টাটা গ্রুপের ইমেরিটাস চেয়ারম্যান রতন টাটা প্রয়াত হওয়ার পর তাঁর বিনয়, মহানুভবতা, সেবাপরায়ণতা, প্রাণিপ্রেম ও দেশপ্রেম নিয়ে চারদিকে কথা হচ্ছে।
রতন টাটাকে যদি তুল্যমূল্যে বিচার করি আমাদের দেশের কয়জন ব্যবসায়ীকে নিয়ে এমন অভিধা দেয়া যায়? আমাদের অধিকাংশ ব্যবসায়ী সরকারি ক্ষমতায় ভাগ বসিয়ে ব্যাংক লুটপাটের ধান্ধায় ব্যস্ত থাকে। ঋণখেলাপি হওয়াটাকে ডালভাত বানিয়ে ফেলেছে এরা। যাদেরকে নিয়ে মোটামুটিমানের শংসাপত্রও লেখা যায় না।
বিবিসি বাংলা 'প্রতাপশালী শিল্পপতি অথচ 'বিনয়ী' রতন টাটার কাহিনী' শিরোনামে অবিচুয়ারি প্রকাশ করেছে। সেখানে তারা লিখেছে, 'রতন টাটা ছিলেন ভারতের অন্যতম বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠান টাটা গ্রুপের ইমেরিটাস চেয়ারম্যান। ১৯৯১ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত টানা ২১ বছর ধরে তিনি এ গ্রুপের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
বর্তমানে এই শিল্পগোষ্ঠীর শতাধিক কোম্পানি আছে। রতন টাটার সম্পদের পরিমান ৩ হাজার ৮০০ কোটি রুপি। আর টাটা গ্রুপের মূল্যমান ৩৩ লাখ ৭০০ কোটি রুপি। পৃথিবীর ছয়টি মহাদেশের ১০০টি দেশে এই ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর কার্যক্রম রয়েছে। লবণ থেকে শুরু করে সফটওয়্যার, কী নেই টাটা গ্রুপের! জ্বালানি, গাড়ি, প্রকৌশল, তথ্যপ্রযুক্তি, যোগাযোগসহ বিভিন্ন খাতে তাদের ব্যবসা রয়েছে। বিশ্বজুড়ে টাটা কোম্পানিগুলোয় কাজ করেন আট লাখ কর্মী। আর ১৫৫ বছর পুরনো টাটা গ্রুপের বার্ষিক আয় ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি।
টাটা শিল্পগোষ্ঠীর ওপর লেখা বই ‘দ্য স্টোরি অফ টাটা’ এর লেখক পিটার ক্যাসির মতে, এই শিল্পগোষ্ঠীর নীতি 'পুঁজিবাদ ও পরোপকারকে সমান্তরালে রাখা, মানে এমনভাবে ব্যবসা করা যাতে অন্যের জীবন উন্নত হয়'।
এ গ্রুপের নিয়ন্ত্রণকারী কোম্পানি টাটা সন্স।
পিটার ক্যাসি ব্যাখ্যা করেন, “টাটা সন্সের এমন অনেক কোম্পানি রয়েছে, যেগুলো জনহিতকর ট্রাস্টের মালিকানাধীন।”
১৯৩৭ সালে একটি ঐতিহ্যবাহী পার্সি পরিবারে রতন টাটার জন্ম। পার্সিরা একটি উচ্চ শিক্ষিত ও সমৃদ্ধ সম্প্রদায়, যারা একটা সময়ে ইরান থেকে ভারতে স্থানান্তরিত হয়েছিলো।
রতন টাটার জীবনে দুটি ব্যর্থতার মধ্যে একটি হলো ন্যানো গাড়ির বাজার না পাওয়া।
নিরাপদ ও সাশ্রয়ী মূল্যের গাড়ি তৈরিতে টাটার যে প্রচেষ্টা, তা একটা সময়ে হতাশায় রূপ নিয়েছিল। এটি ২০০৯ সালে ব্যাপক ধুমধাম করে যাত্রা শুরু করেছিলো। তখন বেজ মডেলের গাড়ির দাম ছিল মাত্র এক লাখ রুপি। কিন্তু প্রাথমিক সাফল্যের পর উৎপাদন ও মার্কেটিং-এর নানা সমস্যার কারণে তা অন্যান্য প্রস্ততকারকদের কাছে হেরে যেতে শুরু করে।
রতন টাটা পরে বলেছিলেন, “ন্যানোকে বিশ্বের সবচেয়ে সস্তা গাড়ি হিসাবে প্রচার করাটা একটি বিশাল ভুল ছিল। কারণ মানুষ বিশ্বের সবচেয়ে সস্তা গাড়ি চালাতে চায় না।”
তাঁর দ্বিতীয় ব্যর্থতা ছিল দারপরিগ্রহ করতে না পারা। কিন্তু এই ব্যর্থতাই তাঁকে ব্যবসায়িক সাফল্যের শীর্ষে নিয়ে গেছে বলে তিনি মনে করেছিলেন। সংসারে সময় ব্যয় করার ঝক্কি ঝামেলা না থাকায় রতন টাটা পুরোটা সময় কোম্পানির অগ্রযাত্রায় ব্যয় করতে পেরেছিলেন।
রতন টাটা তাঁর প্রেমজীবনের কথা প্রকাশ্যে এনেছিলেন নিজেই। জানিয়েছিলেন, তাঁর মনের দরজায় প্রেম কড়া নাড়িয়েছিল চার বার। কিন্তু বিভিন্ন কারণে তা পূণর্তা পায়নি। তাই এর পর আর বিয়ের কথা ভাবেননি তিনি। মনপ্রাণ সব দিয়েছিলেন টাটা গোষ্ঠীকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দিকে।
এমন এক মহান শিল্পপতির প্রয়াণে টাটা সন্স গ্রুপের বর্তমান চেয়ারম্যান নটরাজন চন্দ্রশেখরন বিবৃতিতে জানিয়েছেন, রতন টাটা 'সত্যিই একজন অনন্য নেতা ছিলেন। তিনি শুধু টাটা গ্রুপই নয়, পুরো জাতি গঠনেও অবদান রেখেছেন'।
রতন টাটা বিয়ে করেননি। তাঁর কোনো সন্তান নেই। বিয়ে করেননি তাঁর আপন ভাই জিমি টাটাও। তাঁরা দুজন নাভাল টাটা ও সুনি কমিসারিয়াতের সন্তান। রতন টাটার বয়স যখন মাত্র ১০ বছর, তখন তাঁর মা–বাবার বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে। বলা হয়ে থাকে, মা–বাবার অসুখী জীবন দেখেই দুই ভাইয়ের কেউই আর বিয়ে পথে হাঁটেননি।
সুনি কমিসারিয়াতের সঙ্গে বিচ্ছেদের পর নাভাল টাটা আবার বিয়ে করেছিলেন। তাঁর চেয়ে ২৬ বছরের ছোট ফরাসিভাষী সুইস নারী সিমোন ডুনেয়ারকে ১৯৫৫ সালে বিয়ে করে তিনি। সুপরিচিত সাজসজ্জার উপকরণ প্রস্তুতকারী কোম্পানি লাকমে পরিচালনা করতেন সিমোন। তাঁদের একমাত্র ছেলে নোয়েল টাটার জন্ম ১৯৫৭ সালে।
নোয়েল টাটার তিন সন্তান। মায়া, নেভিল ও লিয়া। টাটার যে পরম্পরা, এই তিনজন টাটা সন্স গ্রুপের উত্তরাধিকার হবেন বলে মনে করা হচ্ছে।
রাষ্ট্রীয় পদ্মবিভূষণ পদকজয়ী রতন টাটার জন্য তাঁর নিজ রাজ্য মহারাষ্ট্রে একদিনের শোক ঘোষণা করা হয়েছে। পারসি ধর্মানুসারে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছে।
রতন টাটার ৫টি অমর বাণী:
১. বিজয়ে বিনম্র হও। আর হেরে গেলে মাথা উঁচু করে সে পরাজয় বরণ করে নাও।
২. সবাই তোমার দিকে যে পাথরগুলো ছুড়ে মারবে, সেগুলো রেখে দাও। আর তারপর তা দিয়ে নিজের সাফল্যের মনুমেন্ট গড়ো।
৩. দ্রুত হাঁটতে চাইলে একাই হাঁটো। কিন্তু অনেক দূর যেতে চাইলে সবাইকে নিয়েই হাঁটতে হয়।
৪. লোহাকে তার নিজের মরিচাই পারে ধ্বংস করতে। ঠিক তেমনি একজন মানুষকে শেষ করে দিতে পারে তাঁর নিজের মানসিকতা।
৫. জীবনের পথে ওঠা ও নামা দুটিই খুব জরুরি। কারণ, ইসিজিতে যদি সরলরেখা আসে, তার অর্থ হচ্ছে আমরা মারা গিয়েছি।
তথ্যসূত্র:
হিন্দুস্তান টাইমস
প্রথম আলো
আনন্দবাজার পত্রিকা
লেখক: সাংবাদিক
১০ অক্টোবর ২০২৪