কেমন হলো শুক্রবার নিউইয়র্কে জাতিসংঘের ৭৯তম অধিবেশনে দেয়া বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্বকারী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষণ? বাংলাদেশের গণতন্ত্রে উত্তরণ, ফিলিস্তিনে মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং মিয়ানমার সৃষ্ট রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে কথা বলেছেন তিনি। ভারতের সাথে অভিন্ন নদীর সুষ্ঠু পানিবন্টনের ব্যাপারটি অনুল্লেখ্য রয়েছে। গণ-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে উঠে আসা তারুণ্যই দেশের ভাগ্যনিয়ন্তা হবে এমনটা বলা হলেও, ভবিষ্যতে কেমন মানুষেরা বাংলাদেশ পরিচালনা করবেন, তাদেরকে কোনপথে পাওয়া যাবে এর সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা বক্তব্যে থাকলে আরো ভালো হতো।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর ভাষণে বলেন, ‘উদারনীতি, বহুত্ববাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার ওপর মানুষের গভীর বিশ্বাস থেকেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় হয়। ১৯৭১ সালে যে মূল্যবোধকে বুকে ধারণ করে আমাদের গণমানুষ যুদ্ধ করেছিল, সেই মূল্যবোধকে বহু বছর পর আমাদের “জেনারেশন জি” (প্রজন্ম জি) নতুনভাবে দেখতে শিখিয়েছে। এ রকমটি আমরা দেখেছিলাম ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে বাংলাকে মাতৃভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার সময়েও। বাংলাদেশের এই অভ্যুত্থান আগামী দিনগুলোতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে মানুষকে মুক্তি ও ন্যায়বিচারের পক্ষে দাঁড়াতে প্রেরণা জুগিয়ে যাবে।’
খুব চমৎকারভাবে বাংলাদেশ নামক জাতিরাষ্ট্রের ভিত্তিমূল একাত্তরের স্বাধিকার আন্দোলনের মৌল স্পিরিটকে তুলে ধরেছেন ড. ইউনূস। উদারনীতি, বহুত্ববাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতায় গভীর বিশ্বাস থেকে উদিত বাংলাদেশ আগামী দিনগুলোতে বিশ্বমানুষকে মুক্তি ও ন্যায়বিচারের পক্ষে দাঁড়াতে প্রেরণা জুগিয়ে যাবে। যে যাই বলুক কার্যত মহান মুক্তিযুদ্ধে পাওয়া সাংবিধানিক ভিত্তিকেই তিনি মান্যতা দিয়েছেন। অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অভিব্যক্তি। একটি নির্দিষ্ট ধর্মের মানুষেরা তাদের ধর্মানুগ শাসন ও সংবিধান চায়, ড. ইউনূসের ভাষণ ওই একদেশদর্শী চাওয়াগুলোর প্রতি নিরেট জবাব।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘অতীতের ভুলগুলোকে সংশোধন করে একটি প্রতিযোগিতামূলক ও শক্তিশালী অর্থনীতি এবং ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলাই এই মুহূর্তে আমাদের মূল লক্ষ্য।’
কথাগুলো খুবই সিগনিফিক্যান্ট। আমরা আমাদের অতীত থেকে বয়ে আনা ভুলগুলো সংশোধন করতে চাই। এর ওপরই গড়ে উঠবে ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা।
ড. ইউনূস বাংলাদেশের মুক্তি ও গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপ দিতে বিশ্ব সম্প্রদায়কে নতুন বাংলাদেশের সঙ্গে নতুনভাবে সম্পৃক্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘আমরা মানুষের মৌলিক অধিকারকে সমুন্নত ও সুরক্ষিত রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আমাদের দেশের মানুষ মুক্তভাবে কথা বলবে, ভয়ভীতি ছাড়া সমাবেশ করবে, তাদের পছন্দের ব্যক্তিকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবে—এটাই আমাদের লক্ষ্য। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংরক্ষণ এবং সাইবার ডোমেইনসহ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সুসংহতকরণেও আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। রাষ্ট্রব্যবস্থার সকল পর্যায়ে সুশাসন ফিরিয়ে আনাই আমাদের অভীষ্ট।’
বাংলাদেশের মানুষ গেল দশকে পছন্দের মানুষকে ভোট দিতে পারেনি। ভোটের প্রতি এতটাই আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছিল যে, খোদ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের লোকেরাও ভোটকেন্দ্রে ভোট দিতে যেতেন না। যে ভোট রাতে হয়ে যায়, কিংবা নিজেদের দলের দুই প্রার্থীর মধ্যে ভোটাভুটি হয়; সেখানে ভোটারের স্বাধীন মত প্রকাশের জায়গা থাকে না। এমন বাস্তবতায় ড. ইউনূসের কমিটমেন্ট যদি বাস্তবতার দেখা পায়, সেটিই বাংলাদেশের আপামর জনগণের জন্য কল্যাণকর।
ড. ইউনূস বলেছেন, দায়িত্ব গ্রহণের পর অন্তর্বর্তী সরকার দেখতে পায় কীভাবে সর্বগ্রাসী দুর্নীতি একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে, কীভাবে রাষ্ট্রের মূল প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্মম দলীয়করণের আবর্তে বন্দী করে রাখা হয়েছিল, কীভাবে জনগণের অর্থসম্পদকে নিদারুণভাবে লুটপাট করা হয়েছিল, কীভাবে একটি বিশেষ স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী সব ব্যবসা-বাণিজ্যকে অন্যায়ভাবে নিজেদের হাতে কুক্ষিগত করে দেশের সম্পদ অবাধে বিদেশে পাচার করে দিয়েছে। এককথায়, কীভাবে প্রত্যেকটি পর্যায়ে ন্যায়, নীতি ও নৈতিকতা অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল।
আমরা যারা কোনো নির্দিষ্ট দলের বাইরে থেকে প্রতিনিয়ত রাজনৈতিক কার্যাবলী পর্যবেক্ষণ করি, তারা দেখছি বাংলাদেশে এ যাবৎ কোনো শাসক বিশুদ্ধ জন আকাঙ্ক্ষার অনুবর্তী থেকে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেনি। তিপ্পান্ন বছরে যে লঙ্কায় গিয়েছে তিনিই রাবণ হয়ে উঠেছেন। এর সবিশেষ উদাহরণ তৈরি করেছিল গেল ১৫ বছরের আওয়ামী লীগ। দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী হওয়ার সুযোগ নিয়ে দেড়শ বিলিয়ন ডলার লোপাট করে নিয়েছে লাস্ট রেজিম। অথচ বাংলাদেশের মোট ঋণ এখন শতকোটি বিলিয়ন ডলার। লুটপাট না হলে আমাদের অর্থনীতির চেহারা কেমন হতো আমরা সেটা কল্পনায় অনুভব করতে পারি। অতীত যেহেতু শোধরানোর সুযোগ এসেছে, আমরা যেন সেই ঘুণেধরা অতীতে নিমজ্জিত না থেকে সবাই একযোগে ভালো হয়ে উঠি সেই মন্ত্রণা আমাদেরকে পেতেই হবে।
গণতান্ত্রিক উত্তরণে সরকারের ভূমিকার প্রসঙ্গ টেনে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, এসব সংস্কার যেন টেকসই হয়, তা দীর্ঘ মেয়াদে নিশ্চিত করতে এবং অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য উপযোগী পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। গণতন্ত্র, আইনের শাসন, সমতা ও সমৃদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ হিসেবে আত্মপ্রকাশের অভিপ্রায় বাস্তবায়নে ড. ইউনূস বাংলাদেশের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন ও সহযোগিতা ব্যাপকতর ও গভীরতর করার আহ্বান জানান।
বিশ্বসমাজ যদি চায় সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় ফিরুক, সেটি বাস্তবায়ন সম্ভব। মাঝখান দিয়ে আমরা যদি মার্কিন নীতির পরীক্ষাগারে পড়ে রাশিয়া, চায়না ও ভারতের চোখরাঙানিতে পড়ে যাই, সেটি কোনো শুভফল বয়ে আনবে না। কাজেই আমরা বিশ্ববাসীর কাছে সমর্থন চাইতে পারি, কিন্তু শুভবোধের পথে নিজেদের পুনর্গঠনের কাজ বুদ্ধিমত্তার সাথে আমাদের নিজেদেরকেই করে দেখাতে হবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় আমরা যেন গা না ভাসাই সেটি সুনিশ্চিত করতে হবেই।
রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে তাদের টেকসই প্রত্যাবাসনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তা চেয়েছেন ড. ইউনূস। আমরাও বিশ্বাস করি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা চীন চাইলে কয়েকদিনেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্ভব। তারা তাদের জন্মভূমিতে ফিরে যাবে এটাই বাস্তবতা। তা না করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গাদের বসিয়ে বসিয়ে খাওয়া, পরা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করে এটি অমানবিক ও সভ্যতা বিরোধী। মানুষ কেন বাস্তুচ্যুত হয়ে অন্যদেশে পরবাসী জীবনযাপন করবে? রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ না ঠেকিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ভুল করে গিয়েছেন শেখ হাসিনা। সেই ভুলের মাশুল কতদিন বয়ে বেড়াতে হবে ঈশ্বর জানেন। আমাদের প্রত্যাশা ড. ইউনূস সরকার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বিষয়টির আশু সুরাহা করবার পদ্ধতিগুলো বুঝিয়ে দিয়ে রোহিঙ্গা সংকট থেকে বাংলাদেশকে মুক্তির পথ দেখাবে।
ইউক্রেন যুদ্ধের ভয়াবহ বৈশ্বিক প্রভাব নিয়ে কথা বলেছেন ড. ইউনূস। তবে সবচেয়ে ভালো বক্তব্য দিয়েছেন ফিলিস্তিন সংকট নিয়ে। ড. ইউনূস বলেন, ফিলিস্তিনের জনগণের ওপর চলমান নৃশংসতা, বিশেষত নারী ও শিশুদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যে নিষ্ঠুরতা বিশ্ব দেখছে, তা থেকে নিস্তারের জন্য বাংলাদেশ অনতিবিলম্বে সম্পূর্ণ যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানাচ্ছে। দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানই মধ্যপ্রাচ্যে টেকসই শান্তি আনতে পারবে। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সবাইকে এর বাস্তবায়নের জন্য এখনই উদ্যোগ নিতে হবে।
এই অসম যুদ্ধে ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংগঠনের জন্য সংশ্লিষ্ট সবার দায়বদ্ধতার কথা বলা হলেও স্পষ্ট করে ইজরায়েল এবং তাদের প্রধানতম পৃষ্ঠপোষক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথা উল্লেখ করা হয়নি। অবশ্য নাম ধরে না বললেও বিশ্ববাসী জানে কোথায় কার কী ভূমিকা।
ড. ইউনূস ব্যক্তিগত পর্যায়ে যে বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করেন, সেই সামাজিক ব্যবসা, এনজিও বা দাতব্য সংস্থার ভূমিকা নিয়ে কথা বলেছেন। বিশেষ করে তাঁর থ্রি জিরো তথা তিন শূন্য ধারণা জাতিসংঘের অধিবেশনে তুলে ধরেছেন। তিনি তাঁর তিন শূন্য লক্ষ্য অর্জনের প্রস্তাবনায় বলেন, শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব এবং শূন্য নেট কার্বন নিঃসরণ অর্জন করতে পারি। যেখানে পৃথিবীর প্রত্যেক তরুণ-তরুণী চাকরিপ্রার্থী না হয়ে বরং উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ পাবে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই ধারণাটির গুরুত্ব ব্যাপক। প্রতিবছর আমাদের দেশে বেকারত্বের হার বাড়ছে। একটি সরকারি চাকরির জন্য বিপুলসংখ্যক প্রার্থীর যে জীবনযুদ্ধ তা গ্রহণযোগ্যতার মাত্রা অনেক আগেই হারিয়েছে। যে কারণে সামান্য কোটা সংস্কার নিয়েও শিক্ষার্থীদেরকে পড়াশোনা রেখে দীর্ঘসময় মাঠের আন্দোলনে থাকতে হয়। অপরদিকে কার্বন নিঃসরণের সবচেয়ে বড় ক্ষতির মুখে আছি আমরা তৃতীয় বিশ্বের নাগরিকেরা। অথচ কার্বন নিঃসরণের বড় দায় উন্নত রাষ্ট্রগুলোর।
৫০ বছরের সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশের সরকার প্রধানের ভাষণ খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ও সময়োপযোগী। বাংলাদেশ একটি অন্তর্বর্তী সময় অতিক্রম করছে। এমন একটা সময়ে শান্তি ও নিরাপত্তা, ন্যায়, সমতা এবং নিয়মভিত্তিক বৈশ্বিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সমন্বিত প্রয়াস ঘোষণা করলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এরমধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ যদি নিজের ভূমিতে সর্বোচ্চ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিশ্বশান্তিতে খানিকটা হলেও ভূমিকা রাখতে পারে সেটিই হবে আমাদের সকলের সার্থকতা।
লেখক: সাংবাদিক
১৩ আশ্বিন ১৪৩১ | ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪