সাদেকের বাপ কই তুমি।এইনে আহো দেইখা যাও সাদেক কিমুন যানি করতাছে।
কি অইলো বইলা! বারান্দায় শুয়া আক্কেল। লাফ দিয়া ওঠলো । শুকনা চোখে তানু বিবির দিকে তাকাইয়া কইলো- " পোলার প্যাট বিষ করে? "
তানু বিবি কইলো ঘরে খাওন নাই তিনদিন। পোলাপান গুলা খিদাই কাতরাইতেসে।
আক্কেল আলি গরিব মানুষ। কামলা দেয়। দ্যাশে দূর্বিক্ষচলে। মজিবরের দোসরা দ্যাশোর সব খাওয়ন সিন্ডিকেট করছে। বাকশালি দূর্বিক্ষে আক্কেল আলি বৌ পোলাপান নিয়া খাওনের কষ্টে মরার মতো শুয়ে থাকে সারাদিন।
বেলা বারোটা বাজে। ভোর রাইতে কলমি শাক সিদ্ধ কইরা পোলাপানরে খাওয়াইছে তানু বিবি। তাও নূন ছিল না।
কাঁদু কাঁদু হইয়া তানু বিবি আক্কেলরে কইলো। পোলাডা প্যাটের বিষে মইরা গেলো। কিছু খাওনের জোগাড় করো। তিন দিন ধইরা এক শাক সিদ্ধ খাইতেসে। আক্কেল আলি এবার ওঠে দাঁড়াইল।
জীর্ণ দেহ। হাড্ডিগুলা দ্যাহা যায়। ছ্যেড়া লুঙ্গির গিট বেঁধে নদীর দিকে রওনা হইলো আক্কেল আলি।
দুইদিন ধইরা পরিবারের খাওন যোগাইতে না পাইরা। তীব্র কষ্টে আক্কেল আলি নদীর পাড়ে বইসা থাকে। মাঝে মাঝে বাড়িতে আহে। বইত্তে আইলেই তানু বিবি আহাজারি করে। খাওন নাই কইয়া। পোলাপান ৫ জন গলা ধইরা কয় আব্বা খিদা লাগছে। অথর্ব আক্কেলের তখন বুকটা ফাইটা চৌচির হইয়া যায়।
তাই আক্কেল আলির বাড়ি ভাল্লাগে না। নদীর পাড়ে বইসা থাকে আক্কেল আলি। জৈষ্ঠ্য মাস। গাজিখালি নদীতে পানি নাই। নদীর তলা ফাইটা চৌচির। তবুও এই ভরা দুপুরে আক্কেল আলি নদীর পাড়ে আসলো।
বইসা বইসা ভাবে "ছোট কালে এই নদীর পাড়ে করচা টুকাইয়া খাইতো আক্কেল। বর্ষাকালে নদীতে পানি আইলে ওরা গোসল করতো। বৈক্যালে দলবল নিয়া এই নদীতে সাঁতার কাইটা কত মজায় দিন কাটাইতো আক্কেল । তখন খাওনের কষ্টও আছিল না।
এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ কি মনে হইলো আক্কেলের - ওঠে দাঁড়াইল সে। তারপর সোজা জোরে জোরে হাটতে থাকলো আক্কেল "
আর শব্দ কইরা কইতে লাগলো আজকে খাওন আমি জোগাড় করমুই। কিছু দূর যাওয়ার পর গাছের শেকড়ে হোচট খেয়ে পড়ে গেল আক্কেল।
পরক্ষনেই লাভ দিয়া ওঠে- হাত পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখলো তেমন ব্যাথা পায় নাই। তবে মনের দুঃখে সেখানেই বসে বসে কাঁদতে লাগলো আক্কেল। কিছুক্ষন কাঁদার পর। মাটি থেকে ওঠে; যেই লুঙ্গির গিটটা বাঁধতে যাবে আক্কেল। অমনিই আক্কেল তার নাকে কাঁঠালের গন্ধ অনুভব করলো। তাড়াতাড়ি লুঙ্গির গিট বেঁধে গাছের কাঁঠালগুলো টিপতে লাগলো সে। দুই তিনটা টেপার পর পাকা কাঁঠাল স্পর্শ করলো আক্কেলের হাত।
অমনি শুকনো মুখে মিটমিটয়ে হেসে ওঠলো আক্কেল। যেন আল্লাহর কোন নেয়ামত পাইছে সে।
কিছু না ভেবেই কাঁঠালটা ছিঁড়ে গলার গামছা দিয়ে প্যাচাইয়া বাড়ির দিকে রৌনা হইলো আক্কেল আলি। হাঁটতে হাঁটতে ... মনে মনে শুধু তানু বিবির কথা ভাবতে লাগলো আক্কেল। তানু বিবি কতই না খুশি হইবো। অনেকদিন পর পোলাপান গুলা প্যাট ভইরা কাঁঠাল খাইতে পারবো। এসব ভাবতে ভাবতে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করলো আক্কেল।
তখনো তানু বিবি ওঠানে বইসা আছে। পাশে পোলাডা গুনগুনাইয়া কাঁদতেছে। বাড়িতে আক্কেল আলির উপস্থিতিতে - সবাই তার হাতের দিকে তাকাইলো। গামছায় মুড়ানো কিছু একটার জিনিস তার হাতে। সবার কৌতূহল দেখে হাসিমুখে আক্কেল আলি কাঁঠালের উপর থেকে গামছাটা সরাইয়লো। দৃশ্যমান কাঁঠাল দেখে সবাই হকচকিয়ে ওঠলো।
তানু বিবি এই নাও পোলাপানরে খাওয়াও - আক্কেল আলি বললো।
আক্কেলকে কোন প্রশ্ন না করেই তানুবিবি স্বামীর হাত থেইকে কাঁঠালটা নিয়া। কাঁঠালটারে ভাঙলো। ছেলেমেয়ে গুলা মায়ের চতুরদিকে গোল কইরা বইসা কাঁঠাল খাইতেছে।
এই দৃশ্য দেখে আক্কেল তৃপ্তি পাচ্ছে। তার মনে হচ্ছে ছেলে মেয়েগুলো ঐশ্বরিক কোন বস্তু তৃপ্তি সহকারে খাচ্ছে। আক্কেলের মনটা ভরে যাচ্ছে অভুক্ত সন্তানদের কাঁঠাল খাওয়াতে পেরে।
হঠাৎ আক্কেলের বাড়িতে হাবুমিয়ার আগমন। বাড়িতে ঢুকেই হাবু মিয়া বললো আক্কেল কইরে?
হাবু মিয়া রাগী লোক। সে কাউরে ছাড় দিয়া কথা কয় না। হাবু মিয়াকে দেখে আক্কেল আলি ভয় পাইয়া গেলো।
ওওওহহ! চোর তাইলে এইনেই আছে। চল। হাকি ব্যাপারির কাছে।
আক্কেল আলির আর কিছু বুঝতে বাকি রইলো না। আক্কেল আলি ওঠে " মৃদু কন্ঠে বললো চলেন হাবু ভাই !"
হাবু মিয়া আক্কেলের হাতটা খপ করে ধরে বললো চল তাইলে!
তারপর দুজনে হাঁটতে থাকলো। তানু বিবি কিছুটা ভয় পেয়ে - লম্বা গোমটা টেনে। গুনগুনিয়ে কাঁদতে কাঁদতে হাবু মিয়ার পেছনে ছুটতে থাকলো। তানু বিবিকে দেখে সাদেক বলে ওঠলো " মা আমিও যামু।" তানু বিবি কোন উত্তর না দিয়েই। হাবু মিয়ার পিছু নিতে লাগলো!
সন্তানেরা খাওয়া রেখে মায়ের পেছনে হাঁটতে লাগলো। তারা তখনো জানে না কি হয়েছে। তবে এতটুকু বুঝতে পারছে আজকে তাদের বাবার বিচার হবে। কারন হাবুর কন্ঠে হাকি ব্যাপারি নামটা সবাই স্পষ্ট শুনতে পাইছে।
হাকি ব্যাপারি গ্রামের মাতব্বর। বড় গেরস্ত। সব বিচার সালিশ উনিই করে। গ্রামের সবাই উনাকে মানে। উনারকাছে যাওয়া মানেই বিচার। এটা গ্রামের সবাই জানতো। সাদেকরাও জানে।
হাকি ব্যাপারি চেয়ারে বসে গল্প করছিলো। গ্রামের অন্য আন্য মাতাব্বরদের সাথে। আলোচনা হচ্ছিল মুজিবের বাকশাল নিয়ে। একনায়কতন্ত্র নিয়ে।
এমন সময় হাবু মিয়া আক্কেল আলিকে নিয়ে উপস্থিত হলো সেই আলোচনা সভায়।
আসসালামু আলাইকুম মাতব্বর সাহেব। ‘হাবু মিয়া সালাম দিলো ’-
“হাকি বেপারি সালামের জবাব নিলো।"
পরক্ষনেই ছোট মাতাব্বর বদরউদ্দিন হাবু মিয়াকে বললো। কি ব্যাপার হাবু! তুমি আক্কেলের হাত ধরে এখানে নিয়া আসছো ক্যান?
হাবু মিয়া রাগী গলায় বললো। মাতাব্বর সাহেব এই আক্কেল চোরা আমার গাছের কাঁঠাল চুরি করছে।
তখনই তানু বিবি ছেলেমেয়ে সহ সেখানে উপস্থিত হয়ে কথাটা শুনে ফেলল। আক্কেল আলি বৌ পোলাপানের সামনে লজ্জায় অঝোরে কাঁদতে লাগলো। তবে কান্নার কোন শব্দ নাই।
হাকি ব্যাপারি জিজ্ঞেস করলো। কি আক্কেল!
তুমি কি সত্যিই চুরি করছো?
জবাবে কান্নারত আক্কেল মিয়া মাটির দিকে তাকাইয়া হ্যা ' সূচক মাথা নাড়লো।
হাকি ব্যাপারি প্রত্তুত্যরে মোটা কন্ঠে বললো " তুমি কেন চুরি করলা!" আক্কেল?
পেছন থেকে তানু বিবি কাঁদতে কাঁদতে বেহুঁশ হইয়া গলা ছাইরা দিয়া কইলো - “আমিই উনারে চুরি করতে কইছি। আব্বাজান।”
এটা শুইনা ছোট মাতাব্বর বদর উদ্দিন বললো - বৌ তুমি মাইয়া মানুষ। মুরুব্বিদের সামনে অমন জুরে কথা কওন লাগে না। তাও আবার এমন লজ্জার কথা!
হাকি ব্যাপারি তানু বিবিকে অভয় দিয়ে বললো - বৌমা ভয় পেও না। তুমি বলো। কি হয়েছে আসলে?
তানু বিবি কাঁদতে কাঁদতে বলতে শুরু করলো -
" আব্বাজান ঘরে খাওন নাই তিন দিন। দ্যাষে আকাল পড়ছে। সাদেকের বাপ কামলা দিতে পারে না। তিনদিন পোলাপান গুলা শাক সেদ্ধ ছাড়া কিছুই খায় নাই। সাদেক প্যাটের বিষে কাতরাইতেছিলো। পোলাপানের কান্দন আমার আর সহ্য হইতেছিলো না। তাই আমিই কইছি। সাদেকের বাপ যাও চুরি কইরা হইলেও খাওন নিয়া আসো"
কথাগুলো শুনার পর হাকি ব্যাপারির চোখ বেয়ে পানি পড়তে লাগলো। আশ্রুসিক্ত তানুবিবির কন্ঠ তখন চিৎকার করে কাঁদছে। উপস্থিত সবাই চুপ। হাবু মিয়া মাটির দিকে তাকিয়ে আছে। আক্কেল আলি ক্রন্দনরত তানু বিবির মুখের দিকে তাকিয়ে নিস্তব্ধ হয়ে রইলো।
চোখ মুছে হাকি ব্যাপারি। বদরউদ্দিনকে বললো। বদু যাও; আক্কেলের ছেলে মেয়েদের খাওনের ব্যাবস্থা করো।
চেয়ার থেকে ওঠে হাকি ব্যাপারি। তানু বিবির দিকে তাকিয়ে বললো "বৌমা তুমি ছেলে মেয়েদের নিয়ে বাড়ির ভেতরে যাও"
বদরউদ্দিন তানুবিবি সহ আক্কেলের পোলা মাইয়া গুলারে বাড়ির ভেতরে নিয়া গেল।
এবার হাবু মিয়ার দিকে তাকাইয়া হাকি ব্যাপারি দৃপ্ত কন্ঠে বলে ওঠলো-
“হাবু তোমার বাগান থেইকা আরও দশটা কাঁঠাল আক্কেলের পোলা মাইয়ারে দিয়া দিবা; দুইদিন সময় দিলাম তোমারে। ” এরপরই -
' আক্কেলের দিকে তাকিয়ে হাকি ব্যাপারি আক্কেলকে বললো -"- আক্কেল বাড়ির ভেতরে যাও। আজকে তুমি আর তোমার পরিবার আমার অতিথি। "
হাবু মিয়া মিয়া তখনো মাথা নিচু করে আছে। সন্ধ্যার বর্ণিল অন্ধকার। মসজিদে মাগরিবের আজান হচ্ছে। হাকি ব্যাপারি হাবু মিয়াকে বললো “চলো হাবু আজকে তুমি আমার সাথে মাগরিবের নামাজ পড়বা।”
উপস্থিত সভার সবাই তখনো নির্বাক। হাকি ব্যাপারি সবার দিকে তাকিয়ে বললো চলো সবাই একত্রে নামাজ পড়ে আসি।
গ্রামের সকল মাতাব্বরদের শুধু মনে হতে লাগলো “ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিচার আজই হলো ”