ড. ইউনূস সরকার সহসাই যাচ্ছে না
বিএনপি-জামায়াত নিজেদের কপালে চিন্তার ভাঁজ জমা রাখতে পারে।
প্রথম আলোর সাথে সাক্ষাৎকারের দ্বিতীয় পর্বে ড. ইউনূস দেশবাসীর প্রতি একটি আর্জি জানিয়েছেন, 'সংস্কার না করে যেন নির্বাচন না করি। এটা আপনাদের সবার কাছে আমার আবেদন। এই সুযোগ হারাবেন না।'
কী মনে হয়? সংস্কার মুখের কথা?
পুরো সিস্টেম যেখানে বিকল, সেই বিকল যন্ত্রকে রিসেট দেয়ার কাজটা মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের মতো করে,
'জন্ম যদি তব বঙ্গে, তিষ্ঠ ক্ষণকাল' -বলে দিলেই হয়ে যাবে? সংস্কারককে যথোপযুক্ত সময় দিতে হবে। যৌক্তিক সময় দেয়ার অভীপ্সা ধোপে টিকবে বলে মনে হয় না।
আমরা দ্বিতীয় পর্বের বাতচিত
আরেকবার শুনে আসি:
প্রথম আলো: এই গ্রেপ্তারগুলো নিয়ে বা মামলা দেওয়ার বিষয়ে বেশ সমালোচনা হচ্ছে। কতটুকু সত্য বা কতটুকু অভিযোগ প্রমাণ করা যাবে। বা মামলা করে এই বিচারকে কতটুকু এগিয়ে নেওয়া যাবে। এসব প্রশ্ন মানুষের মনে আছে। সন্দেহ দাঁড়িয়ে গেছে। অনেকে বলতে চায় যে, অতীতের মতোই মামলাগুলো হচ্ছে, গায়েবি মামলা। এ দায় তো আপনাদের ওপর এসে পড়ছে, যদিও সরকার মামলা করছে না। এ দায় তো আপনি এড়াতে পারছেন না।
ড. ইউনূস: সে জন্যই জুডিশিয়ারির সংস্কার দরকার। আমি একা বলে দিলে তো হবে না। এটা তো তাহলে বিচার হলো না। এটা আইনের ভেতর দিয়ে আইনমতো হচ্ছে। কিন্তু আইনটা ভালো না। এ আইনগুলো পাল্টানো দরকার। কাজেই সেভাবেই আসতে হবে। আমরা এককভাবে একটা ঘোষণা দিয়ে দিলাম, তাহলে তো আবার আমরা একনায়কতন্ত্রের দিকে চলে গেলাম। আমরা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আসতে চাচ্ছি। ধীরে আসতে চাচ্ছি। বিচারপ্রক্রিয়া এমন জিনিস, এখানে যে ভুল হচ্ছে না, তা না। ভুল হচ্ছে। ভুলটা ধরিয়ে দিলে আমরা সঙ্গে সঙ্গে সংশোধন করার চেষ্টা করছি। আবার বলছেন আপনারা সিদ্ধান্ত পাল্টান। এ জন্যই আমাদের ভুল ধরিয়ে দিলে আমরা সিদ্ধান্ত পাল্টাই।
প্রথম আলো: আরেকটা বড় দাবি এসে যাচ্ছে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা, বেআইনি করা হোক। তাদের রাজনৈতিক তৎপরতা করতে দেওয়া না হোক; সে যাতে নির্বাচনে যোগ দিতে না পারে। এ বিষয়ে কী বলবেন?
ড. ইউনূস: এটাও আমাদের কোনো সিদ্ধান্তের বিষয় নয়। কাজেই যখন রাজনৈতিক দলগুলো বসবে, তারা সিদ্ধান্ত নেবে। যত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত আছে, সেগুলো আমরা রাজনীতিবিদদের কাছে নিয়ে যাব। তাঁরা যেভাবে সিদ্ধান্ত দেন।
প্রথম আলো: কিন্তু আপনাদের একটা অবস্থান তো থাকবে। সেটা তাহলে কমিশনের মাধ্যমে আসবে?
ড. ইউনূস: কমিশন যদি মনে করে যে দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে, যখন নির্বাচনের বিষয় আসবে, সেখানে আলাপ হবে। অতএব ওটাও আবার রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে যাবে। ওটা খসড়া করবে তারা। কমিশন করলেই যে সেটা চূড়ান্ত হয়ে গেল, তা কিন্তু নয়। কমিশনের সুপারিশ রাজনৈতিক দলের কাছে যাবে। রাজনৈতিক দল নিজেদের মধ্যে বিতর্ক করে, আলাপ-আলোচনা করে এটার সিদ্ধান্ত দেবে, কোন দিকে আমরা অগ্রসর হব।
প্রথম আলো: একটা প্রশ্ন আছে, আপনারা কত দিন দায়িত্বে থাকবেন? নির্বাচন কবে দেবেন? কথা এসেছে দেড় বছর, দুই বছর। অনেকে আবার বলেন তিন বছর। এমন কোনো সময়সীমা নির্ধারণের সুযোগ আপনার হয়েছে?
ড. ইউনূস: আমরা নিজেদের মধ্যে এ বিষয়ে আলাপ করি। আমাদের কাছে কাজটা তো পরিষ্কার। এ কাজটা হলো নির্বাচনের প্রস্তুতি। এই কাজটা আমাদের শুরু করে দিতে হবে। কাজেই নির্বাচনের প্রস্তুতির একটা স্টিম চলতে থাকবে। তার সঙ্গে সংস্কারের কাজ। দুটি একসঙ্গে যাবে।
এটি কোনো আলাদা জিনিস নয়। একটা শেষ করে আরেকটা ধরব। নির্বাচনের প্রস্তুতি দিয়ে নির্বাচন চলবে। কখন, কোথায় কী করা যায়, কত দূর যাব। আবার সংস্কার। কারণ, সংস্কার হলো আমাদের কেন্দ্রবিন্দু। এই নির্বাচনটা হচ্ছে সংস্কারকে এস্টাবলিশ করার জন্য। কাজেই যখন দেখা যাবে নির্বাচনের প্রস্তুতিও হয়ে গেছে, সংস্কারের কাজ গোছানো হয়ে গেছে। এক্সিকিউট করা হয়নি। তখন প্রশ্ন উঠবে, সংস্কারটা করে যাবেন নাকি নির্বাচনে চলে যাবেন।
প্রথম আলো: আপনি সব সময় জাতীয় ঐক্য, জাতীয় সমঝোতার কথা বলেন। এটাও ঠিক যে আমাদের দেশে রাষ্ট্রের যে মূলনীতিগুলো, সেখানে যদি ঐকমত্য তৈরি করতে না পারি, তাহলে চলা খুব মুশকিলের। আমরা চারপাশে বিভক্তি দেখি। দলাদলি দেখি। এ থেকে বের হবেন কী করে? সেখানে আমাদের সম্মিলিত প্রয়াসটা কী হওয়া উচিত?
ড. ইউনূস: শুধু যদি গত ১৫ বছরই ধরি, আমরা তো শুধু দলাদলি শিখেছি, বিভক্তি শিখেছি, দূরত্বই শিখেছি। কে কাকে মারবে, কাটবে, কেড়ে নেবে, কাকে কত দূরে সরাবে, কাজেই সে সংস্কৃতি থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে
মোটাদাগে ড. ইউনূস জুডিশিয়ারির আইন পাল্টে ফেলতে চাইছেন। এটাতো এমন না যে আরব্য রজনীর 'আলিবাবা চল্লিশ চোর' গল্পের মতো করে বলে দিলাম খুল যা সিম সিম, অমনি আইন পাল্টানোর কপাট খুলে গেল!
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের ব্যাপারে ড. ইউনূস বলেছেন, 'অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত কমিশনের সিদ্ধান্ত মোতাবেক রাজনৈতিক দল নিজেদের মধ্যে বিতর্ক করে, আলাপ-আলোচনা করে এটার সিদ্ধান্ত দেবে, কোন দিকে আমরা অগ্রসর হব।'
এই যে কমিশনের সিদ্ধান্ত এবং বিতর্ক, ফলাফল নির্ধারণ, অতঃপর কার্যকরণ গ্রহণ। এটি করা একবছর ছয় মাসের ব্যাপার না।
ইন্টেরিম গভমেন্টের মেয়াদকাল নিয়ে ড. ইউনূস বলেছেন, 'কাজটা হলো নির্বাচনের প্রস্তুতি। এই কাজটা আমাদের শুরু করে দিতে হবে। কাজেই নির্বাচনের প্রস্তুতির একটা স্টিম চলতে থাকবে। তার সঙ্গে সংস্কারের কাজ। দুটি একসঙ্গে যাবে।'
দুই মাস পেরিয়ে এসে চিফ অ্যাডভাইজার বলছেন, এই কাজটা আমাদের শুরু করে দিতে হবে! তারমানে কাজ এখনও শুরুই হয়নি।
ড. ইউনূস শেষের দিকে বলেছেন, 'শুধু যদি গত ১৫ বছরই ধরি, আমরা তো শুধু দলাদলি শিখেছি, বিভক্তি শিখেছি, দূরত্বই শিখেছি। কে কাকে মারবে, কাটবে, কেড়ে নেবে, কাকে কত দূরে সরাবে, কাজেই সে সংস্কৃতি থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে।'
বিভক্তির সংস্কৃতি বদলানো ৬ মাস বা ১ বছরের কাজ? কিছুতেই না। সংস্কৃতি বদলাতে হয় ধীরে সুস্থে রয়ে সয়ে। এমন একটা ইচ্ছাই প্রধান উপদেষ্টার কথকতায় স্পষ্ট হয়েছে।
সংস্কার সম্পন্ন করে বিভক্তি ঘুচিয়ে ফেলা দেশে হবে বিশুদ্ধ গণতান্ত্রিক নির্বাচন। অতএব বিএনপি-জামায়াত আপনাদের মেবি অপেক্ষা করতে হবে। আপাতত গার্মেন্টসের ঝুট, রাস্তাঘাট, বাজার, বন্দর, ভূমি অফিস, পরিবহন এবং প্রশাসনের পদপদবি নিয়েই সন্তুষ্ট থাকুন। ভাগ্যে থাকলে রাজরাজড়াদের জীবন আপনারাও যাপন করবেন ইনশাআল্লাহ্। মহান স্রষ্টা ধৈর্য্যশীলদের সাথেই থাকেন।
-ফারদিন ফেরদৌস
৮ অক্টোবর ২০২৪