাল
হায়রে হায় ভাটি কাল 
নদী শুকায় হইল খাল

নাহ্! বাংলাদেশে এখন বর্ষাকাল নয়। পুরাই শরৎকাল। তারপরও বর্ষার আবহই যেন চলছে চারিধারে। ঠিক পপসম্রাটের ওই গানের মতো।

জানবাজি লড়াই করে শেখ হাসিনা রেজিমকে হারিয়ে দিয়েছে সম্মিলিত ছাত্র-জনতা। দীর্ঘ ১৫ বছরে কোনো‌ রাজনৈতিক দল যেটা পারেনি সেটি করে দেখিয়েছে অরাজনৈতিক তারুণ্য। মুক্তপ্রাণ ওই তরুণেরা এখন অজ্ঞাত কারণে বাংলা গান বাদ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রেমিজ, বড় হলরুম কিংবা মহল্লার কোনো উন্মুক্ত মঞ্চে 'কাওয়ালি' গেয়ে বেড়াচ্ছে। ওই পরিবেশনাগুলোতে তারা নানা কিসিমের কৌতুক নকশাও রাখছে। লাস্ট রেজিমের ক্ষমতাধর উচ্ছিষ্টভোগীদের প্রটোটাইপ মঞ্চে হাজির করে লাত্থিগোতাও দিচ্ছে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত দর্শকরা বাহ্বা দিচ্ছে। আনন্দ ও বিনোদন পাওয়ার স্বাধীনতা সবার আছে।

এতে অবশ্য একটা শ্রেণী বিরাট উষ্মা প্রকাশ করছেন। কেনরে ভাই, কাওয়ালি ধ্রুপদী সংগীতের উৎকৃষ্ট ঘরাণা, সেটি গাইলে সমস্যা থাকবে কেন? আবার যখন জেমস-হাসানরা তাদের মুডে ফিরবেন তারাও মন দিয়ে বাংলা গান গাইবেন। আমরা মন দিয়ে শুনব।

তবে হ্যা, বাংলাদেশে প্রমিনেন্ট কোনো কাওয়ালি শিল্পী আছেন? কাওয়ালির নাম নিয়ে যাতা গছিয়ে দিলে দর্শক শ্রোতারাই একদিন হুজুগে শিল্পীদের ফাঁক ধরে ফেলে বাতিলের খাতায় রেখে দেবে।

যারা বাংলাকে পশ্চাতে রেখে কাওয়ালি গেয়ে বর্ষাকাল নামিয়ে দিচ্ছেন তারা নিশ্চয়ই জানেন, দিল্লির পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বসবাসকারী কাওয়াল নামক যাযাবর সম্প্রদায় কর্তৃক গীত সাধারণ ভক্তিমূলক গানকে কাওয়ালি বলে চিহ্নিত করা হয়।

দিল্লির সুফি সাধক আমির খসরু, যিনি চিশতিয়া তরিকার একজন সাধু ছিলেন, ১৩শ শতকের শেষভাগে ভারতীয়, পার্সিয়ান, আরবি, তুর্কি এবং ভারতীয় ঐতিহ্যের মিশ্রণ ঘটিয়ে আজকের কাওয়ালি সংগীত তৈরি করেন যা পরবর্তীতে সুফি মাজার বা দরগাহ'র মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ায় বিকাশলাভ করে। কাওয়ালি গানের সাথে সুফি সাধনা, মাজার, দরগাহ ওতপ্রোতভাবে সংশ্লিষ্ট। যারা কাওয়ালিতে মজে আছেন, তারা ঢালাওভাবে মাজার ভাঙার প্রতিবাদ বা নিন্দা করছেন না কেন? যেহেতু আপনাদের মধ্যে একধরনের দ্বিচারিতা জিইয়ে রেখেছেন, তাই আপনাদের কাওয়ালি সর্বজনের শ্রুতিগ্রাহ্য হয় না।

আশুতোষ গোয়ারিকর পরিচালিত ২০০৮ সালের ভারতীয় মুভি যোধা আকবরে এ আর রেহমানের কন্ঠে গাওয়া 'খাজা মেরে খাজা' কাওয়ালির আধুনিক ভার্সনের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ।

এদিকে রেডিওতে বহির্বিশ্ব সার্ভিসে উর্দু প্রোগ্রাম চালু করা নিয়েও নানা আলোচনা হচ্ছে। আমরা মনে করি, বাংলাদেশি সংস্কৃতির আন্তর্জাতিকীকরণ খারাপ কিছু নয়। উর্দু ভাষা আমাদের অপছন্দ নয়। আমাদের পূর্বপুরুষেরা এই ভাষাটিতে অভ্যস্ত ছিলেন। এখনো মেহেদি হাসানের গাওয়া উর্দু ভাষার গজল 'রাফতা রাফতা ও মেরি' এবং ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলীর গাওয়া 'চুপকে চুপকে রাত দিন আঁসু বহানা ইয়াদ আয়ে' শুনলে হৃদয় আর্দ্র হয়। চোখ ঝাপসা হয়। ধ্রুপদী এসব উর্দু গান যদি উচ্চাঙ্গসংগীতের 'উ' না জানা মাহফুজুর রহমানদের মতো দেখনদারি শিল্পীরা গায় সেটি হয় আজম খানের কলিকাল। সাপের পালকে ব্যাঙে দৌড়ালে সিস্টেম কলাপ্স করে। 

এখন হয়ত কিছুদিনের জন্য নদী শুকিয়ে খাল হয়ে যাচ্ছে। আবার একদিন ভরা জোয়ারে মাতবে বাংলাদেশের আসল স্রোতস্বিনী। আশা আমাদের একমাত্র ভেলা।

লেখক: সাংবাদিক
২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪

Comments

    Please login to post comment. Login