পোস্টস

সমালোচনা

প্রথম আলোকে প্রধান উপদেষ্টার সাক্ষাৎকার ০১

৯ অক্টোবর ২০২৪

ফারদিন ফেরদৌস

'জেলে না গিয়ে বঙ্গভবনে শপথ নিলাম' -শীর্ষক অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাক্ষাৎকারটি পড়লাম এবং শুনলাম। প্রথম আলোকে দেয়া সাক্ষাৎকারের প্রথম পর্বের সারবত্তা নিম্নরূপ:

প্রথম আলো: আপনার প্রথম কাজ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা। পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করা। এ ক্ষেত্রে আপনারা কতটুকু সফল হলেন?

ড. ইউনূস: চেষ্টা করছি। এখনো সফল হইনি। এখনো তো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। নানা রকম ব্যাখ্যা আছে। ব্যাখ্যার মধ্যে যেতে চাই না। কিন্তু এখনো উন্নতি হয়নি। কিঞ্চিৎ হয়েছে হয়তো। কিন্তু যে পর্যায়ে আসার কথা, সেই লেভেলে হয়নি। কাজেই আমাদের সার্বিক চেষ্টা হবে, ওটাকে আগে স্থির করা। এটা প্রথম কাজ। এটা না করলে তো বাকি জিনিস করতে পারছি না।

প্রথম আলো: একটা বড় পরিবর্তন হয়ে গেল। সুযোগ আগেও এসেছিল। ’৯০–এর এরশাদ পতন, কয়েকটা ভালো নির্বাচন, ২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন ইত্যাদি। তারপরও তো তেমন পরিবর্তন হয়নি। চরম স্বৈরতান্ত্রিক একটা সরকার পেলাম আমরা। আমরা তো শিক্ষা নিই না। এবার কি আমরা শিক্ষা নেব? আপনি কতটুকু আশাবাদী?

ড. ইউনূস: এই অন্তর্বর্তী সরকারের বড় বিষয় হলো সংস্কার। নির্বাচন তো যেকোনো সময় যে কেউ দিতে পারে। আছে নিয়মমাফিক দিলাম, কেউ ভোট চুরি করল, দখল করলাম। কিন্তু এবার হলো সংস্কার। সংস্কার মানে হলো অতীতে যা যা ঘটেছে, আমরা সেগুলোর পুনরাবৃত্তি হতে দেব না। এটার জন্য আমাদের বুদ্ধিতে যতটুকু কুলায় ১০০ ভাগ হয়তো হবে না, তবে কাছাকাছি যতটা যাওয়া যায়, সারা জাতিকে একত্র করে করতে হবে। গায়ের জোরে নয়। অন্তর্বর্তী সরকার বসে কিছু করবে না। সবাইকে নিয়ে করবে। আপনারা বলেন, কী হলে সে জিনিসগুলো ভবিষ্যতে হবে না, সে জিনিসগুলো দিন। আমরা সবাইকে বোঝাই, রাজনৈতিক দলগুলোকে বোঝাই, বলেন আপনারা কী কী সংস্কার করতে চান। এ সুযোগ কিন্তু আপনারা আর পাবেন না। নির্বাচিত সরকার এসে গেলে এ সুযোগ আর পাবেন না। সম্ভব হবে না। আইনতই সম্ভব হবে না। আমাদের দিয়ে সেটা করিয়ে নিতে পারেন। যেমন সংবিধান সংশোধন। পারবেন না। এটা আমাদের দিয়ে করিয়ে নিতে পারবেন। আপনাদের কাজটাই আমরা করে দেব। আমরা একটা খসড়া বানিয়ে দিচ্ছি আপনাদের। কাজের সুবিধার জন্য। এটা ছিঁড়ে ফেলে দিন। আরেকটা বানিয়ে নিন। আমাদের আরেকটা দিন। আপনাদের নিয়ে করি।

বস্তুত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক ও স্থিতিশীল নয়। গণ-আন্দোলনে শক্তপোক্ত রেজিম হটানোর গতিজড়তা থেকে আমরা কেউই মুক্ত হতে পারিনি। চারিধারে কথায় কথায় সবাই রেগে যাচ্ছে। একে অপরকে নিশ্চিহ্ন করতে চাইছে। রাস্তায় নামছে। মহাসড়কে মানুষ ও যান চলাচল বন্ধ করে দিচ্ছে। মব ভায়োলেন্স উদযাপন করছে মানুষ। পাহাড়ে বন্ধ হয়ে গেছে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কঠিন চীবরদান অনুষ্ঠান। দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে সেনা প্রহরায়।

এই অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে সভ্য সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হওয়া খুব সহজ কথা নয়। গেল তিপ্পান্ন বছরে আমাদেরকে শেখানো হয়েছে, 'আমি কি তোমার চেয়ে কম বুঝি?' লোকের বড় বলা থোড়াই কেয়ার করা বাঙালি আপনাকে বড় বলা নিয়ে ব্যস্ত। মহাত্মা লালন ফকিরের ভাবনাজাত 'মনে দাস্যভাব' রাখবার প্রতীতি আমরা অর্জন করতে পারিনি। জড়বুদ্ধির এইখানটাতে রিসেট বাটন চাপবার জরুরত আছে, কিছুতেই মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকারের চেতনাকে যেন বিলীন করবার প্রয়াস না নেয়া হয়। সেটা হলে আমাদের স্বাধীন অস্তিত্ব আর থাকে না।

দ্বিতীয়ত সংস্কারের কথা বলেছেন চিফ অ্যাডভাইজার। মোটাদাগে সংবিধান সংস্কারের অভিপ্রায় আছে ইউনূস সরকারের এটা আমরা ধরে নিচ্ছি। সংবিধান ও নির্বাচন কমিশনসহ অন্যান্য সিস্টেম সংস্কারে ইতোমধ্যে ৬টি কমিশনও করা হয়েছে। 
আমরা বলতে পারি মানুষের বিষাক্ত মন যদি শুদ্ধ না করা যায় কোনো সংস্কারই আসলে কাজে আসবে না। লিখিত কাগজ যখন তখন বাতিল, সংযোজন ও বিয়োজন করা যায়। মানুষের মন ও মগজ যদি ভালো না হয় কোনো সংস্কারই টেকসই হবে না।

আশা করছি ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকার মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনের বিষয়টি তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত মাথায় আগলে রাখবেন।

-ফারদিন ফেরদৌস 
৭ অক্টোবর ২০২৪