বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন মহাসচিব ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী ৯৪ বছর বয়সে গতকাল সচল পৃথিবীকে বিদায় বলে দিলেন। তিনি এখন অনন্ত অসীম মহাকালের যাত্রী। আমরা গভীর শোক ও শ্রদ্ধা জানাই।
দেশের বরেণ্য চিকিৎসক ও রাজনীতিবিদ এর আগে হাসি মুখে আরেকবার বিদায় বলেছিলেন ২০০২ সালের ২১ জুন। ২০০১ সালের ১৪ নভেম্বর দেশের ১৫ তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী। মুন্সিগঞ্জ-১ আসনের ৫ বারের সংসদ সদস্য মাত্র ৭ মাসের দায়িত্বপালন শেষে রাজনৈতিক কারণে বঙ্গভবনকে বিদায় বলে দেন। তাঁকে অভিশংসন করা হতে পারে এমন খবর অবহিত হওয়ার পরই তিনি হাসিমুখে দেশের সর্বোচ্চ শীর্ষ পদ ছেড়ে গিয়েছিলেন।
সেসময় বিএনপি চেয়ারপার্সন ও সরকারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া স্বেচ্ছায় তাঁকে রাষ্ট্রপতি বানাননি। উপযুক্ত প্রার্থী না পাওয়ায় বাধ্য হয়েছিলেন। এবং মিস্টার বদরুদ্দোজা চৌধুরী বলা যায় প্রকাশ্য সভায় রাষ্ট্রপতি পদ চেয়ে নিয়েছিলেন। জনাব চৌধুরী ওই পদ ছেড়ে যাওয়ার পর ২০০২ সালের ২৯ জুন খালেদা জিয়া গণমাধ্যমে বলেছিলেন, যে যত বড়ই হোক না কেন, ষড়যন্ত্র করে কেউ পার পাবে না এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তাদের শেকড় কেটে দেয়া হয়েছে।
বদরুদ্দোজা চৌধুরীর প্রতি বিএনপির তরুণ সংসদ সদস্যরা অনাস্থা দিয়েছিলেন। কারণ হিসেবে তারা বলেছিলেন:
রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরী কর্তৃক বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর কবরে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে না যাওয়া, আর দ্বিতীয়তঃ জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে উল্লেখ না করা।
তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এবং বিএনপির সিনিয়র নেতা সাইফুর রহমান বলেছিলেন, স্রষ্টার সাথে সৃষ্টি বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে না। কিন্তু তিনি (বদরুদ্দোজা চৌধুরী) জিয়াউর রহমানের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন বলে মি. রহমান মন্তব্য করেন।
পদত্যাগ করা প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে আরও বেশ কিছু অভিযোগ আমলে নিয়েছিল বিএনপি। তৎকালীন বিরোধী নেত্রী শেখ হাসিনাকে মুন্সিগঞ্জে স্বাগত জানিয়ে রাষ্ট্রপতির ছেলে এবং সংসদ সদস্য মাহী বি. চৌধুরীর তোরণ নির্মাণ। রাষ্ট্রপতির বিভিন্ন বক্তব্যে 'বাংলাদেশ জিন্দাবাদ' ব্যবহার না করা, কারণ 'বাংলাদেশ জিন্দাবাদ' বিষয়টি বিএনপি রাজনৈতিকভাবে ধারণ করে। রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিভিশন 'বাংলাদেশ টেলিভিশনে' রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরী বেশি সময় পাচ্ছেন বলেও অভিযোগ তোলেন বিএনপির কিছু নেতা। এ পর্যায়ে রাষ্ট্রপতির কভারেজ কমিয়ে দেবার জন্য প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে বিটিভিকে বলা হয়েছিল - এমন খবরও সেসময় সংবাদ মাধ্যমে উঠে আসে।
এছাড়া প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া আমেরিকায় চিকিৎসা শেষে দেশে এলে তাঁর শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর না নেয়া এবং
দলের মনোনীত হয়ে রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর মি. চৌধুরীর নিরপেক্ষ অবস্থান নেয়াসহ আরো বেশকিছু অভিযোগ তোলা হয়।
২০০৪ সালে বিএনপি ছেড়ে বিকল্পধারা নামে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন বদরুদ্দোজা চৌধুরী। ২০০৬ সালে বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে পদত্যাগ প্রসঙ্গে বদরুদ্দোজা চৌধুরী বলেন, "প্রথম কথা আমি দলের বিরুদ্ধে কোন কাজ করি নাই, আর দ্বিতীয়তঃ আমি তো দলে ছিলামই না! আমি তো নির্বাচনের আগেই পদত্যাগ করে এসেছি, সুতরাং আমি দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে যেভাবে কাজ করা উচিত ছিলো সেভাবেই কাজ করেছি।"
বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে উল্লেখ না করা প্রসঙ্গে অধ্যাপক চৌধুরী বলেন, "মরহুম জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভূমিকা সম্পর্কে আমি আমার বাণীতে বলেছিলাম। আমি তাঁর ঐতিহাসিক ভূমিকা সম্পর্কে বলেছি। এ ঐতিহাসিক ভূমিকা বলার ক্ষেত্রে দুটো বিষয় আছে। একটি ঘোষক এবং অপরটি যুদ্ধক্ষেত্রে থেকে যুদ্ধ করা। আমি বরং অনেক বিস্তারিত বলেছি। আর এক কথা বারবার বলতে হবে কেন?"
বাংলাদেশের রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যই এমন যে, এখানে নিরপেক্ষতার কোনো জায়গা নেই। পার্টি করলে ওই পার্টির প্রধানের মন বুঝে কাজ করতে হবে। যদিও পার্টি প্রধানের তোয়াজ বা স্তাবকতা পছন্দ করা উচিত না। তারপরও বিএনপিতে থেকে প্রেসিডেন্ট বদরুদ্দোজা চৌধুরী তবু নিরপেক্ষতা দেখানোর ইচ্ছা পোষণ করতে পেরেছিলেন। আওয়ামী লীগে অমনটা কেউ কল্পনাই করতে পারবে না। একটানা ৪৩ বছরের সভানেত্রীর ছত্রছায়া থেকে দলটি এখনো বের হওয়ার কথা কল্পনা করতে পারে না।
বিএনপির মিড লেভেলের এক কর্মী কাল বলছিলেন, অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীর মতো বর্ষিয়ান রাজনীতিবিদরা বিএনপি ছেড়ে যাওয়ায় বিএনপির আলাদা কোনো লাভ হয়নি। বরং সুপরামর্শ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। অপরদিকে মিস্টার চৌধুরীরাও নিজের মাতৃদল ছেড়ে অন্য দল গড়ে রাজনৈতিক মাঠে কিছুই করতে পারেননি। এই অর্থে বিএনপির রাজনীতিতে একীভূত থাকাটাই বরং চৌধুরী পরিবারের জন্য সমীচিন ছিল। তাতে দেশের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি ভিন্নতর হলেও হতে পারত।
আমরা অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীর পুণ্যস্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই।
তথ্যসূত্র:
বিবিসি বাংলা
প্রথম আলো
দ্য ডেইলি স্টার
লেখক: সাংবাদিক
৬ অক্টোবর ২০২৪