পোস্টস

গল্প

চিহ্

৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪

রাকিবুল ইসলাম

মূল লেখক অরণি মেঘ

অধরার ফর্সা গালে চার আঙুলের দাগ স্পষ্ট। সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দাগটায় আলতো করে হাত বুলালো। ছাত্রী হিসেবে ভালো থাকায় স্কুল জীবনে কখনো মার খেতে হয়নি। এমনকি বাবা মায়ের কাছেও কখনো মার খায়নি সে। আর এখন প্রায়ই রিয়াদের থেকে মার খেতে হচ্ছে।

তার ননদ হিয়ার ডাকে ধ্যান ফিরলো অধরার। হিয়া ড্রইং রুম থেকে চেঁচিয়ে ডাকলো,

"ভাবী...তোমার সাজগোজ হলো? কোনো উৎসব বা কারণ ছাড়া এত কিসের সাজতে হয় তোমার?"

হিয়া তাড়াহুড়ো করে সামনে রাখা এক টুকরো বরফ গালে ঘসতে লাগল। যে করেই হোক এই আঙুলের চিহ্নটা কমাতে হবে। হিয়া কিছুক্ষণ আগেই দেখে গেছে তার ভাবী মেকাপের সামগ্রী নিয়ে বসেছে। গালের দাগটা দূর থেকে বুঝতে পারেনি সে। অধরা গালে গাঢ় মেকাপ করল। কিছুক্ষণ পর দাগ অনেকটাই কম লাগল। ভালো করে না দেখলে বুঝা যাওয়ার কথা না।

রিয়াদ ফ্রেশ হয়ে এসে পিছন থেকে দাঁড়িয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে অধরাকে দেখছে। সে মৃদু হেসে বলল,

"দাগ বোঝা যাচ্ছে না। এবার বাইরে যাও। সব কাজ শেষ করো।"

অধরা চুপচাপ বাইরে চলে গেল।

অধরাকে দেখে হিয়া বলল,

"অকারণে এত গাঢ় মেকাপের কী দরকার, ভাবী? আমার তো বাপু বেড়াতে গেলেও সাজতে ইচ্ছে করে না। আলসেমি লাগে।"

অধরা মৃদু হাসলো। এরপর রান্নায় মনোযোগ দিল।

কিছুক্ষণ আগেই সামান্য একটা কারণে অধরার গালে চড় বসিয়েছে রিয়াদ। প্রায়ই এমনটা করে। আর অধরা উঠেপড়ে লাগে সেই আঘাতের চিহ্নটা অন্যদের লুকানোর জন্য। অধরার গায়ের রঙ ফর্সা হওয়ায় সেই দাগ আরো বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠে। আর কোনো কারণে সেই দাগ যদি অন্যের সামনে প্রকাশ পায় রিয়াদের রাগ আরো বেড়ে যায়।

আজকে রিয়াদের খালা বাসায় আসবে। সবার কাছে রিয়াদের পরিচয় এক আদর্শ হাজবেন্ড হিসেবে। অধরা গলা বন্ধ জামা বাছাই করছে। কিন্তু সব জামা উল্টে পাল্টে দেখল তার একটাও গলা বন্ধ জামা নেই।

সে মাথায় ওরনা দিয়ে ঢেকে হিয়ার রুমে গেল। শুধু ওরনা দিয়ে ঢেকে রাখতে ভরসা পাচ্ছে না৷ কোনো কারণে যদি ওরনা মাথা থেকে পড়ে যায় তাহলে বিপদ।

"তোমার কোনো গলা বন্ধ জামা আছে, হিয়া?

হিয়া অধরাকে ঘরের মধ্যে এভাবে মাথায় কাপড় দিয়ে থাকতে দেখে কিছুটা অবাকই হলো। বলল,

"হ্যাঁ, ভাবী আছে। তুমি ঘরের মধ্যে এভাবে মাথায় কাপড় দিয়ে আছো কেন?"

অধরা কিছুটা ইতস্তত বোধ করতে লাগল। হিয়া দুষ্টুমির হাসি হেসে বলল,

"বুঝেছি। আর বলতে হবে না। দাঁড়াও দিচ্ছি।"

অধরা বিষয়টার যে অন্য মানে ধরেছে এটা ভেবে লজ্জায় কুকরে গেল অধরা। হিয়া একটা জামা অধরার হাতে দিল। জামাটা নিতে গিয়ে ওরনাটা মাথা থেকে পড়ে যায় অধরার। আর তখনই গলার দিকে চোখ গেল হিয়ার। গলায় আঙুলের দাগ স্পষ্ট।

আজকে ঝগড়ার এক পর্যায়ে বেল্ট দিয়ে আঘাত করেছিল রিয়াদ। তাদের ঝগড়ার আওয়াজ বাহিরে যায় না। ভাইয়ের আসল রূপ হিয়াও জানে না।

"এটা কিসের দাগ, ভাবী?"

অধরা তাড়াহুড়ো করে মাথায় কাপড় দিয়ে বলল,

"ও কিছু না।"

"তোমার গলায় মারের দাগ স্পষ্ট। ভাইয়া তোমাকে মেরেছে? সত্যি করে বলো।"

অধরা চলে যেতে হিয়া তার হাত চেপে ধরল। বলল,

"মাঝে মাঝে গাঢ় মেকাপের আস্তরণে তোমার গাল ঢেকে রাখার কারণ কি তাহলে এটাই?"

অধরা কেঁদে ফেলল। হিয়া তাকে জড়িয়ে ধরল। পরম মমতায় বলল,

"এই চিহ্ন আর লুকিও না, ভাবী। এত বছরেও ভাইয়াকে আমি ঠিক ভাবে চিনতে পারলাম না।"

অধরা ফুপিয়ে কেঁদেই চলেছে। কাঁদতে কাঁদতে বলল,

"মারের চিহ্ন নাহয় একসময় চলে যাবে। কিন্তু মনের মধ্যে যেই চিহ্ন হয়ে আছে সেটা কিভাবে ঢাকবো?"

"তুমি কেন সব সহ্য করছো, ভাবী?"

অধরা মাথা তুলে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। হিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,

"প্রথম বারের জন্য যখন বিষয়টা মাকে জানালাম, মা বললেন, যে সয়, সেই রয়। সহ্য করে নে, মা। তাই সহ্য করছি।"

"কী ব্যপার? তুমি এই জামা কেন পরেছ? তোমাকে তো বললাম গলাবন্ধ জামা পরতে।"

অধরাকে দেখে কথাটা বলল রিয়াদ। অধরার গলায় বেল্টের দাগটা বুঝা যাচ্ছে। সে এই দাগটা ঢাকার চেষ্টা করছে না। সে তার নিজের মত করে সাজলেও দাগটা ঢাকার চেষ্টা করছে না।

সে রিয়াদের কথার জবাব দিল না। রিয়াদ অধৈর্য হয়ে বলল,

"কী হলো? কথা কানে যাচ্ছে না?"

রিয়াদের খালা এসে পড়েছে। অধরা উঠে বাহিরে যেতে নিলো। রিয়াদ এসে অধরার পথ আটকে বলল,

"গলার দাগটা যে বোঝা যাচ্ছে দেখছো না? ওরনা মাথায় দাও।"

"তোমার স্ত্রীকে মারতে লজ্জা লাগে না। কিন্তু তোমার এই রূপ টা বেড়িয়ে যাবে সেটাতে ভীষণ লজ্জা লাগে। এটাই তোমার পুরুষত্ব। তাইনা?"

" মুখ সামলে কথা বলো। ওরনা মাথায় দাও। ঢাকো দাগটা।"

অধরা হেচকা দিয়ে তার হাত ছাড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে আসলো।

অধরা হাসিমুখে রিয়াদের খালাকে খাবার বেড়ে দিচ্ছে। হঠাৎ অধরার গলার দাগটা চোখে পড়তেই তার খালা জিজ্ঞেস করলেন,

"তোমার গলায় কিসের দাগ, বৌমা?"

অধরা গলায় হাত দিয়ে দাগটা দেখিয়ে বলল,

"এটা? এটা আপনার ছেলের বেল্টের আঘাতের চিহ্ন। আমার ভুল কী ছিল জানেন? সে কালকে অফিস থেকে ফিরতে দেরি করেছে কেন সেটার কৈফিয়ত চেয়েছিলাম। আরো আছে।

চুলগুলো সড়িয়ে ঘাড়ের দাগগুলিও দেখালো৷"

এরপর ঘুরে বলল,

"আরো চিহ্ন আছে। যেগুলো আপনাকে দেখাতে পারছি না, খালা। নিন, খেয়ে নিন।"

লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে এলো রিয়াদের।

এই বলে সে খাবার বেড়ে দিল। কিন্তু খালা কিছু খেতে পারলেন না। ঘৃণা ভরে তাকালেন রিয়াদের দিকে।

"তোরে আমরা মানুষ করতে পারি নাই রে, রিয়াদ। তুই তোর বাপের মতই পশু হইসোস।"

এরপর অধরার দিকে তাকিয়ে বললে,

"তোমারে আর এই অমানুষের সংসার করতে হইব না বৌমা। সব ব্যবস্থা আমি কইরা দিমু।"

এই বলে তিনি উঠে চলে গেলেন। রিয়াদ কয়েকবার ডাকলেও আর পিছু ফিরলেন না।

রিয়াদ রেগে গিয়ে অধরার সামনে দাঁড়িয়ে আবার চড় মারতে গেল। কিন্তু তার হাতটা ধরে ফেলল হিয়া।

"আমার মা আমার বাবার অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে শেষমেশ আত্মহত্যা করেছে। আমি তোর মধ্যে আমার বাবার ছায়া দেখতে পারছি, ভাইয়া। আমার মায়ের পাশে তখন কেউ ছিল না। তবে ভাবীর পাশে আমি আছি। আমি ভাবীকে মরতে দেবো না।"

অধরা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে হিয়ার দিকে। আজ প্রথমবারের মত সে জানলো তার শ্বাশুড়ি তার শ্বশুরের অত্যাচারের জন্য আত্মহত্যা করেছে।

হিয়া তার ভাইয়ের হাতটা নামিয়ে দিল। রিয়াদ রেগে বলল,

"তুই বাইরের একটা মেয়ের জন্য ভাইয়ের সাথে এমন করবি!"

"আমি এতদিন তোকে চিনতে পারিনি, ভাইয়া। একটা মুখোশ পরে থাকতি। আজকে সেই মুখোশ খুলে গেছে। তোকে ভাই বলে ডাকতেও আমার লজ্জা লাগছে।"

রিয়াদ মাথা নিচু করে চলে গেল। হিয়া অধরার কাধে হাত রেখে বলল,

"এখন কী করবে, ভাবী?"

অধরা মৃদু হেসে বলল,

"তুমি আমার জায়গায় থাকলে কী করতে?"

হিয়া মুখ শক্ত করে বলল,

"আমি তোমার জায়গায় হলে তো পুলিশে কেস করে দিতাম।"

অধরা এবার শান্ত স্বরে বলল,

"আমিও সেটাই করব।"

হিয়া কাধ থেকে হাত নামিয়ে নিলো। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে হয়ত এমনটা হোক সেটা চায় না।

(সমাপ্ত)