---
সহড় থেকে অনেক দূরের একটি গ্রাম। যেখানকার লোকজন অনেকটা কৃষি নির্ভর, বেশিরভাগ লোকই কৃষি কাজ করে। তাই সেই গ্রামে যত দূর চোখ যায় শুধু ধানখেত আর ধানখেত। সেই মাইলের পর মাইল ফসল ভরা জমি। একটি গাছ ছাড়া আর কোনো। বড় গাছের দেখা মিলবে না। গ্রামের লোকেদের কাছ থেকে শোনা যায়, গাছটি জমিতে জন্মেছে। সেই জমির কোনো মালিক নেই। যুদ্ধের সময় পালিয়ে গিয়েছে। তাই বর্তমানে সেই জমিটি এবং সেই গাছের দেখাশোনা করে গ্রামের এক জমিদার। জমিদার বাবুর অর্থসম্পদ অনেক। তাঁর একটি মাত্র পুত্রসন্তান আছে যদিও সে সন্তান বাড়িতে থাকে না। এটি অনেক দিন আগের কথা। জমিদার বাবু তাঁর সন্তানকে বিদেশে পাঠিয়েছিলেন। তাঁর স্বপ্ন ছিল সন্তান একদিন বড় ইঞ্জিনিয়ার হয়ে দেশে ফিরবে। এখন জমিদার বাবু সেই গাছের নিচে বসে তাঁর জমিদারি কাজ করে। সেই গাছের নিচে তিনি গ্রামের কৃষকদের কাছ থেকে খাজনা সংগ্রহ করেন। তাই দূর দূরের কৃষকরা আসে সেই গাছের তলায় খাজনা দিতে। অনেকের কাছে তো সেটা জমিদার বাবুর গাছতলা নামে পরিচিত। মাঝে মাঝে জমিদার বাবু মনে মনে ভাবেন। তিনি এত বছর ধরে এই গাছের নিচে বসে কৃষকদের কাছ থেকে খাজনা সংগ্রহ করেন এবং এত বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরেও গাছটি নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। গাছটার কেউ যত্ন না নিলেও সে কিছু বলতে পারে না। গাছটা তো কাউকে কখনো বলেনি, "তোমরা কেন আমার ছায়ায় বসে আছো?"
"তোমরা তো কখনো আমার যত্ন নাওনি। বরং তোমরা আমাকে কষ্ট দিয়েছো। কেউ বা ডাল কেটে নিয়ে গেছে। কেউ বা পাতা। তোমরা তো প্রায় জনে আমাকে ব্যবহার করেছো। আমার কাছ থেকে তোমরা অনেক কিছু পেয়েছো—খাবার হিসেবে ফল, জ্বালানি হিসেবে কাঠ, এমনকি তোমাদের জীবন বাঁচানোর জন্য অক্সিজেন, যা ছাড়া তোমরা এক মুহূর্তও বাঁচতে পারবে না। এবং খাদ্য হিসেবে আমাকে দিয়েছো তোমাদের ত্যাগ করা কার্বন ডাইঅক্সাইড, যা তোমাদের জন্য ক্ষতিকর।"
কিন্তু হে মানুষ, তোমরা কি শুধু একাই কার্বন ডাইঅক্সাইড ত্যাগ করো? পৃথিবীতে আরো অনেক প্রাণী আছে যারা কার্বন ডাইঅক্সাইড ত্যাগ করে। তাই তোমরা না থাকলেও হয়তো আমার অস্তিত্ব থাকবে। কিন্তু আমি যদি না থাকি, তাহলে কি তোমাদের অস্তিত্ব থাকবে? গাছ না থাকলে মানুষের অস্তিত্ব থাকবে না? কিন্তু মানুষ না থাকলেও গাছের অস্তিত্ব টিকে থাকবে। হে মানুষ, তোমাদের গ্রীষ্মের তীক্ষ্ণ রোদে দিয়েছি ছায়া। এতো কিছুর বিনিময়ে, তোমরা আমাকে কি দিয়েছো? এসব কথা ভাবার পর জমিদার হতাশ হয়ে বলেন, "কি করার, গাছ তো কথা বলতে পারে না।"
তিনি মনে করেন, গাছেরও তো জীবন আছে। গাছ যদি তার মনের ভাব মানুষকে বোঝাতে পারতো, মানুষকে সে কত সাহায্য করতো। কিন্তু কি করার, গাছ তো কথা বলতে পারে না। তাছাড়া কয়জন মানুষ আছে, যে গাছের দুঃখ কষ্ট বুঝবে? গাছের যত্ন নিবে? গাছের এই মনের কষ্ট, শুধু জমিদার বাবুই বুঝতো। তাই তিনি গাছটির যত্ন নিতেন তাঁর সাধ্য মতো।
বলা চলে, তাঁর জন্য সেই পুরনো গাছটি, যার নিচে জমিদার তার জমিদারি করতেন, সেই গাছটি বেঁচে আছে। নাহয় এত দিন এ কত মানুষ গাছটিকে কাটার চেষ্টা করেছে। কিন্তু পারিনি। জমিদারের জন্য। তিনি যে গ্রামের জমিদার, তার একটু ক্ষমতা আছে। তাই তার জন্য গাছটা কাটার সুযোগ কেউ পায় না। কিন্তু হঠাৎ একদিন জমিদার অসুস্থ হলেন। তিনি এতটাই অসুস্থ ছিলেন যে ঠিক মতো হাঁটতেও পারছিলেন না। সেজন্য ঘরে বসে থাকা ছাড়া আর তাঁর কোনো উপায় ছিল না। অসুস্থ হওয়ার কারণে সেই গাছের তলায় ও যেতে পারতেন না। বেচারা গাছ তো কথাও বলতে পারে না। হাঁটতেও পারে না। সে তো নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে জমিদার বাবুর অপেক্ষা করতে লাগলো। যে কবে জমিদার তাঁর ছায়ায় বসে জমিদারি করবে। এবং তার যত্ন নিবে। সে জানতো জমিদার ছাড়া আর কেউ তাঁর মনের ভাব বুঝবে না। কিন্তু গাছ তো আর এটা জানতো না যে জমিদার অসুস্থ। আর জানবে বা কি করে? জমিদার যে অসুস্থ এই কথা টা তাকে কে জানাবে? কেউ তো তাঁর কোনো খোঁজ-খবর রাখে না। এদিকে গাছ তার অপেক্ষায় থাকে। দিনের পর দিন যায় জমিদার আরও বেশি অসুস্থ হতে থাকে। অসুস্থ হওয়ার কারণে তার জমিদারি কাজ-কর্ম ঠিক মতো করতে পারছিল না। তাই গ্রামের অন্য একজনকে জমিদারির দায়িত্ব দেওয়া হলো। এভাবে জমিদার তার ক্ষমতা হারালো। যদিও তিনি অন্য মানুষকে বলতেন সেই গাছটার যত্ন নিতে। কিন্তু তার জমিদারি আর ক্ষমতা না থাকার কারণে কয়জন তার কথা শুনতো? অন্যদিকে বিদেশে থাকা তার ছেলে, যাকে জমিদার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার জন্য বিদেশে পাঠিয়ে ছিলেন, তার কাছে খবর গেল যে তার বাবা অনেক অসুস্থ। বাবার অসুস্থতার কথা শুনে ছেলে দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নিল। কিন্তু দেশে ফিরতে ফিরতে জমিদার এতোটাই অসুস্থ হয়ে পড়েছিল যে তিনি ঠিক মতো কথা বলতে পারছিলেন না। জমিদারের ছেলে বাড়ির মানুষকে জিজ্ঞাসা করে। তার বাবা এত অসুস্থ কিন্তু তাঁকে কি কোনো ডাক্তার দেখানো হয়েছে? বাড়ির মানুষ বললো। ডাক্তার দেখানো হয়েছে। ডাক্তার বলেছেন তাঁর করার মতো বেশি কিছু নেই। এমনিতেও জমিদার এর অনেক বয়স হয়ে গেছে। এখন তিনি যে কয়দিন বাঁচবেন, সৃষ্টি কর্তার ইচ্ছায়। এখানে ডাক্তার করার কিছু নেই। তবে ডাক্তার বলেছে, জীবনের এই শেষ সময়ে তাদের উচিত জমিদারের পাশে থাকার। অন্যদিকে জমিদার বাবু অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে, কিছু লোক গাছটি কাটার সিদ্ধান্ত নিল। এবং এই কথা গ্রামের একজন শুনে জমিদারকে জানালো। কিন্তু জমিদার অসুস্থ হওয়ার কারণে কথা বলতে পারছিল না। তাই তিনি একটি কাগজে লিখলেন, "গাছ না থাকলে মানুষের অস্তিত্ব থাকবে না। কিন্তু মানুষ না থাকলেও গাছের অস্তিত্ব থাকবে।" এবং তিনি আরও লিখলেন তার ছেলের উদ্দেশ্যে। যে তার ছেলে যেনো মানুষকে বোঝায় তারা যেন গাছ না কাটে, বিশেষ করে সেই গাছটা, যার নিচে তিনি বসে জমিদারি করতেন। তিনি ভেবেছিলেন, "তাঁর ছেলে তো অনেক শিক্ষিত, হয়তো সে বুঝবে মানুষের জীবনে গাছের গুরুত্ব।"
কিন্তু সে ভাবনা হয়তো ভুল হয়ে গেল।
তাঁর ছেলে, সেই লেখাগুলো পড়ে ভাবলো—
"তাঁর বাবা অসুস্থ তাই হয়তো তিনি এসব ভুল-ভাল লিখেছেন।" আর অন্যদিকে জমিদারের অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে কিছু লোক টাকার লোভে গাছটাকে কাটতে শুরু করলো। তারা একে একে গাছটাকে কেটে ফেললো। তখনও গাছটা নীরব হয়ে নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল। একটা সময় লোকগুলো গাছটাকে কেটে ফেলে। এবং এই কথা জমিদার শুনে কষ্ট পান। এবং এতটাই কষ্ট পান যে তিনি এক সময় আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এবং তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুর সময় জমিদার কথা বলতে পারছিল না। ওই গাছটার মতো। এভবে জমিদারের জীবনের অবসান ঘটলো।হয়তো গাছ না থাকলে আমাদেরও একদিন ঠিক একইভাবে জীবনের অবসান ঘটবে। জমিদারের অনেক ক্ষমতা ছিল কিন্তু তিনি অসুস্থ হলে তার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। তার জমিদারি, এই ক্ষমতা পরিশেষে কোনো কাজে দেয়নি। হয়তো আমাদের ও এত ক্ষমতা একদিন কোন কাজে দেবে না। তাই এখনো সময় আছে, আমাদের উচিত গাছ না কাটা। আমরা গাছ না লাগালেও পৃথিবীতে গাছের অস্তিত্ব থাকবে। কিন্তু আমরা যদি গাছ কাটি, তাহলে পৃথিবীতে গাছের অস্তিত্ব থাকবে না। কারণ একটি গাছ বড় হতে যদি পাঁচ বছর সময় লাগে, তাহলে এই পাঁচ বছরে মানুষ চাইলে হাজারো গাছ কেটে ফেলতে পারে। এবং পৃথিবীতো থেমে থাকবে না, জনসংখ্যা বাড়বে কিন্তু পৃথিবীর আয়তন বাড়বে না। সময়ের সাথে সাথে মানুষ শিক্ষিত হলেও জলবায়ু দিন দিন বেশি পরিবর্তন হচ্ছে। পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। তাই এখনই সময় আমাদের গাছ কাটা বন্ধ করা উচিত। অপ্রয়োজনে গাছ কাটা ঠিক নয়, বা প্রয়োজনে গাছের বিকল্প খুঁজতে হবে। আমাদের আরও মনে রাখতে হবে একটি বন্দুকের গুলি একজন মানুষের প্রাণ কেড়ে নিতে সক্ষম। কিন্তু হাজারো বন্দুকের গুলি তৈরি করতে যে অর্থ প্রয়োজন হয়, যে পরিশ্রম হয়, যে সময় লাগে, বিনিময়ে আমরা সেই মৃত মানুষকে জীবিত করতে পারবোনা। এর মানে মানুষ চাইলেই অনেক কিছু ধ্বংস করতে পারবে কিন্তু চাইলেই সবকিছু আগের মত করতে বা ফিরিয়ে আন তে পারবে না।