রাজশাহী থেকে একটি গ্রাফিক কার্ড পাঠিয়েছেন আমার সুহৃদ ও শুভাকাঙ্ক্ষী বড় ভাই। কার্ডে লেখা শেখ হাসিনার ৭৮তম জন্মদিনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের শহীদ মিনার প্রাঙ্গনে শেখ হাসিনাকে জুতা নিক্ষেপ কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে। কার্ডে তারা লিখেছে, ফ্যাসিস্ট হাসিনার কলঙ্কিত জন্মদিন উপলক্ষে গণ জুতা নিক্ষেপ প্রতিযোগিতা। বিজয়ীদের উপহার হিসেবে থাকবে MOJO. শেখ হাসিনা আফসোস করতে পারেন, মোজোর মতো কত গ্রুপকে ব্যবসায়িক সুবিধা দিতে বিচিত্র অনৈতিক কায়কারবারই না তারা করেছেন। ওই কর্মফলই তাদের নিজেদের দিকে জুতারমাল্যে পর্যবশিত হচ্ছে।
আজ ৭৮তম জন্মদিন যাচ্ছে শেখ হাসিনার। গেল বছরও প্রজা হিসেবে আমাদের শুভেচ্ছায় সিক্ত হয়েছেন তিনি। পত্রিকাগুলোতে প্রধানমন্ত্রীকে গ্লোরিফাই করে প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। কেউ কেউ আরেকধাপ এগিয়ে গিয়ে পুরোপৃষ্ঠাব্যাপী ক্রোড়পত্রও ছেপেছিল। অথচ আজ পত্রিকার কোনো কোণায় শেখ হাসিনার নাম পর্যন্ত নেই। এইসব গণমাধ্যমকে আগেও যেমন শেখ হাসিনা গংরা কিছু লিখতে বলেনি। তেমনি অন্তর্বর্তী সরকারও হাসিনার কথা লিখতে বারণ করেনি। গণমাধ্যমগুলোর স্বাধীনতা নেই বলেই তারা বরাবর রোদ দেখে আপন গামছা ছ্যাকা দেয়। অথচ আজ পত্রিকাগুলো শেখ হাসিনার ভুলগুলো নিয়েও আলোচনা করতে পারত। লিখতে পারত কাদের সাহচর্য ও সমর্থনে দানবীয় শক্তি অর্জন করেছিলেন তিনি। কেন মাতৃত্বের গুণ হারিয়ে শেখ হাসিনাকে হাজার মানুষের তাজা রক্তের ওপর দিয়ে ক্ষমতা ধরে রাখবার প্রয়াস পেতে হয়েছিল?
পত্রিকাগুলো লিখতে পারত ৪৩ বছর ধরে একটি দলের সভাপতির পদ আঁকড়ে ধরে থাকতে হবে কেন তাকে? যাদের দলের মধ্যে গণতন্ত্র চর্চা নেই তারা শাসনব্যবস্থায় ডেমোক্রেসি কেমনে আনবে?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশি সমালোচিত চরিত্র হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তার ৯ বছরের অটোক্রিসি ঘোচাতে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতসহ অন্যান্য দলকে গণ-আন্দোলন গড়ে তুলতে হয়েছিল। এরশাদের পেটোয়া বাহিনীর হাতে প্রাণ গেছে অন্তত ৪ শ ছাত্র-জনতার। শহীদ নূর হোসেন ও ডা. মিলনের নাম আমরা সবাই জানি। সেই সামরিক স্বৈরশাসক এরশাদকে খালেদা জিয়া তবু বিচারের আওতায় এনে ৫ বছর জেলের ঘানি টানাতে পেরেছিলেন। অপরদিকে হাসিনা সরকার এরশাদকে রাজকীয় জীবন দিয়েছিলেন। একজন পতিত স্বৈরাচারকে রীতিমতো নাকে কানে দড়ি দিয়ে ঘুরিয়েছেন। এরশাদ ও তার স্ত্রীকে গৃহপালিত বিরোধী দলে রেখে সরকার চালিয়েছেন। সবচেয়ে হাস্যকর ঘটনা হলো এরশাদের জাতীয় পার্টি যুগপৎভাবে বিরোধী দল ও সরকারে পারফর্ম করেছে। শিশির ভট্টাচার্য এরশাদ ও হাসিনা চরিত্রের যুগলবন্দিতা প্রভাববিস্তারি কার্টুন এঁকেছেন। যখন থেকে আমরা শিশিরের কার্টুন আর দেখিনি ধরে নিতে পারি তখন থেকেই এরশাদের ফেলে আসা জমিন দখলে নিয়েছিলেন শেখ হাসিনা।
স্বৈরশাসক এরশাদকে যিনি নাকানিচুবানি খাইয়ে রাখতে পারেন সেই তাকে তাহলে কতবড় Despotic হওয়া মানায়?
প্রত্যেক মন্দেরই ভালো দিক থাকে। অন্ধকারের বুকে যেমন দিন লেখা থাকে।
এরশাদেরও নিশ্চয়ই গুণপনা কিছু ছিল। তেমনি ১৯৯৬ ও ২০০৮ এর নারী নেত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার গুণাবলিও ইতিহাসে লেখা থাকবে। বহু অপকর্মের সাথে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ, ছিটমহল সমস্যার সমাধানও আলোচিত হবে। তবে সব গুণ এখন ঢাকা পড়ে গেছে ২০২৪ এর ম্যাসাকারে। ক্ষমতার লোভ মানুষকে অন্ধ করে দেয়। মন থেকে মানবিকতা মুছে দেয়।
২০২৩ এর ২৮ সেপ্টেম্বর প্রথম আলো লিখেছিল...
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭৭তম জন্মদিন আজ। তিনি ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জের মধুমতী নদী বিধৌত টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছার বড় সন্তান শেখ হাসিনা। ১৯৮১ সাল থেকে বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সভাপতি তিনি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে ১৭ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্র যান তিনি।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘শেখ হাসিনার জন্মদিন বাংলাদেশের জন্য একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। বঙ্গবন্ধু আমাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতার রোল মডেল। শেখ হাসিনা আমাদের উন্নয়ন এবং অর্জনের রোল মডেল। তিনি নিজে যা অর্জন করেছেন, তা নজিরবিহীন। বিশ্বদরবারে বাংলাদেশকে বিশেষ মর্যাদায় উন্নীত করেছেন। তাঁর জন্মদিন পালন না করলে আমরা জাতির কাছে অকৃতজ্ঞ থেকে যাব।’
দ্য ডেইলি স্টারও শেখ হাসিনা বন্দনায় প্রতিবেদন ছেপেছিল। নির্মম পরিহাস এই যে, শেখ হাসিনার কর্মফল তাকে বাংলাদেশের গণমাধ্যম থেকে আজকে ওয়াশ আউট করে দিয়েছে। অথচ হাসিনা আমলের অধিকাংশ গণমাধ্যম হাসিনা বন্দনায় অহোরাত্রি পার করেছে। বহু সাংবাদিককে হাসিনা সরকার হাজার কোটি টাকার মালিক বানিয়েছে। পত্রিকা ও টেলিভিশন মালিক বহু ব্যবসায়ীকে ব্যাংক লুট করে ঋণখেলাপি হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। আজ কোথায় সেই গণমাধ্যম আর কোথায় বা হাসিনার জন্য জীবন দিয়ে দেয়ার ঘোষণা দেয়া ব্যবসায়ীরা?
বস্তুত এইসব গণমাধ্যম, ব্যবসায়ী, পেশাজীবী নামের হাজারো স্তাবকেরাই শেখ হাসিনাকে ডিক্টেটর হওয়ার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। হাসিনা ওইসব চাটুকারের ভিড়ে নিজেকে খুইয়ে ফেলে মাতৃসত্তা হারিয়ে ফেলেছিলেন। হাসিনা প্রস্থান করেছেন, কিন্তু স্তাবকেরা রয়ে গেছেন বহাল তবিয়তে। নতুন শাসকের জন্য নবতর তেলের ড্রাম নিয়ে প্রস্তুত হয়ে আছেন তারা।
শেখ হাসিনাকে রিয়ালিটি মানতে হবে। একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া পুরোনো দল আওয়ামী লীগকে বাঁচাতে হলে দলের নেতৃত্ব ছেড়ে দিয়ে নবীন যোগ্যতর কারো কাছে দায়িত্ব অর্পণ করতে হবে। সবার আগে বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থাকে মান্যতা দিয়ে আইনের মুখোমুখি হওয়াকে মানতে হবে, মান্যতা দিতে হবে।
বাংলাদেশে শহীদ মিলন, নূর হোসেন, মীর মুগ্ধ বা আবু সাঈদদের মতো বিপ্লবীদের দ্রোহে স্বৈরাচারেরা কিছুদিনের জন্য অবকাশে যায় মাত্র, স্বৈরতন্ত্র সমূলে রয়ে যায় বহাল তবিয়তে। একাত্তরের আল বদর, আল শামসদের বাঙালি মনে রাখেনি। এরশাদকেও এখন আর কেউ স্বৈরাচার বলে নিন্দামন্দ করে না। সময়ের পরিক্রমায় কপাল ভালো হলে হাতে রক্তের দাগ লাগা শেখ হাসিনাকেও বাংলাদেশ ক্ষমা করবে না এটাই বা বলি কিভাবে? গোল্ডফিশকে বন্ধু ভাবে বলেই তো বাঙালির দুঃখ আজন্মে ঘোচে না।
-ফারদিন ফেরদৌস
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪