পোস্টস

নন ফিকশন

বিপ্লবী জাতীয়তাবাদ : নতুন প্রজন্মের অদৃশ্য চেতনা

২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪

Rocky Meraz

মূল লেখক রকি মেরাজ

বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদ কেমন? বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদ কিভাবে এলো? বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদ চর্চা কেন জরুরি?

জাতীয়তাবাদ চেতনা ছাড়া কিছুই না। এটা দেশপ্রেমের মতো অদৃশ্য চেতনা; জাতিগত বিশ্বাস; নীতিগত আদর্শ। জাতিগত পরিচয় সৃষ্টি করার জন্যই একটা স্বাধীন দেশে জাতীয়তাবাদ চর্চা করা উচিৎ।

আচ্ছা! আমরা কি বিদেশের মাটিতে  জাতিগত পরিচয়ে পরিচিত ছিলাম? বিদেশীরা কিন্তু আমাদের ইন্ডিয়ার মানুষের কাতারেই বিবেচনা করে। বাংলাদেশ আর ইন্ডিয়া তাদের কাছে এক। অথচ আমরা ১৯৭১ সালে জাতীয়তাবাদী চেতনায় আবদ্ধ হয়ে গণযুদ্ধ জিতসিলাম। পরবর্তীতে সেই জাতীয়তাবাদ কেউই ধইরা রাখতে পারে নাই। তাই আমরা এখনো বাঙালি জাতি হিসেবেই বিদেশে পরিচিত। বাংলাদেশী হিসেবে নয়। অর্থাৎ বিদেশীরা আমাদের ভারতীয় কলোনি মনে করে।

১৯৭১ এর পর  প্রথম বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদের চর্চা শুরু করেন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। তখন থেকেই বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদের যাত্রা শুরু হয়। জাতীয়তাবাদ একটি আদর্শ যেখানে জাতিকে মানব সমাজের কেন্দ্রীয় অবস্থানে স্থাপন করা হয় এবং অন্যান্য সামাজিক ও রাজনৈতিক আদর্শকে জাতিগত আদর্শের পরে স্থান দেয়া হয়।

শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের জাতীয়তাবাদ ছিল বাংলাদেশ ভূখণ্ডে বসবাসকারী সকল নাগরিকের আত্মীক বন্ধনের উপর ভিত্তি করে গড়ে তুলা জাতীয়তাবাদ।  শহীদ  জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর এই জাতীয়তাবাদের চর্চা বাংলাদেশে হয়েছে বেশকিছুবার। বিএনপি যখন ক্ষমতায়  ছিল তখন চর্চা ছিল। তারপর দীর্ঘ সতেরো বছর ফ্যাসিবাদী সরকারের দমনমূলক রাজনীতির কারনে এই চর্চাটি বাধাগ্রস্ত হয়। ফলাফল  আমরা এখনো প্রপার বাংলাদেশী হইতে পারি নাই। অথচ বাংলাদেশী পরিচয় পাইসি ১৯৭১ সালে তাও আবার যুদ্ধ কইরা।

আফটার একাত্তর বাংলাদেশের রাজনীতিতে জিয়াউর রহমানের আসা ও তৎকালীন সবচেয়ে আধুনিক মতবাদ  জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল, নাগরিকদের মাঝে জাতিগত বোধ সৃষ্টি করে  বাংলাদেশী আত্মপরিচয় নির্মান করা।

দুঃখজনক হলেও সত্যি বিদেশের মাটিতে এখনো আমরা বাংলাদেশী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারি নাই; এই কথাটা ভাবলেই মনে হয়। আরও আগে থেকে বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদের সুষ্ঠ  চর্চা থাকলেই কেবল এখন বিদেশিদের কাছে বাংলাদেশী হিসেবে পরিচিত হইতে পারতাম।

বিদেশিরা আমাদের কেন ইন্ডিয়া মনে করতো? 
কারন আমাদের সংস্কৃতি ইন্ডিয়ার মতো, হাসিনার বন্ধু ইন্ডিয়া আমাদের এতটাই বন্ধুরাষ্ট্র ছিল যে ইন্ডিয়ান হস্তক্ষেপ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ কোন রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত হতো না। এটা বিদেশিরা দেখতো। বাংলাদেশের সবকিছুতে ভারতের আধিপত্য দেখেই তারা বাংলাদেশীদের ইন্ডিয়ান ভাবতো। ইন্ডিয়ান বলয়ে বাংলাদেশী নাগরিক আর বাংলাদেশী পরিচয়ে প্রকাশিত হইতে পারতো না বিদেশিদের সামনে।

আমাদের দেশে ২০২৪ সালে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও ছাত্রজনতার যে অভুত্থান হইলো, সেখানেও এক অদৃশ্য চেতনা ছিল সেটাকে আমি জাতীয়তাবাদ হিসেবে দেখি। ফ্যাসিবাদ বিরোধী জনমতের উপর যে জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠিত হইসে সেটা সুষ্ঠু ভাবে চর্চা করতে পারলে আফটার ফ্যাসিবাদ বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদের পুন:জন্ম হবে। আবারও জাতীয়তাবাদের চর্চা শুরু হবে ; সদ্য শেষ হওয়া জনঅভুত্থানের মাধ্যমে একটা বিপ্লবী জাতীয়তাবাদী প্রজন্ম ভারত বিরোধী হয়ে ওঠেছে। এরা ভারত থেকে বের হতে চায়।

আর ভারত থেকে বের হতে হলে জাতীয়তাবাদের বিকল্পও নেই। ভারত সহজ বিষয় না। ভারতের সাথে বাংলাদেশের অনেক রুপকথা ও ইতিহাস। ভারত জানে বাংলাদেশীদের মধ্যে জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠিত হলে তারা ভারতকে আর কোন সুবিধা দিবে না। ভারত আর বাংলাদেশকে শোষন করতে পারবে না।

আর বিদেশের কাছেও বাংলাদেশীরা ক্রমশ 'বাংলাদেশী হইয়া ওঠতে পারবে। অর্থাৎ বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদের চর্চা হলে বাংলাদেশ আর ইন্ডিয়ান কলোনি থাকবে না। বাংলাদেশ  নব্য উপনিবেশবাদ থেকে মুক্তি পাবে। জনগণ নতুন কইরা বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডের মালিক হবে।

আমি এই জনঅভুত্থানকে বাংলাদেশের ইতিহাসে  রেনেসাঁ যুগর সূচনা হিসেবে দেখি আর জাতীয়তাবাদকে ; রেনেসাঁ যুগকে বহন করার মন্ত্রও মনে করি। ১৯৭১ সালের পর পরই বাংলাদেশীরা জাতীয়তাবাদের চর্চা না কইর যে ভুলটা করছে তার জন্যই মুজিবের স্বৈরাচার হয়ে ওঠার সাহস হইসে।

২০২৪ এর জনঅভুত্থানের পর আমার মনে হয় ;
১৯৭১ সালের পর থেকে ফ্যাসিবাদী জুলুম সহ্য করে বাংলাদেশে জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত; জাতীয়তাবাদের যা কিছু  বেঁচে আছে সেটার সাথে ছাত্রজনতার মধ্যে দেশপ্রেমের যে চেতনা তৈরি হয়েছে সেটা যোগ করে ; বাংলাদেশে আবারও জাতীয়তাবাদের চর্চা করা উচিৎ। 
তবেই নতুন প্রজন্মের মধ্যে  আত্মপরিচয়ের যে ক্ষুধা আছে সেটার পূর্ণতা পাবে। তাই আফটার ফ্যাসিবাদ পিরিয়ডে বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদের চর্চা করা হোক।

বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ চর্চার মধ্য দিয়ে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলুক বাংলাদেশীরা। ঔপনিবেশিক আমল থেকেই থেকেই উপমহাদেশের মানুষের মাঝে আন্দোলন সংগ্রামের সাথে অদৃশ্য জাতীয়তাবাদী মতাদর্শের জন্ম হয়। ১৯৭০ সালের শেষের দিকে  জাতীয়তাবাদ মতাদর্শের উত্থান শুরু হয় ; ১৯৭১ সালের গণযুদ্ধে যা লক্ষ করা যায় । তবে সেটার সুষ্ঠ চর্চা কখনোই হয় নি। সর্বপ্রথম ১৯৭৮ সালে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান  জাতীয়তাবাদের আদর্শ ধারন করে জাগদল প্রতিষ্ঠা করেন পরবর্তীতে যা বিএনপি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। বিএনপির মূল ভিত্তিই জাতীয়তাবাদ। বিএনপির উপরই বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী মতাদর্শ চর্চিত হয়।

২০২৪ এর আন্দোলনে বাংলাদেশের সাধারন মানুষের মনে অদৃশ্য ভাবে  জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কেননা ২০২৪ সালে এসেই ফ্যাসিবাদ বিরোধী জাতীয় ঐক্য তৈরী হয়েছে বাংলাদেশে। যে ঐক্যের কথা বিএনপি পনেরো বছর ধরেই বলে আসছিলো। আমি মনে করি বাংলাদেশের এই জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলেছিল বিএনপির চর্চাকৃত মতাদর্শ জাতীয়তাবাদ। দীর্ঘ পনেরো বছর জাতীয়তাবাদী মতাদর্শের খাতিরে বিএনপি সকল রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের বলয়ে এনে একটা সফল অভুত্থান শেষ করে। ৭১ পরবর্তী ভারতীয় বলয় থেকে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে বের করার জার্নিতে বিএনপির অবদান সবচেয়ে বেশি।

ফ্যাসিবাদী পিরিয়ডে বাংলাদেশের সংস্কৃতি বিদেশিদের কাছে বিক্রি হয়ে গেসিলো। বাংলাদেশীরা বিদেশিদের ফলো করে লাইফ লিড করতো। সংস্কৃতিতে না ছিল জাতিগত প্রাইড ; না ছিল দেশীয় আধিপত্য। বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে ছিল ভারতীয় আধিপত্য।

আমি লক্ষ্য করছি কোন বুদ্ধিজীবী ২০২৪ সালে বাংলাদেশে নতুন করে জন্ম নেয়া বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে কোন বয়ান দেয় না। বর্তমানে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মনের মধ্যে যতটা জাতীয়তাবাদী চেতনা অদৃশ্য ভাবে লুকিয়ে আছে সেটার চর্চা অবশ্যই হওয়া উচিত। তা না হলে জনগণের কোন লাভ হবে না।

আফটার ফ্যাসিস্ট পলিটিক্যাল সিচুয়েশনে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে ভারতীয় আধিপত্য কমানোর জন্য এবং বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মুক্তির জন্য ; জনঅভুত্থানকে সফল করার জন্য ; বিপ্লবী আদর্শের জাতীয়তাবাদকে চর্চা করা জরুরি।  

নব্য উপনিবেশ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য ইনকিলাবের ভাষা হোক জাতীয়তাবাদ।

#রকিমেরাজ