রাজনীতি হলো আর্ট অব ন্যারেটিভ। আপনি আপনার মতাদর্শের বয়ান কিভাবে জনগণের মাঝে তুলে ধরবেন এবং গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করবেন তার আলোকেই কর্তার ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে।
আমাদের কাছে মনে হয়েছে কথার জাদুতে এই এখন বিএনপি এগিয়ে আছে। গণ আন্দোলনের মুখে যেভাবে আওয়ামী লীগ রেজিমের পরাজয় হয়েছে, তাদের শীর্ষ নেতৃত্ব দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছে -তারপর থেকে দীর্ঘদিন তারা মোটামুটি নিরব আছে। আওয়ামী লীগের নেতা না হয়েও পারিবারিক ঐতিহ্যের সূত্র ধরে সজীব ওয়াজেদ জয় আটেপক্ষে দু চার কথা বলেছেন। দেড় দশক ধরে কোণঠাসা করে রাখা বিএনপির সাথে কাজ করতে চেয়েছেন। কিন্তু তার কথাগুলো দেশের রাজনৈতিক মঞ্চে কোনো সুস্পষ্ট বয়ান তৈরি করেনি।
উপরন্তু গতকাল আওয়ামী লীগের ফেসবুক পেইজে যে বিবৃতি দেয়া হয়েছে সেটিতেও গণ আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হয়নি।
আওয়ামী লীগ লিখেছে, 'আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদেরকে বলবো, দেশে এ পর্যন্ত সংঘঠিত সকল হত্যাকান্ড, লুটতরাজ, ভাংচুর, আগুন সন্ত্রাস, নির্যাতন, চাঁদাবাজি, অবৈধ দখলের সুষ্ঠ তদন্ত সাপেক্ষে, সর্বোচ্চ পেশাদারীত্ব দিয়ে দোষীদের বিচার নিশ্চিত করুন। নতুবা আপনারাও এর দায় থেকে মুক্তি পাবেন না।
আমরা হুশিয়ার করে বলতে চাই, সাধারণ মানুষসহ আমাদের নেতাকর্মীদের হত্যা বন্ধ ও হত্যাকারীদের অবিলম্বে গ্রেফতার করে বিচার করতে হবে এবং এখনই এই নারকীয় অত্যাচার, নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। কেউ যদি মনে করেন অত্যাচার, নির্যাতন করে আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করে দিবেন তাহলে তারা বোকার স্বর্গে বাস করেন। আওয়ামী লীগের শিকড় অনেক গভীরে, এই দেশের জন্মের সাথে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক।'
তারা অন্যায় অত্যাচারের বিচার করতে বলেছে। কিন্তু জুলাই ম্যাসাকার নিয়ে স্পষ্ট বার্তা দিতে পারেনি। হাজার মানুষ প্রাণ হারালেন, মারাত্মক জখম নিয়ে দুর্বিষহ জীবন যাপন করছেন তারও অধিক মানুষ। তাদের ব্যাপারে আওয়ামী লীগের বয়ান নেই। আওয়ামী লীগের নেতা, এমপি মন্ত্রী ও আমলাদের অগণন দুর্নীতি নিয়ে কোনো আওয়াজ নেই। অতএব এসব কথা গণমানুষকে টাচ করবে না।
অপরদিকে আজকে প্রথম আলোতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আওয়ামী লীগ ভোটে এলে আপত্তি নেই, তবে গ'ণহত্যার বিচার হতে হবে। এখানেই আওয়ামী লীগের চেয়ে এই মুহূর্তে বিএনপি এগিয়ে আছে। সাক্ষাৎকারের চুম্বকাংশে চোখ বুলাই...
প্রথম আলো: আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ব্যাপারে বিএনপির অবস্থান কী?
মির্জা ফখরুল: আওয়ামী লীগ যদি নির্বাচন করে, জনগণ সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে। আমি তো সিদ্ধান্ত দেওয়ার মালিক না। আমি নির্বাচন করব, অন্য দলগুলো করবে, জনগণ যাদের বেছে নেবে, তাদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।
প্রথম আলো: তাহলে কি আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিলে আপনাদের আপত্তি থাকবে না?
মির্জা ফখরুল: আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিতে চাইলে নেবে। কিন্তু যে ব্যক্তিগুলো গণহত্যা, দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অপকর্মের সঙ্গে জড়িত, তাঁরা যেন নির্বাচনে অংশ না নেন, সেটাই আমাদের বক্তব্য। কোনো দলের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে তো আপত্তি করার কিছু নেই।
প্রথম আলো: কিন্তু আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার আলোচনা উঠছে কোনো কোনো মহলে। এ ব্যাপারে আপনাদের অবস্থান কী?
মির্জা ফখরুল: না। আমরা চাই না, দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হোক। কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে আমরা নই। কারণ, আমরা গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাস করি। তবে আওয়ামী লীগের যাঁরা নানা অপরাধ করেছেন, যাঁরা গণহত্যা করেছেন, সেই ব্যক্তিরা রাজনীতি করতে পারবেন না, জনগণ সেটা চায়। তাঁদের অপরাধের বিচার করতে হবে। কিন্তু গণতন্ত্রে কোনো দলের রাজনীতি করার ক্ষেত্রে বাধা দেওয়া যায় না।
যে প্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ পরাজিত হয়েছে এমন একটা তাৎপর্যপূর্ণ রাজনৈতিক অবস্থানে থেকে যদি তারা জিতে যেত নির্ঘাত আন্দোলনকারীদের রাজনৈতিক সদিচ্ছা বাতিল বলে গণ্য করত। ক্ষমতা ছাড়ার আগে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করাটা তেমন ভুলের বড় নমুনা।
মির্জা ফখরুল ইসলাম পোড় খাওয়া রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তিনি জানেন দুর্নীতিপরায়ণ ও কর্তৃত্ববাদী শেখ হাসিনা রেজিমকে দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া দল আওয়ামী লীগকে মূল্যায়ন করা যাবে না। তৃণমূলের নিষ্ঠাবান কর্মীরা আওয়ামী লীগের প্রাণ, যারা কোনো লাভ ও লোভের মধ্যে ছিলেন না। রাজনীতি করবার অধিকার তাদের আছে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকার যদি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ভোট অনুষ্ঠানে গড়িমসি করে তবে ওই গুমোট অবস্থা পরিবর্তন করতে তৃণমূলের ত্যাগী আওয়ামী লীগ কর্মীদেরও বিএনপির লাগবে। বহুদলীয় গণতন্ত্রকে গলাটিপে রেখে একপাক্ষিক আন্দোলন দিয়ে টেকসই ফলাফল আসে না সেটি ভালো জানেন বর্ষিয়ান পলিটিশান মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
রাজনীতি মানে লাঠিয়াল বাহিনী সেজে বসে দম্ভ প্রকাশ করা নয়। সেবা মর্যাদায় সর্বমানুষের সম্পৃক্তি নিশ্চিত করতে চাইলে যুগপৎভাবে লাগবে দূরদর্শিতা ও মহানুভবতা। নিজেদের দোষ স্বীকার না করে কেবলই হাওয়ায় হুঙ্কার দিয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগ মিস্টার ফখরুলের কাছ থেকে এই সময়ের রাজনৈতিক পাঠ নিতে পারে।
লেখক: সাংবাদিক
০৪ অক্টোবর ২০২৪