Posts

চিন্তা

জীবন দিয়ে আমাদেরকে মানুষ চিনিয়ে গেলেন তোফাজ্জল

September 23, 2024

ফারদিন ফেরদৌস

61
View

ব্যাপারটি খুব রিডিকুলাস যে মানুষ নিজেই নিজেকে আশরাফুল মাখলুকাত ঠাওর করে। মানুষ কি আসলেই তাই? এক মিনিটে সাড়ে ৭ লিটার বায়ু সেবন করা ছাড়া মানুষের জীবন বাঁচে না। এই বায়ুর কাছে মানুষের যে ঋণ তা শোধ করবার মতো নয়। বাতাসের বেঁচে থাকতে মানুষ লাগে না। প্রকৃতির কাছে এমনতর হাজারো ঋণ অক্ষম মানুষের। তার অহংকার এতটুকু সাজে না।

সংখ্যায় কম হলেও মহানুভব মানুষ আছে। তবে একশ্রেণীর মানুষের ক্রিয়াকর্ম এতটাই নিম্নস্তরের যে তাকে আর শ্রেষ্ঠত্বের পদবাচ্যে অভিষিক্ত করা যায় না। মানুষ তার কর্মদোষে মনুষ্যত্ব হারায় কেন? মবের মুল্লুকে নিজেই হয়ে ওঠে একাধারে পুলিশ, কাজী ও জল্লাদ।

আমরা সখেদে খুব বলতে পারি আগে মানুষ হয়ে দেখান। কিন্তু নিজে মানুষ হয়ে উঠবার মন্ত্রণা কি কোথাও পাচ্ছি? সুস্থির পাবলিক কেন মব হয়ে ওঠে, এর মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক কারণ কি, সেটা আমরা ভেবে দেখেছি কি? ভাবতে হবে বৈকি।

যে সন্তানেরা নির্বিরোধ ও নির্দোষ তোফাজ্জলকে অমানবিক নির্যাতন করে প্রাণটা কেড়ে নিয়েছে ওরাও আমাদেরই সন্তান। ওদের মা, বাবা ও স্বজন আছে। ঠিক তাদের জায়গায় দাঁড়িয়ে হন্তারকদের মনস্তত্ত্ব নিয়ে কথা বলতে হবে সবার। কারা ওদেরকে এমন একটা জায়গায় পৌঁছে দিল? কেন দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থীদের হৃদয়ে মায়া জন্মাল না। ভালোবাসা, বোধ ও বিবেকে কেন গঠিত হলো না ওদের মগজ?
মানুষের জীবন কি আসলেই এত সস্তা? মায়ের গর্ভে কোটি জীবনের সাথে সংগ্রাম করে বিজয়ী যে জীবন পৃথিবীর আলো বাতাস দেখে সেই জীবনের দাম এতটাই নগণ্য? মানুষ হয়ে মানুষের প্রতি এতটা নিপীড়নের উদাহরণ তৈরি করতে আছে?

আমরা এলিজি ফর তোফাজ্জল এভাবে লিখতে পারি...
হে ফজলুল হক মুসলিম হলবাসী, 
আপনাদের অন্নসেবায় আলহামদুলিল্লাহ্ পড়েছিলেন তৃপ্ত তোফাজ্জল।

আপনাদের অসম্মান, অপমান, মারধর ও বিচিত্র উপায়ে শারীরিক নিগ্রহেও অখুশি ছিলেন না। যার জীবনটা নানান দুঃখ-জরায় তামা তামা তার আসলে বেদনাহত হওয়ার এতটুকু সুযোগ নাই।

তোফাজ্জল বরিশাল বিএম কলেজ থেকে বাংলা বিষয়ে অনার্স মাস্টার্স শেষ করে বঙ্গবন্ধু ল’ কলেজে অধ্যায়নরত ছিলেন। জীবনের যাতাকলে পড়ে আইন অধ্যয়ন শেষ করতে পারেননি। হে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়বাসী এলিটমহল আপনারা তাকে আইনের চরম রূপ দেখিয়ে দিয়েছেন।

বাবা আবদুর রহমান মোটরসাইকেল দূর্ঘটনায় মারা গেলে তোফাজ্জল নিরাশ্রয় হন। সীমাহীন কষ্ট বয়ে বেড়ানো পিতৃহীন তোফাজ্জলকে আগলে রাখেন তার বড়ভাই নাসির, যিনি পুলিশ অফিসার ছিলেন। দূরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে বড়ভাই নাসিরও মারা যায়! পরম মমতা ও ভরসার আশ্রয়স্থল মাও প্রয়াত হলেন। তার প্রেম ছিল স্থানীয় চেয়ারম্যানের কন্যার সাথে,জীবনের শেষ ভরসা ওই প্রেমিকারও বিয়ে হয়ে গেল অন্যত্র। এত কষ্ট যিনি বুকে বয়ে বেড়াতেন তাকে আর কীসের কষ্ট দেবেন আপনারা?

জীবন্মৃত একজন অসহায় মানুষের প্রতি শেষ খাবার খাওয়ানোর করুণা দেখিয়েছেন। 
পৃথিবীর তাবৎ ইতিহাসে দয়াবান আপনাদের নাম অঙ্কিত থাকবে।

অতঃপর তোফাজ্জলের জীবনের সমুদয় কষ্ট নিমিষে দূর করে দিয়েছেন। জীবন থেকে সরিয়ে দিয়েছেন। বুকে বয়ে বেড়ানো বাংলাদেশের ভার থেকে চিরতরে মুক্ত করেছেন।

পিটিয়ে হাড়গোড় ভেঙেছেন, তাজা মাংসে লাইটার জ্বালিয়ে আগুন ধরিয়েছেন, রডে হাত বেঁধে ফ্লোরে পিষেছেন, জখমে জর্জরিত শরীরে ইচ্ছেমতো লাত্থি দিয়ে মানুষ নামের কলঙ্ক বাড়িয়েছেন। দিনমান ক্রমাগত নিপীড়নের কালে প্রশাসন নির্বিকার থেকেছে। তারপরও বিশ্বাস করি, জালিমের হাতে শত জুলুম সয়েও মজলুম তোফাজ্জল আপনাদেরকে অভিশাপ দিতেন না। অচলায়তনের স্বঘোষিত মাস্টার আপনাদের মতো এলিটদের সাথে প্রান্তজন তোফাজ্জলের পার্থক্য এটাই। পাথরঘাটার সরল মানুষ তোফাজ্জলের জন্য 
আমরাও পড়লাম শোকর আলহামদুলিল্লাহ্! মহামহিম ঈশ্বরের কাছে তাঁর শান্তির জীবন নির্ধারিত হয়েছে।

অনেক মেধার পরীক্ষা দিয়ে তবে একজন শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয়ে নাম লেখাতে হয়। মনুষ্যত্বের পরীক্ষা নেয়ার কোনো পদ্ধতি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো রাখেনি। এমনকি মনুষ্যত্ব ও দায়বোধ শেখানোর কোনো কোর্সও ডিজাইন করে না বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। সাম্প্রতিককালে বিশ্ববিদ্যালয় নামের অচলায়তনে একজন শিক্ষার্থীর মানসিক বিকাশের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ বিনির্মাণে কাউকে ভূমিকা রাখতে দেখিনি।

রক্ষক্ষয়ী গণ-আন্দোলনের পর মানুষের Sense of power বা ক্ষমতাবোধ সীমা ছাড়িয়ে গেছে। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, জনতাভুক্ত ব্যক্তিরা নিজেদেরকে অসীম ক্ষমতার অধিকারী মনে করে। তাদের অসাধ্য কিছু নেই ৷ তাদের বাঁধা দিতে পারে এমন কোন শক্তিও তারা স্বীকার করে না৷ এটাকেই আমরা বলছি মব কালচার। যারা নিরস্ত্র হয়েও সশস্ত্র কোনো শৃঙ্খলাবাহিনীর সামনে বুকচিতিয়ে দাঁড়াতে পারে।

ফরাসি নৃবিজ্ঞানী চার্লস-মারি গুস্তাভ লে বন, তাঁর লেখা 'দ্য ক্রাউড: এ স্টাডি অব দ্য ক্রাউড মাইন্ড' গ্রন্থে দেখিয়েছেন, জনতার মাঝে ব্যক্তিসত্ত্বার বিলুপ্তি ঘটে এবং বাক্তি জনতার মাঝে হারিয়ে যায়। এভাবে জনতার একটি ‘সম্মিলিত মন’ গড়ে ওঠে যা ‘ব্যক্তি মন’ হতে সম্পূর্ণ আলাদা। কার্যত জনতার মাঝে আর ব্যক্তি সংযম থাকে না। এমতাবস্থায় ব্যক্তি এমন সব কাজ করতে পারে যা অন্য অবস্থায় তার একার পক্ষে কখনই করা সম্ভব নয়। এমন পরিস্থিতির ইতিবাচক দিক আমরা জুলাই বিপ্লবে দেখেছি। দীর্ঘদিনের আধিপত্যবাদী শক্তিকে এই 'সম্মিলিত মন' উৎকার করতে পেরেছে।

কিন্তু সমস্যাটি দেখা দিয়েছে বিপ্লবোত্তর শান্তিকালীন সময়ে। মব এখন পরাজিত শক্তির শাস্তি নিজেরাই নিশ্চিত করতে চাইছে।

জেনেভা কনভেনশন' বলে বিশ্বস্বীকৃত রুলস আছে। জেনেভা কনভেনশনে ব্যাপকভাবে যুদ্ধকালীন বন্দী, বেসামরিক এবং সামরিক কর্মীদের মৌলিক অধিকার সংজ্ঞায়িত করে; আহত এবং অসুস্থদের জন্য সুরক্ষা স্থাপন; এবং যুদ্ধক্ষেত্রে এবং তার আশেপাশে বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা প্রদান করে।

যুদ্ধের ফলাফল ডিসাইডেড হওয়ার পর যুদ্ধে পরাজিত শক্তিকে মেরে ফেলবার রীতি কোনো সভ্য সমাজেই নেই।

লাস্ট রেজিমের অংশীদার হিসেবে জুলাই জেনোসাইডের দায় ছাত্রলীগ এড়াতে পারবে না। তাদের অনেকেই সাধারণ শিক্ষার্থী ওপর হামলা করেছে, ক্ষেত্রবিশেষে বেপরোয়া পুলিশের সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে। দোষ প্রমাণিত হলে তাদেরকে বিচারিক সাজা দেয়ার আইন দেশে আছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো মবলিঞ্চিং কোথাও কোনো সুসভ্যতা নিশ্চিত করবে না।

এরমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাটি একেবারেই ব্যতিক্রম। তোফাজ্জল রাজনৈতিক শক্তিধর কোনো ব্যক্তি তো নয়ই, এমনকি নিয়তির লিখনে পারিবারিক যাতাকলে পড়ে স্বাভাবিক চিন্তাশক্তিও রহিত হয়েছিল তাঁর। এমন মানুষ কারো শত্রু হতে পারে আমরা কেউ বিশ্বাস করি না। তারপরও তাঁকে কেন মেরে ফেলল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্মত্ত ছাত্ররা? এখানেই আসবে ওই মব কালচারে অভ্যস্ত হয়ে পড়বার ভয়াবহ ত্রুটি।

প্রথম আলো 'মব জাস্টিসে'র বাংলা করেছে বিশৃঙ্খল জনতার বিচার। আমাদের ডিএনএ'তে সুদূর অতীত থেকেই বিশৃঙ্খলপনার বীজ রোপিত আছে এতে সন্দেহ নাই। যুগে যুগে যেসব গ্লোবাল রোবাররা আমাদেরকে শাসন ও শোষণ করেছে আমাদের কোমল জমিনে তাদের বুনা বীজ আমরা অস্বীকার করতে পারব না। ওই দোষ কাটানোর জন্যই তো এখনকার সভ্য সমাজে বিশ্ববিদ্যালয়, ইশকুল-কলেজ, মাদ্রাসা খোলা হয়েছে। যাতে আমরা সভ্য মানুষ হয়ে হিতবাদী সভ্যতার মশাল জ্বালিয়ে রাখতে পারি।

এখন প্রশ্ন আসবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা দেশের অপরাপর বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা অন্যান্য শিক্ষায়তন ছেলেমেয়েদেরকে সঠিক পথের দিশা দিতে পারছে? এককথায় উত্তর হলো 'না।' শেখ হাসিনা সরকারের আমলে বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য থেকে শুরু করে শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীয়নিয়োগ দেয়া হয়েছে স্বজনপ্রীতি ও দলীয় লেজুড়বৃত্তির পারঙ্গমতার ওপর বেসিস করে। একাডেমিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক যোগ্যতাকে কোথাও প্রাধান্য দেয়া হয়নি। যে প্রশাসক নিজেই অক্ষম ও অযোগ্য তারা শিক্ষার্থীদেরকে যথোচিত কালচার শেখাতে পারবে না। তার ওপর দলদাস ছাত্রলীগকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর ছড়ি ঘোরানোর অবাধ লাইসেন্স যেভাবে উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছিল, সেখানে ভালোমানুষিতার আবাদ হওয়া অসম্ভব। ছাত্রলীগ নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, নিয়োগ বাণিজ্য, অস্ত্রবাজি, মাদকের কারবার ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর নানান কিসিমের নির্যাতন জিইয়ে রেখেছিল। খুনোখুনির অনাচার দিয়ে নিজেদের ক্ষমতা জাহির করত ওরা। এমন এক বাস্তবতায় কোনো সাধারণ ছাত্রের পক্ষে চাইলেও ভালো থাকা সম্ভব? অবশ্যই না। দলমত নির্বিশেষে যারা ছাত্রলীগে নাম লেখাতো তারাই শানশৌকতে থাকতে পারত। বর্ণিত পরিবেশে আমরা মাদার তেরেসা বা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে পাবো -এমনটা কী করে আশা করি।ষ? আমরা আগেও এহেন শেখ হাসিনা রেজিমের সমালোচনা করেছি, অতীতকে এখনো প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারি, কিন্তু তারা এখন সকল কার্যকরণের বাইরে।

নতুন দিনের কাছে প্রত্যাশা করতে পারি তারা শিক্ষার্থীদের মনোজগত বদলে দেবে। কোমলমতি বিদ্যার্থীদের মনে মায়া জাগাবে। কিন্তু আমরা এখনো আশাবাদী হতে পারি না। কারণ নতুন প্রশাসকরাও গণতান্ত্রিক নিয়ম মেনে দায়িত্বপ্রাপ্ত হননি। কঠোরতর সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা তারা কি আদৌ পাবেন? ইতোমধ্যে খবর বেরিয়েছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর ও ট্রজারারকে শপথবাক্য পাঠ করিয়েছেন এক সমন্বয়ক। শিক্ষকরা সেটি মেনে নিয়ে আটকে যাচ্ছেন ছাত্রদের বেড়াজালে।

গেল জুলাই বিপ্লবে কয়েকশত প্রাণ নাশ করা হয়েছে দুই সপ্তাহের ভেতরে৷ হাজারো ছেলেরা আহত হয়েছে, গুলিবিদ্ধ হয়েছে, অনেকের অঙ্গহানি হয়েছে, অনেকে অন্ধ হয়েছে৷ অনেকের সুচিকিৎসা হয়নি। তারা এখন পর্যন্ত বিচারও চাইতে পারেনি৷ এমন ক্ষত বয়ে বেড়ানোর কালে তোফাজ্জলের মতো নিরীহ সাদাসিধে মানুষ যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো উচ্চমার্গীয় জায়গায় গিয়ে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন, সেই দুঃখ আর রাখবার জায়গা থাকে না।

মানছি এই মুহূর্তে দেশের সকল সিস্টেম কলাপ্স করেছে। মানুষের মধ্যে এতটুকু সহনশীলতা নেই। কথায় কথায় সবাই উত্তেজিত হয়ে পড়ছে। সবাই নিজের সিদ্ধান্তকে একমাত্র সঠিক জ্ঞান করছে। পরমতসহিষ্ণুতার বালাই নেই কোথাও। গণ-আন্দোলনের আফটার শক এটাই।

তবু আশা করব আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সূর্যের মতো আলোকের চাষবাস হবে। যেই আলো‌ কাউকে পোড়াবে না, কেবলই যত্ন করবে। প্রত্যাশা করব, নতুন যুগে বাংলাদেশ সবার সুন্দর সহাবস্থানে সকলের বাসযোগ্য হিসেবে গড়ে উঠবে। সেই সুবর্ণ দেশটিতে আমরা কেমন মানুষের বন্দনা করবো, সেটি মা বাপ ভাই হারা পাথরঘাটার তোফাজ্জল জীবন দিয়ে আমাদেরকে শিখিয়ে গেছেন।

লেখক: সাংবাদিক
২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪

Comments

    Please login to post comment. Login