পোস্টস

চিন্তা

ভাঙনের ভয়াল আওয়াজ নিঃশব্দতায় মিলাক

৯ অক্টোবর ২০২৪

ফারদিন ফেরদৌস

আজ ২৪ আশ্বিন ১৪৩১, ৯ অক্টোবর ২০২৪ দেবী বোধন ৬ষ্ঠী পূজার মধ্য দিয়ে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের শারদীয় দুর্গোৎসব শুরু হয়েছে। ১৫ বছর পর নতুন সরকারের জামানায় এবার পূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এবারের পূজার বিশেষত্ব হচ্ছে ক্ষেত্র বিশেষে আনসার ও পুলিশের পাশাপাশি সেনাসদস্যরাও বিগ্রহের নিরাপত্তায় দায়িত্ব পালন করছেন।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস এ উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, 'দুর্গাপূজা শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ের উৎসবই নয়, এটি এখন সার্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে। অশুভ শক্তির বিনাশ এবং সত্য ও সুন্দরের আরাধনা শারদীয় দূর্গোৎসবের প্রধান বৈশিষ্ট্য।'

'বৈষম্যবিরোধী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধন অটুট রেখে সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত ও সুখী-সমৃদ্ধ স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা।'

Chief Advisor GOB ফেসবুক পেজে প্রধান উপদেষ্টার বাণী প্রচারিত হলে সেখানে অধিকাংশ মন্তব্যকারী দ্বিমত প্রকাশ করে প্রফেসর ইউনূসের সমালোচনা করেছেন। মন্তব্যকারীরা জানিয়েছেন, 'দুর্গোৎসব কোনোমতেই সার্বজনীন উৎসব নয়। এটি একান্তই হিন্দুদের উৎসব তাই প্রধান উপদেষ্টা যেন তাঁর বাণী ফিরিয়ে নেন।

পূজোর আগে এবারও বেশকিছু জায়গায় প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। গণ-আন্দোলনে সরকার বদলের পর এখন একটা বিশেষ পরিস্থিতি চলছে। এমনটা ভাববার কোনো কারণ নেই যে, গেল দুই মাসে হঠাৎ করে মানুষ এমন বিদ্বেষ বা ঘৃণা রপ্ত করেছে। গেল ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকার যে কালচারে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে রেখেছে তারই প্রতিফলন এবারও দেখা যাচ্ছে। আমরা নতুন সরকারের কাছে দাবি জানাই মানুষ সভ্য হয়ে ওঠে, অন্যের মতাদর্শকে সম্মান করে এমন সংস্কৃতি যেন গড়ে তুলবার প্রয়াস তাদের থাকে। তাহলেই হয়ত ক্রমাগত ভাঙচুরের বেদনাদায়ক শব্দ আমাদের আর শুনতে হবে না।

আওয়ামী লীগ আমলেও হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা নির্যাতন ও নিপীড়নের বাইরে ছিল না। পূজার আগে বিগ্রহ ভাঙচুরের ইনসিডেন্টগুলোও থেমে ছিল না।
ওই বিষয়গুলো নিয়ে দুর্গোৎসবের সময়কাল অক্টোবর ২০২০ সালেও আমাদেরকে লিখতে হয়েছিল।

বরাবরের মতো ভাঙন শুরু হয়ে গেছে। পূজো আসবে আর বাংলাদেশে প্রতিমা ভাঙচুর হবে না -এটা হতেই পারে না। বাপুরে আপনার ধর্ম যেমন আপনার কাছে বড়, অন্যের ধর্মও অন্যের কাছে তাই।

মহান আল্লাহ্তায়ালা পবিত্র কুরআনের ১০৯ নাম্বার সূরা কাফিরুনের ৬ নাম্বার ভার্সে বলেছেন, লাকুম দ্বীনুকুম ওয়ালিয়া দ্বীন। অর্থাৎ তোমার ধর্ম তোমার আর আমারটা আমার। কুরআনের দ্বিতীয় সূরা বাকারার ২৫৬ নাম্বার আয়াতে বলা আছে, 'ধর্মের ব্যাপারে কোনো জোরজবরদস্তি নাই'।

আমাদের প্রিয় নবী করীম হযরত মুহাম্মদও(সা.) ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছেন। তারপরও অন্য ধর্মের প্রতি বিষোদগার এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে বাঁধা প্রদানও থেমে নাই। এখন দিনটাই যেন কেমন। মানুষের বোধ বিবেক ও চিন্তাশীলতা খুব সংকুচিত হয়ে আসছে। নিজেরে ছাড়া আর কাউকে মানুষ চিনছেই না। সম্প্রীতি নয়, উগ্র সাম্প্রদায়িকতাই যেন এখন সবার আরাধ্য। অথচ আগে কী সুন্দর দিন ছিল।
বাউলসম্রাট শাহ্ আব্দুল করিম তেমন দিনকেই তাঁর গানে স্মরণ করেছেন,
আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম আমরা
আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম
গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান
মিলিয়া বাউলা গান আর ঘাটু গান গাইতাম...

জীবনানন্দ দাশ তাঁর 'হিন্দু মুসলমান' কবিতায় বলেছেন, 
মহামৈত্রীর বরদ-তীর্থে-পুণ্য ভারতপুরে
পূজার ঘন্টা মিশিছে হরষে নমাজের সুরে সুরে!
আহ্নিক হেথা শুরু হয়ে যায় আজান বেলার মাঝে,
মুয়াজ্জেনের উদাস ধ্বনিটি গগনে গগনে বাজে,
জপে ঈদগাতে তসবি ফকির, পূজারী মন্ত্র পড়ে,
সন্ধ্যা-উষার বেদবাণী যায় মিশে কোরানের স্বরে;
                                       সন্ন্যাসী আর পীর
মিলে গেছে হেথা,-মিশে গেছে হেথা মসজিদ , মন্দির!

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম 
কী‌ দারুণভাবে বলতেন,
মোরা এক বৃন্তে দু’টি কুসুম হিন্দু-মুসলমান।
মুসলিম তার নয়ন-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ।।
এক সে আকাশ মায়ের কোলে
যেন রবি শশী দোলে,
এক রক্ত বুকের তলে, এক সে নাড়ির টান।।
এক সে দেশের খাই গো হাওয়া, এক সে দেশের জল,
এক সে মায়ের বক্ষে ফলাই একই ফুল ও ফল।
এক সে দেশের মাটিতে পাই
কেউ গোরে কেউ শ্মাশানে ঠাঁই
এক ভাষাতে মা’কে ডাকি, এক সুরে গাই গান।।

অপরদিকে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উচ্চারণ এমন...
অহরহ তব আহ্বান প্রচারিত, শুনি তব উদার বাণী।হিন্দু বৌদ্ধ শিখ জৈন পারসিক মুসলমান খৃস্টানী।

কিন্তু সেই ঔদার্যের দিন এইসময় পুরাই গত হয়েছে। মানুষের পেকে যাওয়া মগজে এখন হিংসা আর কুটিল জটিল অসার ভাবনা শুধু। সেই ভাবনায় সাম্যবাদের প্রজাপতি আর পাখনা মেলে না। 
আমরা এমন কেন হয়ে গেলাম?
যারা আমাদের অন্তরে এমন হিংসা ও ঘৃণার বীজ বুনে চলেছেন, তারা না পড়ে ধর্ম না জানে ইথিক্স, না বুঝে মনুষ্যত্ব।

হিংসুটিদের মন যাদের তাদের জন্য আল্লাহ্ সুবহানাহু তায়ালা ও রাসুল (সা.) এর বাণী রইল। আমরা আবার পড়ি, অনুধাবনও করি।

আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন বলছেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে যেসব দেব-দেবীর পূজা-উপাসনা করে, তোমরা তাদের গালি দিও না। যাতে করে তারা শিরক থেকে আরও অগ্রসর হয়ে অজ্ঞতাবশত আল্লাহকে গালি দিয়ে না বসে।’ 
(সূরা আনআ’ম আয়াত, ১০৮)।

রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘কোনো মুসলমান যদি ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের অধিকার ক্ষুণ্ন  করে কিংবা তাদের ওপর জুলুম করে, তবে কেয়ামতের দিন আমি মুহাম্মদ ওই মুসলমানের বিরুদ্ধে আল্লাহর আদালতে লড়াই করব। (আবু দাউদ : ৩০৫২)।

প্রিয় নবী (সা.) আরও বলেছেন, ‘অন্যায়ভাবে কোনো অমুসলিমকে হত্যাকারী জান্নাতের সুঘ্রাণও পাবে না। অথচ ৪০ বছরের রাস্তার দূরত্ব থেকেই ওই ঘ্রাণ পাওয়া যাবে।’ (বুখারি : ৩১৬৬।)

এতক্ষণে নিশ্চয়ই অনুভব করা গেল অন্য ধর্মকে হেয় করা বা ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মনে ইনটেনশনালি কষ্টের চিহ্ন এঁকে দেয়ার মধ্যে কোনো জাগতিক বা পারলৌকিক মঙ্গল তো নেইই, বরং কোনো মুসলিম যদি এই ন্যাক্কারজনক কাজ করেন তার কপালে রাসুল (সা.) -এর সুপারিশও থাকবার কথা না।

আমরা চাই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় থাকুক। সকল ধর্মমত ও জাতিগোষ্ঠীর মানুষ সমান সুযোগ নিয়ে তাদের ধর্মাচার ও উৎসব উদযাপন করুক। এটা নিশ্চিত করবার দায় সরকারের এবং আমাদের সবার। ভাঙনের ভয়াল আওয়াজ যেন চিরতরে নিঃশব্দতায় মিলিয়ে যায়।

কঠোর নিরাপত্তায় বিগ্রহ পাহারা দেয়ায় রাষ্ট্রের কোনো বাড়তি মাহাত্ম্য নেই, বরং মন্দির, প্যাগোডা বা চার্চ যেন পাহারা দিয়ে না রাখতে হয় তেমন মানবিক বন্দোবস্ত পোক্ত হলেই রাষ্ট্র ও এখানকার বাসিন্দারা বৈশ্বিক হিতবাদীদের প্রশংসা পাবে।

লেখক: সাংবাদিক
৯ অক্টোবর ২০২৪