পোস্টস

সমালোচনা

পাকিস্থানের ভয়াবহ বন্যা এবং উন্নত দেশগুলোর দায়

৩ অক্টোবর ২০২৪

Md. Rezaul Islam

মূল লেখক Md. Rezaul Islam

আমরা বর্তমানে একবিংশ শতাব্দীতে বসবাস করছি। শতাব্দী যত পরিবর্তিত হচ্ছে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ আমাদের সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে।জলবায়ু পরিবর্তন এর মধ্যে অন্যতম প্রধান একটি চ্যালেঞ্জ।এটি মোকাবেলায় আমাদের রীতিমত হিমশিম খেতে হচ্ছে।বিশ্বকে সাধারণত তিনটি ভাগে ভাগ করা হয় যেমনঅনুন্নত, উন্নয়নশীল এবং উন্নত।অবাক করার মত বিষয় হল, এই উন্নতদেশগুলোর একে অন্যের সাথে বিরামহীন প্রতিযোগিতার ফলে অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ভুগতে হচ্ছে।বর্তমান প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের বন্যা পরিস্থিতি তার বাস্তব একটি উদাহরণ।

 

দক্ষিণ এশিয়ার একটি উন্নয়নশীল দেশ পাকিস্তান।জলবায়ু পরিবর্তন যেসব দেশকে সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ করছে পাকিস্তান তাদের মধ্যে অন্যতম।২০২০ সালে গ্লোবাল ক্লাইমেট ইনডেস্ক তাদের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। প্রতিবেদনের তথ্যমতে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্বে ক্ষতিগ্রস্থ দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তানের অবস্থান ৫ম।বিগত বিশ বছরে অর্থাৎ ১৯৯৮-২০১৮ সালের মধ্যে ১৫২টিপ্রাকৃতিক দুর্যোগে তাদের প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার অর্থনৈতিক ক্ষতিসাধন হয়েছে এবং প্রায় দশ হাজার হাজার মানুষ অকালে প্রায় হারিয়েছেন।অথচ জলাবায়ু পরিবর্তনে পাকিস্থানের দায় ১ শতাংশেরও কম। 

 

যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জাপান এবং ইইউ-এরজনসংখ্যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার মাত্র ১২% হলেও তারাই ৫০% কার্বন নিঃসরণের জন্য দায়ি।অন্যদিকে একক দেশ হিসেবে চীন বিশ্বের সর্বোচ্চ কার্বন নিঃসরণকারী দেশ। চীনের জনসংখ্যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১৮% কিন্তু ১৮৫০ সাল থেকে যে পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ হয়েছে তার ১৪% শুধু চীন একাই করেছে।এমনকি চলতি বছরের প্রায় ৩১% কার্বন নিঃসরণের জন্য চীন একাই দায়ি।এভাবেই প্রায় ১৭০ বছর ধরে জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়েউন্নত বিশ্বগুলো পৃথিবীকে একেবারে খাঁদের কিনারায় নিয়ে দাঁড় করিয়েছে।

আবহাওয়াবিদরাবছরের শুরুতেই সতর্ক করেছিলেন ২০২২ সালে তীব্র গরমে পাকিস্তানে বন্যা এবং ক্ষরা হওয়ার সম্ভবনা অনেক বেশি।ঠিক তারই ধারাবাহিকতায়  ইউএস ন্যাশনাল সেন্টারস ফর এনভায়রনমেন্টাল ইনফরমেশনের গবেষণা অনুসারে, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সময়টি ক্যালেন্ডার বছরের ষষ্ঠউষ্ণতম বছর যা প্রায় ১৪৩ বছরের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। আরও ভয়াবহ তথ্য হল পাকিস্তানের অন্যতম প্রদেশ সিন্ধুর তাপমাত্রা এবছর ৪৯-৫১ ডিগ্রি সেলসিয়াসে এসে ঠেকেছে এবং গত মে মাসে পাকিস্তানে টানা ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। বিজ্ঞানীদের তথ্যমতে আবহাওয়া পরিবর্তনের দরুন পাকিস্তানে তাপপ্রবাহের আশংকা বেড়েছে প্রায় ত্রিশ গুণ। 

আমরা অনেকেই হয়ত জানিনা পৃথিবীর দুই মেরু ব্যতীত সবথেকে বেশি হিমবাহ পাকিস্তানে অবস্থিত। এজন্য পাকিস্তানের দক্ষিণ অংশকে “থার্ড পোল“ বলা হয়ে থাকে। হিমালয়, কারাকোরাম এবং হিন্দুকুশ পর্বতমালায় প্রায় ৫০ হাজার হিমবাহ রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৭ হাজারের বেশি হিমবাহশুধু পাকিস্তানের ভেতরই অবস্থিত। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে এসব হিমবাহ অতি মাত্রায় গলতে শুরু করেছে। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির গ্ল্যাসিওলজিস্ট মোহাম্মদ ফারুক আজম বলেন, “গ্রীষ্মের শুরুতে মার্চ এবং এপ্রিলে আমরা তীব্র তাপপ্রবাহ দেখেছি যা গত ১০০ বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে এবং আমরা হিমালয়ে রেকর্ডবরফ গলতে দেখেছি।“ জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচীর তথ্য মতে, পাকিস্তানের গিলগিত বালতিস্তান এবং খাইবার পাখতুনখাওয়ার হিমবাহ গলে যাওয়ার ফলে প্রায় তিন হাজার নতুন লেকের সৃষ্টি হয়েছে যার মধ্যে প্রায় ৩৩ টি লেকের পানি উপচে পড়ার সম্ভবনা রয়েছে। যার ফলে প্রায় ৭ মিলিয়ন মানুষ সরাসরি ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। 

পাকিস্তান আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, সিন্ধু প্রদেশে আগস্টের গড় বৃষ্টিপাতের চেয়ে এ বছর অনেক বেশি বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।  যার পরিমাণ ছিল ৭৮৪%।  একই অবস্থা বেলুচিস্তান প্রদেশেও।  সেখানে রেকর্ড করা হয়েছে প্রায় ৫০০%।  সমুদ্র পৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে মৌসুমি বৃষ্টিপাতের হার রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে। জলবায়ু মন্ত্রী শেহরি রেহমান জানান, “সাধারণত বছরে বৃষ্টির চক্র ৩/৪ টি হয়ে থাকে কিন্তু এ বছরে সেটা ৮ম ধাপ অতিক্রম করতে যাচ্ছে।“  তিনি আরো বলেন, “পরিস্থিতি এতই ভয়াবহ যে, “গ্রামগুলো দেখলে মনে হচ্ছে সমুদ্র এবং সেখানে পানি সেচে ফেলার জন্য কোন শুঁকনো জমি অবশিষ্ট নেই। হিমালয়ের রেকর্ড পরিমাণ হিমবাহ গলে যাওয়ার ফলে সিন্ধু নদীর পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়ে তীব্র বন্যার সৃষ্টি করেছে। দৈর্ঘ্যে  ফ্রান্সের দ্বিগুণ এই নদ এশিয়ার অন্যতম বৃহত্তম এবং পাকিস্তানের জাতীয় নদী। অন্যদিকে সোয়াত নদী প্লাবিত হয়ে খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশ বন্যার পানি তলিয়ে গিয়েছে। বন্যার ফলে সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে সিন্ধু, বেলুচিস্তান এবং খাইবার পাখতুনখাওয়া  প্রদেশ কারণ নদ-নদীর প্রধান শাখাসমূহ এই প্রদেশগুলোর মধ্য দিয়ে যেয়ে আরব সাগরে পতিত হয়েছে। পাকিস্তানের আবহাওয়াবিদদের তথ্যমতে , “এবারের বন্যা ২০১০ বা ২০১৭ সালের থেকেও বেশি ভয়াবহ। কেউ কেউ এই বন্যাকে নবী নুহ আঃ আমলের মহাপ্রলয়ের সাথেও তুলনা করছেন।“  

 

পাকিস্তানের কৃষকরা ৯০ শতাংশ ফসল উৎপাদনের জন্য সিন্ধু নদীটির উপর নির্ভর করে থাকেন কিন্তু বন্যার পানি তাদের সমস্ত ফসল তলিয়ে নিয়ে গেছে। দেশটির তিন ভাগের একভাগ বর্তমানে পানিতে নীমজ্জবিত। কৃষক আশরাফ আলি বলেন, “এই বন্যা তাদেরকে ৫০ বছর পিছিয়ে দিয়েছে।“ বন্যার পানিতে ঘর-বাড়ি ফসলি জমি, রাস্তা সব কিছু ভেসে গেছে। প্রায় ৩ কোটি ৩০ লাখ মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে যা পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৫% এবং মৃত্যুর সংখ্যা ১৫৫০ ছাড়িয়ে গিয়েছে। যার মধ্যে ৫৫১ জনই শিশু। প্রায় ২০ লক্ষ ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে যার প্রায় ৮২ হাজার সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। ফলে ৬৫ লক্ষ মানুষের জরুরী ভিত্তিতে সাহায্যের প্রয়োজন। খাইবার পাখতুনখাওয়ার এক বাসিন্দা জুনায়েদ খান আফসোস করে বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, “আমরা বছরের পর বছর ধরে পরিশ্রম করে ঘর বানিয়েছি আর এখন রাস্তায় বসে সেই স্বপ্নগুলোকে ডুবতে দেখছি।“

পাকিস্তানের ভঙ্গুর অর্থনীতি পরিস্থিতির মধ্যেই এই প্রলয়ংকারী বন্যা তাদেরকে আরো বেশি ক্ষতিগ্রস্থ করেছে। একদিকে করোনার প্রকোপ কাটিয়ে উঠতে না উঠতেরাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আরেকটি বড় ধাক্কা। ফলে দৈনন্দিন জিনিসপত্রের দাম আকাশ সমান। অন্যদিকে এই বন্যার ফলে সমস্ত জিনিসপত্র বিশেষ করে খাদ্য-পন্যের মুল্য আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। ইতিমধ্যে মাত্র ৮ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রার দেশটিতে শুধুমাত্র বন্যা কারনেই ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলার এবং ১০ বিলিয়ন ডলার তাদের এখনই প্রয়োজন যেটা দিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষকে সাহায্য করতে পারবে। 

ইতিমধ্যে জাতিসংঘ, আইএমএফসহ বিভিন্ন দেশ সাহয্যের হাত বাড়িয়েছে কিন্তু সেটা প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত নগন্য। কার্বন নিঃসরণকারী ধনী দেশগুলো আগেই প্রতিশ্রুতি  দিয়েছিল তাঁরা ২০২০ সাল নাগাদ বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলার দিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ দেশগুলোকে সাহায্য করবে এবং ২০৭০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণের হার শুন্যতে নামিয়ে আনবে। কিন্তু তাদের সেই প্রতিশ্রুতি কাগজে কলমেই সীমাবন্ধ থেকে যাচ্ছে। কারণ তাদের প্রতিশ্রুত অর্থ সহায়তা বছরে শতকোটি ডলার ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে আমাদের মত উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশসমূহ। তাই জাতিসংঘ এবং ক্ষতিগ্রস্থ দেশগুলোর সম্মিলিত কার্যকারী উদ্যোগই আমাদের এই ভয়াবহ বৈশ্বিক উষ্ণতা ঝুঁকির হাত থেকে রক্ষা করতে পারবে।