হঠাৎই শরীরে গরম কিছুর স্পর্শে ঘুম ভেঙে গেলো। চোখ খুলে পাশে তাকালাম ছোট বোন ঘুমিয়ে আছে। কপালে হাত দিয়ে দেখলাম প্রচন্ড জ্বর। আমি কপালে হাত দিতেই তার ঘুম ভেঙে গেলো।
- ভাইয়া তুমি ঘুমাও নি!
- এখনই ঘুম ভেঙে গেলো পিচ্চি।
- আমার রুমে একা একা খুব ভয় করছে তাই তোমার রুমে চলে আসছি।
- তোমার তো অনেক জ্বর আসছে। তুমি আম্মুর সাথে গেলেই পারতে।
- আম্মু তো আমায় নেয়নি। তাই তোমার কাছেই চলে আসলাম। তুমি তো রাতে না খেয়েই ঘুমিয়ে গেছো।
বালিশের পাশে থেকে মোবাইলটা হাতে নিলাম। এখন এগারোটা বাজে। আম্মু কয়েকবার কল করছে কিন্তু ঘুমিয়ে থাকার জন্য বুঝতে পারি নি। সন্ধ্যায় মাথা ব্যাথা করছে জন্য একটু শুইছিলাম কিন্তু কখন ঘুমিয়ে গেছি বুঝতেই পারিনি। আম্মুও আজ বিকেলে মামার বাসায় গেছে কিন্তু পিচ্চিটাকে আবার রেখে গেলো কেন সেটাই বুঝলাম না।
- এই পিচ্চি ঔষধ খাইছো?
- বাসায় তো ঔষধ নাই ভাইয়া।
- আচ্ছা আমি ঔষধ নিয়ে আসছি।
- তুমি আগে খেয়ে নাও তারপর ঔষধ নিয়ে এসো।
- ততক্ষণে দোকান বন্ধ হয়ে যাবে। তুমি রেষ্ট করো আমি গলির মোড় থেকে ঔষধ নিয়ে আসছি।
তখনই উঠে বের হলাম ঔষধ আনার জন্য । শহর নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে দুই একটা দোকান খোলা। যদিও বা কয়েকটা দোকান খোলা থাকতো কিন্তু টুপটুপ বৃষ্টি হচ্ছে জন্য সেগুলোও তাড়াতাড়ি বন্ধ করে সবাই বাসায় চলে গেছে । দূর থেকে দেখলাম একটা দোকান বন্ধ করছে । আমি তৎক্ষনাৎ দৌড়ে গিয়ে ঔষধ নিয়ে বাসার দিকে রওনা দিলাম।
কিছুক্ষণের মাঝেই বাসায় চলে আসলাম। এই টুপটাপ বৃষ্টিতেই পুরোটা ভিজে গেছি। রুমে এসে দেখি পিচ্চি কাঁপছে।
- জ্বর কি খুব বেশি বাড়ছে!
- আমার খুব শীত করছে ভাইয়া। তাতেই আবার বৃষ্টি নামছে। আমি পুরো ভিজে যাচ্ছি তো। আমায় একটা ছাতা দিবা ভাইয়া!
- পাগলী বোন আমার তুমি তো রুমে এখানে কিভাবে ভিজবে। আচ্ছা ঠিক আছে কাল তোমায় নতুন একটা ছাতা কিনে দিবো। এখন ঔষধ টা খেয়ে নাও।
আমি একহাতে ঔষধ একহাতে পানি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি।
- তুমি ওগুলো টেবিলে রেখে দাও আমি খেয়ে নিচ্ছি। তুমি বরং গিয়ে রাতের খাবার টা খেয়ে নাও।
- ঔষধ এখানে রাখলাম এসে যেন দেখি খেয়ে নিয়েছ।
পিচ্চিটা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেঁসে দিলো। শরীর পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে এই শরীর নিয়েও এমন মায়াবী একটা হাসি দেওয়া যায় তা পিচ্চির থেকেই জানলাম।
খেতে খেতে আম্মুকে কল দিলাম । আম্মু ঘুমিয়ে গেছে। তাই কল রিসিভ করে ঘুম ঘুম কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো- কি করছো!
- এই তো খাচ্ছি । তুমি খাইছো?
- হ্যাঁ । কিন্তু এতো দেরী করে খাচ্ছো কেন?
- তুমি পিচ্চিরে সাথে নাও নি কেন? ওর ঠান্ডা লেগে জ্বর চলে আসছে । এই বৃষ্টিতে ভিজে ওর জন্য আবার ঔষধ নিয়ে আসতে হলো। ওকে ঔষধ খেতে দিয়ে আমি তারপর এসে খেতে বসলাম ।
আম্মু ওপাশে থেকে কিছু বলছে না। তবে আমার কানে কিছু শব্দ এলো যাতে আম্মু শুয়ে ছিলো এবং খুব ঝটপট করে উঠে বসলো।
- কি বললে তুমি!
এক মুহুর্তে আম্মুর কন্ঠ কেমন যেন স্বাভাবিক হয়ে গেলো। কন্ঠে সেই ঘুম ঘুম ভাবটা নেই। আচমকা আমার হাত থেকে মোবাইলটা খাবারের প্লেটে পড়ে গেলো। পুরো শরীর শিহরণ দিয়ে উঠলো। শরীর কাঁপতে শুরু করলো। মোবাইলটা যে হাতে ধরবো সেই শক্তিটাও আমার হাতে নেই । মোবাইলের ওপাশে থেকে আম্মু বার বার বলছে - সুমন! এই সুমন! হ্যালো! কি হলো কথা বলছো না কেন!
আম্মুর বলা প্রতিটি শব্দই কানে আসছে কিন্তু মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না। গলা শুকিয়ে কাঠ খড়ি হয়ে গেছে । মনের মাঝে একটাই কথা ঘুরছে আমার রুমে একা একা ভয় করছে তাই তোমার রুমে আসলাম। আমি বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছি তো আমায় একটা ছাতা দিবা ভাইয়া।
নিজের অজান্তেই দুচোখ দিয়ে পানি চলে আসলো। কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা নিয়ে রুমের দিকে পা বাড়ালাম। এক পা বাড়াচ্ছি তো আবার পিছিয়ে আসছি। চোখে যেন রাজ্যের বৃষ্টি জমা হয়েছে বার বার ঝপসা হয়ে আসছে । বুকের মাঝে অনেকটা সাহস নিয়ে দরজা ঠেলে রুমে আসলাম। পুরো রুম ফাঁকা ঔষধ গুলো যেখানে রেখেছিলাম ঠিক সেখানেই সেভাবেই আছে । আজ থেকে একমাস আগে বৃষ্টির জন্য রাতে ঔষধ নিয়ে আসতে পারিনি জন্য আমার কলিজাটা কে পৃথিবী ছাড়তে হয়েছিলো। সেদিন আমায় সকাল পর্যন্ত সময় দেয়নি পাগলীটা। একবুক অভিমান নিয়ে আমায় ছেড়ে গেছে । এখনো ফোনের ওপাশে থেকে আম্মুর কন্ঠ কানে আসছে - এই বাবা কি হয়েছে!
সমাপ্ত