পোস্টস

নন ফিকশন

মজলুম কীভাবে জালিম হয়ে যায়?

২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪

ওয়াসিম হাসান মাহমুদ

মূল লেখক ‌ওয়াসিম হাসান মাহমুদ

ক্ষমতাহীন এবং প্রায় সবসময় নির্যাতিত জনসংখ্যার অংশ যখন ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে যায় তখন ক্ষেত্রবিশেষে আরো ভয়াবহ, আরো নারকীয় হয়ে ওঠে কেন?

এক‌ই পরিস্থিতি অফিসের অল্পবয়সি জুনিয়রের, যে যৌবনে প্রতিজ্ঞা করেছিল কখনো বুলি করা বসের মত হবে না, সে কেন ঠিক তাঁর অতীত বসের পদাঙ্ক অনুসরণ করে নিজের জুনিয়রদের কষ্ট দেয়?

যে ব‌উ শ্বাশুড়ি দ্বারা হ্যারাজমেন্টের শিকার হতে থাকে, সে নিজে যখন মধ্যবয়সে ছেলের ব‌উ আনার পর ঠিক তাঁর শ্বাশুড়ির মত বা আরো ভয়ানক আচরণ করেন কেন নতুন ব‌উয়ের সাথে?

ইউনিভার্সিটিতে রেগিং এর শিকার প্রথম বর্ষের ছাত্রটি যখন চোখ মুছতে মুছতে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে সে কি জানে যে নিকট ভবিষ্যতে সেও ফ্রেশারদের হয়তো এর চেয়েও কঠিন রেগিং দিবে?

বাংলায় একটি কথা আছে, "দূর্বলের ক্ষমতা ভয়াবহ।"

আমার মতে, "অসতর্ক দূর্বলের ক্ষমতা ভয়াবহ।" দূর্বল যখন সংগ্রাম করে সেটি কমিউনিজমের বা ধর্মতন্ত্রের জন্যে বা অন্য কোন আদর্শ প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায়ে তখন সেকি জানে যে বিপ্লবের পর সে নিজেই পরিণত হবে এক স্বৈরতান্ত্রিক নিপীড়কের যন্ত্র হিসেবে?

পৃথিবীজুড়ে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ফাইট বিদ্যমান। যার বায়াস বা পক্ষপাত যেদিকে সে সেদিকটা প্রতিষ্ঠা করতে ব্যাপক নির্যাতনের মুখোমুখি হয়। কিন্তু একবার বিপ্লব সংগঠিত হয়ে গেলে নিজের শত্রুপক্ষকে নির্মমভাবে উৎখাতের সাথে সাথে আমজনতার সাথেও সে নব্য স্বৈরাচার হিসেবে আরো কঠিন আচরণ করতে থাকে।

আমার জানা আছে যে, এখানে পাওয়ার পলিটিক্স কাজ করে। নব্য ক্ষমতাপ্রাপ্তরা যাদের সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করতেন, ঠিক তাদের মত‌ই হয়ে পড়েন। বলশেভিক বিপ্লব সফল হ‌ওয়ার পর কিভাবে স্ট্যালিন এক মহাদানবের মত মানবাধিকার লঙ্ঘনের অন্যতম চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন তা অনেকের‌ই জানা। এরকম উদাহরণ ধর্মতান্ত্রিক ক্ষেত্রেও ভুড়ি ভুড়ি। শাহের নির্যাতন সহ্য করা খোমেনী যখন থ্রোনে আসেন তখন ব্যাপকহারে মানুষজনের উপর সেই এক‌ই নিষ্ঠুর মোরাল পুলিশিং করে গেছেন।

বাংলাদেশের ইতিহাসেও এক‌ই ধরণের প্যাটার্ন দেখা যায়।

যে ঘৃণিত শক্তিকে নিঃশেষ করে দিয়ে নিজের ইউটোপিয়া প্রতিষ্ঠা করার কথা, সেই ইউটোপিয়া = ডিসটোপিয়া কিভাবে হয়ে যায়?

তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ "বিয়ন্ড গুড এন্ড ইভিল" এ খ্যাতিমান জার্মান চিন্তক ফ্রেডরিখ নিটসে বলেছিলেন,

"দৈত্যের সাথে যারা যুদ্ধ করছেন তাদের সতর্ক থাকতে হবে যেন যুদ্ধ করতে করতে তাঁরা নিজেরাই দৈত্যে পরিণত না হয়। রসাতলের দিকে আপনি দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকলে রসাতল‌ও ফিরে চায়।"

এই রসাতল বা অ্যাবিস বড় ভয়ানক এক বিষয়। এই অ্যাবিস মানবসভ্যতাকে ইতিহাসজুড়ে সিডিউস করেছে। অত্যাচারিত একসময় নিজেই অত্যাচারি হয়ে পড়ে। নিপীড়কের সাথে যুদ্ধ করতে করতে একসময় জিতে যাওয়া দূর্বল পরিণত হয়ে যায় আরো বড় নিপীড়কে। এই রসাতল অনেকটা পর্বতের খাঁদ কোণায় দাড়িয়ে নিচে দেখার মত। গভীর খাঁদ মানবমনকে প্রভাবিত করে। সবচেয়ে ভিতুর ডিমদের মনেও কেন জানি সেকেন্ডের ভগ্নাংশের জন্য খাঁদে লাফ দেয়ার আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি হয়। মানবমন বড় অদ্ভুত।

পৃথিবীজুড়ে বিভিন্ন ইস্যুতে যুদ্ধ চলছে, চলছে আন্দোলন, নৈরাজ্যের ফিসফিসানিও শুনা যায় মনে হয়। বিপ্লব শেষ ধাপ নয় বরঞ্চ যেকোন নেগোশিয়েশনের প্রথম ধাপ মাত্র। যেকোন আন্দোলন, যুদ্ধ, বিপ্লবের মাঠে নেমে পড়লে অ্যাবিস বা রসাতলে না যাওয়ার বিষয়ে সতর্কতা বেশিরভাগ সময় অবলম্বন করা হয় না। প্রচন্ড ঘৃণা-বিদ্বেষ, প্রতিশোধপরায়ণতা এবং কর্তৃত্বপরায়ণতার অভিলাষ মানুষজনকে অন্ধ করে দেয়। সকল সতর্কতা রসাতলে যায়। মানুষ দৈত্যকে হারিয়ে নিজে পরিণত হয় নতুন এক দৈত্যে।

কারণ সে বা তারা সতর্ক ছিল না।

ফ্রেডরিখ নিটসের ভাষায় ( জার্মান থেকে ইংলিশে রূপান্তরিত )

"If you gaze long into the Abyss, it also gazes back at you."