পোস্টস

চিন্তা

একাল সেকাল তাপসী ঊর্মি ও রহমান হেনরী

৭ অক্টোবর ২০২৪

ফারদিন ফেরদৌস

শেখ হাসিনা রেজিমের সর্বশেষ তিনটি জাতীয় নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা ছিল। ২০১৩ তে ১৫১ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া, ২০১৮ তে রাতের ভোট এবং ২০২৪ -এ নিজেদের দলের মধ্যে ডামি নির্বাচনকে ডেমোক্রেসির কোনো সংজ্ঞা দিয়েই জাস্টিফাই করা যায় না। তার ওপর আওয়ামী লীগের টপ টু বটম নেতাকর্মীদের লাগাম ছাড়া দুর্নীতি ও লুটপাট সবাই দেখেছে দলদাস লীগার ছাড়া। এই কথাগুলো অকপটে ৫ আগস্টের আগে কেউ বলতে পারত না। কারণ দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ এতটুকু সমালোচনা সহ্য করত না। তাদের নোটিশে গেলেই অবধারিত জেল ও জুলুম। কটূক্তি বলে ভয়াবহ একটা টার্ম আবিষ্কার করে নিয়েছিল তারা। তাদের ডিকশনারিতে জমা রাখা তোয়াজ ও স্তাবকতার বাইরে গেলেই সকল শব্দবন্ধ কটূক্তির ছাকুনিতে ধরা পড়ে যেত। ওই ফাঁদে পড়লে 'ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের' অধীনে যেতে হতো জেলে।

অমন একটা ক্রান্তিকালে ঊর্মির মতো কোনো নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট যদি ফেসবুকে লিখতেন, 'বিনাভোটে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী আপনি যে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ন্যারেটিভ উপস্থাপন করেছেন, সেখানে বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া তাজউদ্দীন আহমদ এবং বঙ্গবন্ধুর পক্ষে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা দেয়া মেজর জিয়াউর রহমানকে বাতিলের খাতায় রেখেছেন কেন? এই একপেশে বয়ান আমরা মানি না।'

কী হতে পারত ওই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের দশা? ঊর্মি শুধু চাকরি খোয়াতেন তা নয়, আওয়ামী আরক্ষাবাহিনী ওঁর পিতা-মাতা চৌদ্দ গোষ্ঠীকে কালো কাপড়ে চোখ বেঁধে তুলে এনে দুই শ কিলোমিটার রাস্তা ঘুরিয়ে এনে জেলে পুরে দিত।  

এমন ঘটনা অহরহ ঘটেছে। এখন যারা ঊর্মিকে গ্লোরিফাই করে তেজস্বী আইকন হিসেবে উপস্থাপন করছেন তারা কবি রহমান হেনরীর চাকুরিচ্যুতির ঘটনায় কয় কথা বলতে পেরেছিলেন?

ইতোমধ্যে সবাই জেনেছেন, সরকারপ্রধানকে নিয়ে ফেসবুকে কবিতা লিখে চাকরি হারানো সিনিয়র সহকারী সচিব মো. সাইদুর রহমানকে পুনর্বহাল করেছে সরকার। তিনি ‘রহমান হেনরী’ নামে কবিতা লেখেন। ২০২২ সালের ১৩ জুন তাকে বরখাস্ত করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছিল।

কবিতা লেখার জন্য এভাবে চাকরিচ্যুত করাটা অন্যায় ছিল উল্লেখ করে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাকে চাকরিতে বহাল করায় আমি ন্যায়বিচার পেয়েছি। আমি যে কবিতাটি ফেইসবুকে পোস্ট করেছিলাম, সেই কবিতাটি কয়েক বছর আগের লেখা ছিল। কবিতার কোথাও শেখ হাসিনার নামও ছিল না। কিন্তু তারা বুঝে নিয়েছিলেন যে আমি শেখ হাসিনাকে নিয়ে লিখেছি।"

কবিতায় কী লিখেছিলেন জানতে চাইলে রহমান হেনরী জানান, “আমার কাছেও এখন কবিতাটা নাই। কবিতার লাইনটা এরকম ছিল, ‘আমি এক রাজপ্রাসাদের কাছে এসে দেখলাম এখানে ভয়ানক ডাইনিকে সম্রাজ্ঞী বলা হয়’।”

অন্তর্বর্তী সরকারের জামানায় রহমান হেনরীর মতোই আরেক ঘটনা ঘটেছে। গণমাধ্যমের খবর থেকে জানা যাচ্ছে, লালমনিরহাট জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার (নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট) তাপসী তাবাসসুমকে ঊর্মি (পরিচিতি নম্বর-১৯২৮৬) জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়েছে।

তাপসী তাবাসসুম ঊর্মি সম্প্রতি ফেসবুকে লেখেন, ‘সাংবিধানিক ভিত্তিহীন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন- রিসেট বাটনে পুশ করা হয়েছে। অতীত মুছে গেছে। রিসেট বাটনে ক্লিক করে দেশের সব অতীত ইতিহাস মুছে ফেলেছেন তিনি। এতই সহজ! কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গেছে আপনার, মহাশয়’।

পরবর্তীতে বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ পরিবেশিত হলে তিনি তার পোস্টটি অনলি মি করে দেন। কিন্তু ওই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তার বক্তব্যে অনড় থাকেন।

এখন প্রশ্ন হলো একজন সরকারি চাকুরে কি দেশের সরকার প্রধান বিব্রত হন এমন মন্তব্য প্রকাশ্যে করতে পারেন? এক কথায় উত্তর হলো না। রহমান হেনরী যেমন চাকরিরত অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীকে ডাইনি বলতে পারেন না (যদিও তিনি কবিতায় সরাসরি না বলে মেটাফোর ব্যবহার করেছিলেন), একইভাবে ঊর্মিও সরকার প্রধানের ক্ষণগণনার সময়সীমা বেঁধে দিতে পারেন না। এটা স্পষ্ট চাকরি প্রবিধান লঙ্ঘন। আপনি যদি সরকারি চাকরিতে নিজেকে বহাল রাখতে চান উপরের আদেশ নিষেধ মানতে বাধ্য। যে কারণে আওয়ামী লীগ আমলের আমলাদের ঢালাওভাবে চাকরিচ্যুত করতে পারেনি ইন্টেরিম গভমেন্ট। শেখ হাসিনার আদেশ বাধ্য হয়ে মেনেছেন এমন কথায় পার পেয়ে যাচ্ছেন সবাই।

কাজেই রহমান হেনরীর চাকরিচ্যুতি যেমন তাদের আইনে জায়েজ ছিল, একইভাবে মিজ তাপসী ঊর্মির বিরুদ্ধেও বিধিবদ্ধ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ এইসময়ও আইনগতভাবে সিদ্ধ।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকার সংবিধান সংস্কারের ঘোষণা দিয়েছেন। ওই সংস্কারে তিনি যদি এমন বিধিমালা সংযুক্ত করেন যে, এখন হতে সরকারি কর্মচারীরাও তার উপরস্থ কর্মকর্তা কিংবা শাসকদলের এমপি মন্ত্রীদের সমালোচনা করবার অধিকার রাখবে -সেটির ফলাফল যদি মানুষ, রাষ্ট্র ও সরকারের জন্য কল্যাণকর হয়; অমন বিধি হতেই পারে। তবে তার আগে মিজ ঊর্মিকে চাকরিবিধির প্রতি মান্যতা দিতেই হবে। আমরা কেউই আইনের উর্ধ্বে না।

কথাগুলো আওয়ামী লীগের পক্ষে গেছে বলে ঊর্মিকে সুকান্ত ভট্টাচার্যের 'আমি একটা ছোট্ট দেশলাইয়ের কাঠি' বানিয়ে দিচ্ছেন শেখ হাসিনার অনুসারীরা। তারা একবার ভাবুন তো আপনাদের অপজিট গ্রুপ রহমান হেনরীকে তাহলে কোন অভিধায় অভিষিক্ত করতে পারে?

মোদ্দাকথা হলো, আমাদের নিশ্চিতই বাকস্বাধীনতা রক্ষা করবার পক্ষে সরব থাকতে হবে। কিন্তু সেই অধিকারটি যেন রাষ্ট্রে বিদ্যমান আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করা সমীচিন না করে তোলে। তবে আমরা মনে করি আইনি কাঠামোর মধ্যে হলেও সরকারি লোকেদেরও বাকস্বাধীনতা থাকা উচিত।

লেখক: সাংবাদিক
৭ অক্টোবর ২০২৪