পোস্টস

চিন্তা

জনযুদ্ধ নাকি ক্রুসেড প্রেক্ষিত একাত্তর

৫ অক্টোবর ২০২৪

ফারদিন ফেরদৌস

The liberation war was not a religious war, but a struggle for human rights.

ধর্মবোধ বা চেতনা মানুষের জীবনের অনিবার্য অনুষঙ্গ নয়। ধর্ম মানুষের নিজের উপলব্ধির বিষয়। এটি পালন বা না পালনের অধিকার মানুষের আছে। কিন্তু মানুষ ও দেশকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে মানবাধিকার লাগবেই। ওই বহুবিস্তৃত মানবাধিকারে ধর্ম একটা পার্ট মাত্র। মানুষ যদি স্বাধীন না হয়, ধর্মাচার তার কাছে বোঝা। সে জান বাঁচানোর জন্য বন্ধুর পথ দৌড়াবে নাকি প্রাণবান ও চিন্তাশীল হয়ে নিরবে-নিভৃতে ঈশ্বরের আরাধনা করবে?

বস্তুত বাঙালির রাজনৈতিক অধিকার মেনে নিতে অস্বীকৃতির ফল আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। কোনোমতেই ধর্মীয় স্বাধীনতা হরণের বিষয় নয় এটি।

'মুক্তিযুদ্ধকে আমরা কতটা প্রাসঙ্গিক রেখেছি' শীর্ষক নিবন্ধে লেখক মশিউল আলম ২০২১ সালের ১৬ মার্চ প্রথম আলোতে লিখেন, 'অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ব্যাপক বিস্তৃত বিষয়, যার মধ্যে স্বাধীন, সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক, আইনের শাসনভিত্তিক, সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদমুক্ত, বৈষম্যহীন বা সমতাভিত্তিক, শোষণহীন, সুখী, সমৃদ্ধ বাংলাদেশের সব স্বপ্ন নিহিত আছে।' মূলত এইসব চেতনা থেকেই একাত্তরের স্বাধিকার আন্দোলনে বুক চিতিয়ে লড়েছে আমাদের পরগণার লড়াকু‌ মানুষ। 

মোটাদাগে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে সংগঠিত মুক্তিযুদ্ধকে কোনোমতেই Crusade তথা Holy war আখ্যা দেয়া যায় না। ইসলামিজমের পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তান ঘরাণায় খুব বেশি প্রভেদ নেই। বরং ধর্মের মৌল স্পিরিট এক ও অভিন্ন। ওই অভিন্ন ধর্মের ভিত্তিতেই ভারত থেকে আলাদা রাষ্ট্র হয়েছিল পাকিস্তান। কাজেই একাত্তরকে ক্রুসেডে সীমাবদ্ধ করে দেয়ার আগে মিস্টার মাহফুজ আলম আপনার উচিত ছিল মার্কিন মহাফেজখানার তারবার্তাগুলো পড়ে আসা। এবং আপনি আরও পড়ে নিতে পারতেন কবি, সাহিত্যিক, সমালোচক ও সাংবাদিক হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ১৫ খণ্ডের 'বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র'। 
কোনো প্রামাণিক তথ্যভাণ্ডারই বাংলাদেশের লিবারেশন ওয়ারকে ক্রুসেড বলে মান্যতা দেয় না।

বাঙালি অথবা বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে মুসলিম জাতীয়তাবাদে গুলিয়ে দেয়াটা সংকীর্ণ চিন্তা। আপনি সুকৌশলে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, চাকমা, মারমার পরিসর বাংলাদেশ নামের একক চিন্তার বাইরে রাখলেন। যার কোনো বাস্তবভিত্তিক সারবত্তা নেই। দেশটা সবার। এমনকি মৌলভীবাজারের খাড়িয়া আদিবাসী চা শ্রমিক দুইবোন ক্রিস্টিনা ও ভেরোনিকা কেরকেট্টা, কেবলমাত্র যারা খাড়িয়া ভাষাটি বাঁচিয়ে রেখেছেন; তাদেরও।

প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মিস্টার মাহফুজ আলম আপনি প্রথম আলোকে বললেন, 'মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষার মধ্যে মানুষের মুক্তির যে স্বপ্ন ছিল, সেটা নিছক কোনো ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর জন্য ছিল না। আমি কেবল বলতে চাইছি, মুক্তির এই ঐতিহাসিক সংগ্রামে নিপীড়িত বাঙালি মুসলমানরা কেন এত বড় ভূমিকা রাখল, সেটা আমাদের বোঝা দরকার।'

এর আগে আপনি আবার বলছেন,
'১৯৭১ হয়েছিল বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায়ের দুটি বোঝাপড়া থেকে। ১৯৪৭ সালের আগপর্যন্ত ইসলামের সঙ্গে তার যে বোঝাপড়া ছিল, সেটা বদলে গিয়েছিল। তারা বুঝতে শুরু করল, বাংলার ইসলাম পাকিস্তানের ইসলামের সঙ্গে যায় না, এমনকি উত্তর ভারতের ইসলামের সঙ্গেও নয়। ফলে তারা পাকিস্তানি ইসলামের বিরুদ্ধে দাঁড়াল।'

আপনার কথার মধ্যেই বিরাট দ্বান্দ্বিকতা আছে। আপনি যেভাবেই ন্যারেটিভ দাঁড় করান আপনার আগের কথার সাথে পরের কথার সাযুজ্য থাকতে হবে। পরস্পর বিপরীত মেরুতে চলে গেলে ওই কথাটি আর আলোচিত বিষয়ানুগ থাকে না। আপনি বললেন, মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা নিছক কোনো ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর ছিল না। খানিক আগেই আবার বলছেন, ১৯৭১ হয়েছিল বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায়ের দুটি বোঝাপড়া থেকে।

আপনার আগের কথাটি যদি ধর্তব্যের মধ্যে রাখি তবে ওই আলোকে আমরা বলতে পারি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ নির্দিষ্ট কোনো সম্প্রদায়ের ধর্মরক্ষা বা ধর্মীয় বোঝাপড়া থেকে সংগঠিত হয়নি। আপনার কথার সমর্থনে কংক্রিট কোনো প্রমাণও হাজির করতে পারবেন না। কিন্তু আপনার বিস্তৃত চিন্তার আলাপকে আমরা সাধুবাদ জানাই। আপনি কথা বলবেন, বিপরীতে আমরাও বলব। সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে গণমানুষ। স্বাধীনতার মূল সৌন্দর্য তো এটাই।

লেখক: সাংবাদিক 
০৫ অক্টোবর ২০২৪