আমি সন্ধ্যা বেলা পড়তে বসলেই পাশের ঘর থেকে দ্রিমদ্রিম মা'রের শব্দ কানে আসে। আপনাআপনি মুখে পৈ'শাচিক হাসি খেলে যায়। মুখ টিপে হেসে পড়ার শব্দ আরো বাড়িয়ে দেই। মা'রের শব্দও বেড়ে যায়। মা'রটা খায় নিরব ভাইয়া তার মায়ের হাতে। সম্পর্কে সে আমার চাচাতো ভাই। একদফা মা'রের পর চাচীর গলার স্বর পাওয়া যায়। এবারো তার বিপরীত হয়নি।
'সকাল থিকা গল্পের বই, গল্পের বই। পড়ার বই ধরবি কহন? ঐ ছোট মাইয়াডার থিকা কিছু শিখ। সন্ধ্যা হইতে দেরী ওর পড়তে বইতে দেরী না। তুই দামড়া পোলা হইয়াও পড়ার নাম নেস না। বুশরারে দেইখাও তো শিখতে পারোস। ওর পা ধুইয়া পানি খাবি তুই কালকের থিকা।'
পাশাপাশি ঘর হওয়ায় চাচীর সব কথাই আমার কানে আসে। তাছাড়া নিরব ভাইয়ার মা'রের শব্দ পেলেই কান খাড়া করে রাখি। সবকিছুতে নিরব ভাইয়ার সাথে চাচী আমাকে তুলনা করে।এতে আনন্দই লাগে। ধুপধাপ শব্দ শোনা যাচ্ছে। আমি দ্রুত পড়ার টেবিলে বসি। আমি ভালো করে জানি নিরব ভাইয়া আমাদের ঘরের দিকেই আসছে।একটু পরই সে জানলায় টোকা দিবে। নয়তো টিনে বারি মারবে।
'এই বুচি জানালা খোল।'
ভেবেছিলাম জানালা খুলবো না। কিন্তু ভাইয়ার ধাক্কানিতে অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও খুলতে হলো।আমি জানালা খুলে অবাক হওয়ার ভান করে জিজ্ঞেস করলাম,
'কি হয়েছে নিরব ভাইয়া?'
'তুই ইচ্ছে করে আমার সাথে এসব করিস।'
ভাইয়া ক্রোধে ফেটে পরছে। আমি দ্বিগুণ অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে বললাম,
'কোনসব?'
'এখন ন্যাকা সাজা হচ্ছে বুচি?'
'একদম বুচি বলবে না।আমার নাম বুশরা।'
'একশবার বুচি বলবো।'
'যাও তো এখন। আমার অনেক পড়া আছে।'
ভাইয়ার মুখের ওপর জানালাটা ঠাস করে লাগিয়ে দিলাম। বাইরে থেকে তার চাপা গর্জন শোনা গেলো।
'তোকে আমি দেখে নিবো বুচি।'
এতক্ষণ চেপে রাখা হাসিটা এবার বেরিয়ে এলো। ঘর কাঁপিয়ে হেসে বিছানায় লুটোপুটি খেতে লাগলাম। ভাইয়া যেভাবে ধুপধাপ এসেছিলো সেভাবে চলে গেলো।
সময় এখন ২০১০ সাল। শীতকাল চলছে।আমাদের অজপাড়াগাঁ -এ এখনো ইলেক্ট্রিসিটি আসেনি। কুপি,হারিকেন, মোমবাতি এখানকার ভরসা। আজ আর পড়লাম না। মা ডাকছে খাওয়ার জন্য। মা কে আমি অনেক ভালোবাসি। তাই তার ডাক অগ্রাহ্য করলাম না।তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পরলাম।
নিরব! নামের মতোই তার চরিত্র। ভীষণ শান্তশিষ্ট, ভদ্র ছেলে। একমাত্র পড়াশোনার কারণে চাচীর কাছে মার খাওয়া ছাড়া আর কোন বাজে অভ্যাস নেই।চাচী পড়াশোনা নিয়ে ভীষণ কড়াকড়ি। আর ভাইয়ার এই পড়াশোনা নিয়েই কোন চিন্তা নেই।তাই এতবড় হওয়ার পরেও চাচীর হাতে মার খায়।একমাত্র ছেলের পড়াশোনা নিয়ে এতো অনীহা দেখে চাচীর আফসোসের শেষ নেই। নিরব ভাইয়া আর আমার মধ্যে সাপেনেউলে সম্পর্ক।দুজন সবসময় চিন্তায় থাকি কাকে কখন অপদস্ত করা যায়।আমি এবার অষ্টম শ্রেণিতে, ভাইয়া দশম শ্রেণিতে। আমি পড়াশোনায় মোটামুটি ভালো হলেও নিরব ভাইয়া পুরাই ডাব্বা। সে বেশিরভাগ সময় গল্পের বই নিয়ে পড়ে থাকে। গল্প, উপন্যাস তার প্রাণ। তার সংগ্রহে আছে বহু বই। মাঝে মাঝে আমায় বলে,
'দেখিস বুচি, আমি একদিন অনেক বড় লেখক হবো।'
আমি ভেংচি কেটে হাতের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে উত্তর দেই,
'কচু হবা।'
আজ বিকেলেও পুকুর ঘাটে দেখা হলো নিরব ভাইয়ার সাথে। হাতে বিভূতিভূষণের 'পথের পাঁচালি' বইটা। আমি আড়চোখে একবার তার দিকে তাকিয়ে ক্রুর হাসি দিলাম। কোমড়ে হাত রেখে বললাম,
'আবার নতুন বই কিনেছো? চাচী জানলে ছেঁচবে তোমায়।'
নিরব ভাইয়া কপাল কুঁচকে বিরক্ত সুরে বললো,
' বিরক্ত করতে চলে এসেছিস?'
'এই গল্প, উপন্যাস পড়ে কি পাও তুমি বলো তো?'
'তুই বুঝবি না। যা ভাগ।'
'এবার পরীক্ষায় ফেল করলে চাচীকে দিয়ে যদি তোমার সব উপন্যাসের বই না পুড়িয়েছি তাহলে আমার নামও বুশরা নয়।'
ভাইয়া বইয়ের পাতা উল্টিয়ে চোখ গরম করে আমার দিকে তাকালো। আমি সেসবকে পাত্তা না দিয়ে ধপ করে তার পাশে বসলাম। বিরবির করে বললাম,
'ছেলেরা যে এতো বই পড়তে পারে তা তোমাকে না দেখলে জানতামই না।'
নিরব ভাইয়া বইটা বন্ধ করে পাশে রেখে আমার দিকে তাকালো। ভ্রু নাচিয়ে বললো,
'একটা জিনিস দেখবি বুশরা?'
আমি উৎসুক গলায় জিজ্ঞেস করলাম,
'কি?'
ভাইয়া হঠাৎ আমাকে ধাক্কা মেরে পানিতে ফেলে দিয়ে বললো,
'এই নে দেখ। গতকাল মায়ের হাতে মার খাওয়ার শাস্তি এটা।'
আচমকা এমন আক্রমণে আমি পরাস্ত হয়ে গেলাম। পুকুরে পরে কয়েক ঢোক পানি খাওয়া হয়ে গেছে। পরে যাওয়ার আগে কোমড়ের দিকে বেশ ব্যাথা পেয়েছি। ঘাটে দাঁড়িয়ে ভাইয়া পেট ধরে হাসছে।তার হাসি দেখে অভিমানে আমার ভীষণ কান্না পেলো। আমাকে এভাবে দেখে ভাইয়া হকচকিয়ে গেলো।ব্যস্ত হয়ে পাড়ের কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো,
'এই বুচি কাঁদছিস কেন? কোথাও লেগেছে?'
আমি ডুব দিয়ে উঠে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি চলে গেলাম। ভাইয়া পিছু পিছু এসেও আমায় নাগাল পেলো না। সেদিনও চাচীকে বিচার দিয়ে নিরব ভাইয়াকে আচ্ছা মার খাওয়ালাম। এরপর থেকে আমি ভাইয়াকে এড়িয়ে চলি। মার খাইয়েও মন শান্ত হয়নি আমার।তাই তার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিলাম। ইনিয়েবিনিয়ে ভাইয়া কোন কথা বলতে আসলেও আমি কথা বলি না।
মাঝে আমার বাবার সাথে নিরব ভাইয়ার বাবার জমিজমা নিয়ে ঝামেলা লাগলো। বিশাল ঝামেলা!কথা কাটাকাটি থেকে শুরু করে হাতাহাতিতে গিয়ে ঠেকেছে। অল্পর জন্য খুন-খারাবি হয়নি। এরপর থেকে আমরা আলাদা হয়ে গেলাম। বাবা নিরব ভাইয়ার সাথে আমাকে মিশতে মানা করে দিলো। তেমনি চাচাও নিরব ভাইয়াকে বললো। উঠানের মাঝে টিনের বেড়া দেওয়া হলো। যাতে কেউ কারো মুখ দেখতে না পারে।আসলে এই ঝামেলায় বাবার দোষ ছিলো। সে অন্যায় ভাবে চাচার জমি দখল করতে চাইছে।
রাতে আব্বুর রুমের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আব্বু আর বড় ভাইয়াকে ফুসুরফাসুর করতে শুনলাম।তাদের কথা শুনে আমি থমকে দাঁড়ালাম। আমাকে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দুজন ভড়কে গেলো। ভাইয়া ধমক দিয়ে বললো,
'এখানে কি? বড়রা কথা বলার সময় ছোটদের থাকতে নেই জানিস না?'
আমি উত্তর না দিয়ে দরজা থেকে সরে গেলাম। তবে আড়াল হয়ে রইলাম। আড়ি পাতা আমার অন্যতম একটা বদঅভ্যেস। তাদের সব কথা শুনে ফেললাম।
পরদিন সকালে বাসার সবার অগোচরে চাদর মুড়ি দিয়ে বের হলাম। নিরব ভাইয়ার ঘরের জানালায় টোকা দিলাম। পেছন থেকে নিরব ভাইয়া বললো,
'কিরে বুচি তুই কি চুরি করার ধান্দায় আছিস? '
ভয় পেয়ে দুই কদম পিছিয়ে গিয়ে বললাম,
'ওহ্ তুমি এখানে? আমি আরো ভাবলাম ঘরের ভেতর বোধহয়।'
সকাল সকাল বাড়ির কোণার দিকে ভাইয়ার হাটাহাটি করার অভ্যাস আছে। টেনশনে আমি ভুলেই গেছিলাম। ভাইয়া থমথমে গলায় বললো,
'ঘরে যা বুশরা। আমার সাথে তোকে দেখলে চাচা অনেক মারবে।'
আমি আহত দৃষ্টিতে ভাইয়ার দিকে তাকালাম। ঘন কুয়াশায় ভাইয়ার মুখ আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে। তাতে দেখলাম ভাইয়ার চোখ দুটো টলমল করছে। হঠাৎ গতকালের কথা মনে আসতেই আমি বললাম,
'নিরব ভাইয়া তোমার সাথে আমার অনেক জরুরি কথা আছে।আসলে........'
পুরো কথা শেষ হওয়ার আগে কোণার দিক থেকে কে যেনো নিরব বলে ডেকে উঠলো। নিরব ভাইয়া দ্রুত গতিতে সেদিক যেতে যেতে বললো,
'ফিরে এসে তোর সব কথা শুনবো বুচি। কে যেনো ডাকছি দেখে আসি।'
আমি তাকে আটকানোর আগেই সে দৌড়ে বাড়ির ঢালু দিয়ে ধানক্ষেতের আইলে নেমে গেলো। ঘন কুয়াশায় আমি আর কিছু দেখতে পেলাম না। বারবার চিৎকার করে বলতে চাইছিলাম,
'ভাইয়া তুমি যেও না। তোমার সাথে আমার কথা আছে!'
কিন্তু কিছু বলতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিলো কেউ টুটি চেপে ধরে রেখেছে। "ফিরে এসে তোর সব কথা শুনবো", কথাটা এখনো কানে বাজছে। আসলেই কি ভাইয়া আমার সব কথা শোনার সময় পাবে?
আজ দুদিন হলো নিরব ভাইয়া নিখোঁজ। সেদিন সকালের পর তাকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না। হঠাৎ সকাল ১০টার দিকে খবর এলো নিরব ভাইয়ার লাশ পাওয়া গেছে উত্তরের ধানক্ষেতে। সবাই হুরমুর করে সেদিকে ছুটলো। শুধু আমি দরজার চৌকাঠে ঠায় বসে আছি।আকাশের দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বললাম,
'আমাকে ক্ষমা করো নিরব ভাইয়া।তোমাকে আমি বাঁচাতে পারলাম না।এখনো কাউকে আমি কিচ্ছু বলতে পারবো না। আমি যে নিরুপায়।সম্পদের নেশা মারাত্মক।এতে মানুষ অন্ধ হয়ে অমানুষে পরিণত হয়।যে মানুষ সম্পত্তির জন্য নিজের ভাতিজাকে মারতে পারে, সে নিজের স্ত্রী-সন্তানকেও মারতে পারবে।গতকাল বাবা মায়ের গলায় বটি ধরে আমাকে শাসিয়ে বলেছে যদি আমি কাউকে কিছু বলি তাহলে আমার মা-কে মেরে ফেলবে। তোমাকে হারিয়েছি ভাইয়া, মা কে হারাতে পারবো না।'