Posts

চিন্তা

চীনের রেড গার্ড,সাংস্কৃতিক বিপ্লব ও বাংলাদেশের জুলাই নৈরাজ্য

October 2, 2024

Afsana Kishwar

228
View

পরিবর্তন মানব সভ্যতার টিকে থাকার অঙ্গ।এ বদল কখনো সুদিন আনে,কখনো বা ঘোর ঘন অন্ধকার নিয়ে আসে।বাংলাদেশে ২০২৪ সালের ৭ জুলাই থেকে শুরু হওয়া নৈরাজ্য কত দেশের কত ঘটনার সাথে যে সামঞ্জস্যপূর্ণ তাই ভাবছিলাম।

চীনের কথা মনে হচ্ছিলো থেকে থেকে।নিজের মতবাদ জিইয়ে রাখা,নিজের ক্ষমতা পোক্ত করা এ নিয়ে মাও সে তুং কত কি ই না করেছে ১৯৬৬-৭৬ সাল পর্যন্ত!

মাও সে তুং এই দীর্ঘ এক দশক যা ঘটিয়েছে তাকে পরবর্তীতে তার দেশের মানুষ 'বিপর্যয়' হিসেবে মূল্যায়িত করেছে। 

১৯৫৯ সালে মাও এর গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ড কর্মসূচী শেষ হয়।এই কর্মসুচী চলার কারণে ৪ কোটি মানুষ মারা যায় দুর্ভিক্ষে। এ সময় মাও কে গণচীনের চেয়ারম্যান পদ থেকে ইস্তফা দেয়ানো হয়।ইস্তফা দিলে কি,অন্তরে তো একই বাসনা দেশের প্রধান থাকা।

১৯৬৬ সালে মাও বলে বসেন পার্টি চলছে পুঁজিবাদের মন্ত্রে সুতরাং দেশ ভুল পথে যাচ্ছে।নিয়ে আসেন দেশকে সঠিক পথে চালানোর মন্ত্র-দল শুদ্ধ করার জন্য বিপ্লবী চেতনার পুনর্জাগরণ লাগবে তা করতে হলে চারটি পুরোনো জিনিসের বিরুদ্ধে করতে হবে লাগাতার যুদ্ধ-

☞পুরানো অভ্যাস

☞পুরানো ধ্যান ধারণা

☞পরানো ঐতিহ্য

☞পুরানো সংস্কৃতি

➤এ পর্যন্ত পড়ে দাঁত বের হয়ে গিয়েছে আমার মতো আপনারও?রুকো জারা।এটাই হলো সুদিইউনুচের রিসেট বাটন আর কি।

মাও এই সালশার নাম কি দিলেন?Great Proletarian Cultural Revolution তথা সাংস্কৃতিক বিপ্লব।

বিপ্লবের প্রধান চালিকাশক্তি কারা?তরুণ।

➤পেলেন আবার সুদিইউনুচকে মাও হিসেবে?

মাও এর আহবানে লক্ষ লক্ষ তরুণ তরুণী ঝাঁপ দেয়,সেকালে ইন্টারনেট না থাকায় তরুণরা পায় লক্ষ লক্ষ লাল রঙের ছোট পুস্তিকা,যা ছিল মাও এর বাণী সংকলন।

➤২০২৪ সালের জুলাইয়ের আগে থেকে বাংলাদেশের তরুণরা পায় হি&যবুত তাহরীর খিলাফতের নকশা,দৃকের শহীদুলের তত্ত্বাবধানে দেবাশিষ চক্রবর্তীর করা ফটোকার্ড লাল রঙের,হি&যবুতের মাহফুজ আলমের পাঠচক্রে তালাল আসাত,আহমদ ছফা ইত্যাদি,সারোয়ার তুষারের চিন্তার অর্কেস্ট্রা,ফরহাদ মাজহার তথা  গুরুবাবা'র বাণী,মোস্তফা সারোয়ার ফারুকী গং এর ভিডিও ক্লিপিং এবং অজস্র প্রোপাগান্ডা মেশিনের ক্রমাগত ছুঁড়ে দেয়া বোলিং।

লাল পুস্তিকার মাধ্যমে রাতারাতি সারা চীনে এ আন্দোলন ছডিয়ে পড়ে।ছাত্ররা,স্কুলের বাচ্চারা হাতে লাল রঙের ব্যান্ড পরতে শুরু করে।এই তরুণদের নিয়ে তৈরী হয় রেড গার্ড নামের প্যারা মিলিটারি বাহিনী।

➤আমাদের তরুণরা পরেছে জাতীয় পতাকার ফেট্টি,এখন পরছে আইসিসের পতাকার ফেট্টি।আমাদের তরুণেরা তৈরী করেছে 'বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সমন্বয়ক কমিটি'যা আদতে প্যারা মিলিটারির রিপ্লেসমেন্ট।

রেড গার্ডের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয় পুরানো সবকিছু-প্যাগোডা,গির্জা,মসজিদ,কনফুশিয়াসের মতাদর্শের বই,ম্যাগাজিন,ঐতিহাসিক বই,জাদুঘর,পুরাকীর্তি,ঐতিহাসিক শিল্পকর্ম সব মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়ে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে রেড গার্ড।ধ্বংস করে দেয় বহু বাড়িঘর,আসবাবপত্র। নির্মমতা নেমে আসে শিক্ষক,বুদ্ধিজীবী,সরকারী কর্মকর্তা এবং ভূস্বামীদের উপর।তাদেরকে প্রতিবিপ্লবী এবং বুর্জোয়া আখ্যা দিয়ে প্রকাশ্যে রাস্তায় অপমাণ করা হতো,শারীরিকভাবে লাঞ্জিত করা হয়,অনেককে হত্যাও করা হয়।

এই অভিযানে তিব্বতীয় বৌদ্ধ,হুই এবং মঙ্গোলীয়সহ অন্য জাতি ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা চরম ক্ষতির সম্মুখীন হয়।মাওয়ের স্ত্রী রেড গার্ড সদস্যদের বলেন প্রয়োজন হলে সেনাবাহিনীর স্থলে নিজেদের প্রতিস্থাপন করে ফেলতে।

➤দারুণ সব খাপে খাপ মিল পাচ্ছেন না?হুম,আমিও পাচ্ছি।এ লেখাটা মূলত রোয়ার বাংলায় প্রকাশিত সাইদুল ইসলাম আবিদের লেখা। আমি আপনাদেরকে তার লেখা সংক্ষেপ করে গল্পটা বলছি আর কি যেন মজা পান।

তারপর কি ঘটে?ওরে বাবা রেড গার্ডকে আর নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।প্রতিবিপ্লবী ও বুর্জোয়া মারার পাশাপাশি নিজেরা নিজেদের ভেতর মারামারি শুরু করে।মাও এ থেকে কেমনে বাঁচা যায় ভাবতে ভাবতে রেড গার্ডের অনেককে প্রত্যন্ত অঞ্চলে কৃষিকাজ করতে পাঠানো শুরু করেন।

এভাবে সারা দেশে নৈরাজ্য জারি রেখে মাও তার প্রিয় ক্ষমতা পেয়ে যান আবার,তার সাথে থাকে তার প্রধান সহকারী সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান লিন বিয়াও।একটু থিতু হয়ে বসেই মাও বিবাদে জড়িয়ে পড়েন লিন এর সাথে।এরপর মাও লিন কে ১৯৭১ সালে সপরিবারে হত্যা করেন।

মাও অসুস্থ হলে ক্ষমতা যায় মাওয়ের স্ত্রী জিয়াং কিং ও তার তিন সহযোগীর হাতে।১৯৭৬ এ মাও মৃত্যুবরণ করলে দশক ধরে চলা সাংস্কৃতিক বিপ্লব নামক নৈরাজ্যের অবসান ঘটে।

ধারণা করা হয় এ বিপ্লবে সারা দেশে ১৫ লাখ লোক নিহত হয়।অর্থনীতি হয় বেহাল।এই এক দশক সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় চীনা তরুণরা আনুষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে থেকে যায়।শিক্ষক,বুদ্ধিজীবী,বিজ্ঞানী এবং প্রকৌশলীসহ বিভিন্ন পেশাজীবী যাদের হত্যা করা যায়নি তাদের কারাগারে প্রেরণের ফলে,লেবার ক্যাম্পে পাঠানোতে শিক্ষা এবং গবেষণাক্ষেত্রে এক বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি হয়।

১৯৮১ সালের সরকার এই এক দশককে 'বিশৃংখলার দশ বছর' হিসেবে আখ্যায়িত করেন।

রেড গার্ডের প্রাক্তন এক সদস্য সু বিবিসিকে বলেন,সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় আমার বয়স ২০।বাড়ি বাড়ি ঢুকে আমরা পুরানো যা পেলাম ভেঙে ফেললাম।যারা কথা শুনে না তাদের প্রকাশ্যে অপমাণ করলাম,শারীরিকভাবে লাঞ্জিত করলাম।শিক্ষকরা ছিল মূল টার্গেট।তাদের আমরা লেকচার হলে গালাগালি করতাম,গাধার টুপি পরাতাম,কলমের কালি খাইয়ে দিতাম,থুতু মারতাম,মারধোর তো করতামই,কাউকে কাউকে মেরেও ফেলতাম।১৯৬৮ সালে সু পালিয়ে হংকং এ চলে যান।তার মতে সাংস্কৃতিক বিপ্লব একটা মানবিক ট্রাজেডি।

➤বাংলাদেশে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ৪৯ জন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শিক্ষককে পদত্যাগ করানো হয়েছে সরকারী হিসেবে।সংখ্যালঘু নির্যাতন,আদিবাসী নির্যাতন,হত্যা,লুটতরাজ,সব ঐতিহাসিক স্থাপনা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়া লাগাতার চলছে।ওয়াকার বা মাহফুজকে সুদিইউনুচ কবে খেয়ে দেবে লিনের মতো সেটা দেখার বিষয়।

মূল গল্প হচ্ছে নৈরাজ্য চালু রেখে নিজের ক্ষমতা সংহত রাখা।সেখানে লেখাপড়া পুনরায় চালু,অর্থনীতি পুনরুদ্ধার,আইন শৃংখলা পরিস্থিতি উন্নত করা,পুলিশ বাহিনীর সদস্য যাদের হত্যা করেছে হি&যবুত শি&বির নামক জঙ্গী ক্যাডাররা সে স্থলে শি&বির হি&যবুতে ক্যাডার না নিয়ে প্রকৃত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শূন্যস্থান পূরণ,মব লিঞ্চিং বন্ধ করা,শত শত বন্ধ কারখানা চালু ইত্যাদি কিছুই হবে না।

আপনাদের রঙ লাল হয়েছে তীব্র আবেগে বা পয়সার বিনিময়ে অথবা ক্ষমতার খুদকুঁড়ো লাভের চুক্তিতে-আমাদের অনেকের রঙ মানবিক আছে দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণের চিন্তায়।

সময় খুব কম,আজকে এক এক এলাকায় হয়তো পাঁচ ছয়জন মেরে অন্যদের ভয় দেখাচ্ছে,লাশ দাফন করতে পারছেন।আগামীতে আর মাত্র ধরেন ১৪৮ দিন বা কমবেশি ৫ মাস পরে দেখবেন আরও ভয়ানক সব ঘটনা ঘটছে।তাই প্রস্তুত হয়ে যান,প্রতিরোধ গড়ে তুলুন।এই বিপর্যয়ের ভেতর স্বস্তি খুঁজে মূল্যবান ওয়াক্ত বরবাদ করবেন না।

Comments

    Please login to post comment. Login