পোস্টস

গল্প

এক টুকরো জমিন

১০ অক্টোবর ২০২৪

Rocky Meraz

মূল লেখক রকি মেরাজ

 

জমিনে পাড়া দিয়াই মালেক অঝোরে কাঁদতে লাগলো। কৃষক আব্দুল মালেকের বাপ আইজ ভোরে মারা গ্যাছে। মালেকরা পাঁচ ভাই। সবাই পড়াশোনা করতো। খেয়াল খুশি মতো দিন কাটাইতো। আর মালেক ছোট কাল থেইকাই বাপের লগে ক্ষ্যাতে কাম করতো।

 

মালেকের বাপ সবসময়ই বলতো " বাজান ; এই ক্ষ্যাতের ধান দিয়াই সারাজীবন সংসার চালাইছি; ধান বেইচা তর বইনগো বিয়া দিসি।"

 

গতকালও মালেক বাপের লগে ক্ষ্যাতে কাম করতে আইছিলো। কামের ফাঁকে বাপে কইছিলো এই ক্ষ্যাত আমি তরে দিয়া যামু মালেক। তুই ছাড়া আমার আর কোন পোলা ক্ষ্যাতে আহে না। কাজ কাম করে না। তাই এই ক্ষ্যাতের উপ্রে তর অধিকারই সবার থেইক্কা বেশি।

 

তখনো জমিনে পইড়া বেহুঁশ হইয়া কানতেছিলো কৃষক আবদুল মালেক। মরা বাপের কথা মালেকের মনে হইতেছে। আরও মনে হইতেছে বাপের লগে কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত।  মালেক ছোট কাল থেইকাই বাপভক্ত পোলা। তাই বাপের মৃত্যুতে মালেকই সবারথেইকা বেশি কষ্ট পাইছে।

 

পরশু যখন এই ক্ষ্যাতে বাপ ব্যাটা দুইজনে কাম করতেছিলো তখন মালেক বাপেরে জিজ্ঞেস করছিলো - " আব্বা এই জমিনটা তোমার এত প্রিয় ক্যান? আমাগো ত আরও জমিন আছে; আমি খেয়াল করছি ঐগুলার থেইকা এই জমিনটাই তোমার বেশি প্রিয়!"

 

পাগলা মাদবর উত্তর দিছিলো " বাজানরে!  এই জমিনটা আমারে আব্বায় দিয়া গেছিলো ; বাকিগুলা আমি নিজেই কিনছি। তাই আব্বার শ্যাষ চিহ্ন হিসাবে এই জমিন আমার কাছে আব্বার মতোই। " তখন পাগলা মাদবরের কথা শুইনা মালেক মনে মনে ভাবতেছিলো দাদার জমিনটা একদিন তাঁরই হবে। সে এই জমিনটারে বাপ দাদার চিহ্ন হিসাবে সারাজীবন আগলাইয়া রাখবে।

 

আজ যখন পাগলা মাদবর মইরা গ্যালো। তখন তার ভাইরা বাপেরে কবর দিয়াই। জমি জমার ভাগ বাটোয়ারা করতে বসছে। মালেক বারান্দার এক কোনায় চুপ কইরা বইসা আছে। কানতে কানতে ওর চোখ দুইডা লাল হইয়া গ্যাছে। বাকি ভাইরা নিজেদের পছন্দের জমিনগুলা ভাগাভাগি করতেছে।

 

হঠাৎ মালেকের বড় ভাই মালেক রে কইলো " মালেক তর কোন জমিনটা পছন্দ হয়? তুই কোনটা চাছ? "

 

কিছুক্ষণ চুপ থেকে মালেক এই জমিনের কথা কইলো। এই জমিনটাই মালেক চাইলো। তখন মালেকের কথা শুইনা সেজো ভাই কইলো- " তুই এইটা নিবি ক্যান! এই জমিন সবচাইয়া ডাইনে। নিয়মানুযায়ী এই জমিনের মালিক আমাগো বড় ভাই।"

 

সেজো ভাইয়ের কথায় সবাই সায় দিলে; মালেক বলে ওঠলো ; "এই জমিনটা আব্বায় আমারে দিয়া গ্যাছে। আব্বায় আমারে কইয়া গ্যাছে এই জমিনের মালিক তুই। "

 

মালেকের কথা শুইনা মেজো ভাই মালেকরে ধমক দিয়া কইলো- " ফাইজলামি করছ? মুখের উপর কথা কছ। যা তরে কোন জমিনই দিমু না! "

 

কথাটা শুইনা ঘোমটার আড়াল থেকে মালেকের বুড়ি মা কাঁদতে কাঁদতে কইলো " তরা তো পড়ালেখা করছোত। শিক্ষিতো হইসোত। আর মালেক ছোট কাল থেইকাই তগো বাপের লগে কামে গ্যাছে। ওই জমিনটা তর বাপের প্রিয় আছিলো। তাই ওরও প্রিয়।  ওরে জমিনটা দিয়া দে। "

 

মায়ের কথাটা শুইনা সব ভাই ক্ষেপে গ্যালো। মালেকের ছোট ভাই চিল্লাইয়া কইতে লাগলো- " ওই কাম করছে দেইখা ওর পছন্দ মতো জমিনই কি ওরে দিতে হইবো? আমাগো পছন্দ অপছন্দের কোন দাম নাই?"

 

"আর তুমি ক্যামনে এই কথাটা কইতে পারলা মা? 
শুধু মালেকই কি তোমার প্যাটে হইসে? আমরা কেউ  হই নাই? তুমি সবসময় ওর পক্ষ নিয়াই কথা কও ক্যান? "

 

ছেলেদের তোপের মুখে মালেকের বুড়ি মা চুপ হইয়া গ্যালো। 

 

মায়ের কথার দাম না দেয়ায় বসে থাকা মালেক ওঠে দাঁড়াইলো। সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো - " আমি মাফ চাই। তোমরা চুপ করো। মায়ের লগে চিল্লা পাল্লা কইরো না। আমার কিছুই লাগবো না।"

 

পাশ থেকে মালেকের বড় ভাই বললো  - " দ্যাখ মালেক এই জমিনটা তরে দেওন যাইবো না ; তুই অন্য আরেকটা জমিনের কথা ক। তরে ঐটা দেই।"

 

মালেক গম্ভীর গলায় বললো - " বড় ভাই আমি আপনেদের ছোট। আপনেরা সবাই শিক্ষোতো মানুষ।আমি আপনেগো সামনে মূর্খ। "

 

আমি মিথ্যা কিছু কমু না "এই জমিনটা দাদায় আব্বারে দিছিলো। আব্বার লগে কাম করনের সময় আব্বায় কইছিলো দাদার শেষ চিহ্ন যেন আমি আগলাইয়া রাখি। "

 

মালেকের কথা শুনে বড় ভাই এবার রেগে বললো -"বেয়াদব হইছোস ; মুখের উপ্রে কথা কস ; এই জমিন তরে দিমু না।" 


তখনো বাকি ভাইরা বড় ভাইকে সাপোর্ট করতেছে।

 

মালেক অভিমানী কৃষক। বাবার মৃত্যু শোক তখনো প্রবাহিত স্রোতের মতো তার হৃদয়ে ক্ষত তৈরি করছে। এমনত অবস্থায় মালেক ভাইদের উদ্দেশ্য করে বললো - " তোমরা পরিবারের টাকা দিয়া পড়াশোনা করছো। জীবনে ক্ষেতে যাও নাই। আমি আর আব্বায় কাজ করে ফসল ফলাইছি ; তোমরা বসে বসে খইছো। আমি কখনো কিছু বলি নাই। তয় এহন আমি বাপের দেওয়া জমিনটা ছাড়তে পারমু না। আমার জমিনটা লাগবোই। "

 

মালেকের কথা শুনে সবাই রেগেমেগে অস্থির হয়ে মালেককে মারতে এগিয়ে আসলো। প্রথমে বড় ভাই একটা চড় দিয়ে মালেক কে মাটিতে ফেলে দিলো। তারপর মেজো ভাই, সেজো ভাই ও ছোট ভাই মিলে বাঁশ দিয়ে পিটাইতে লাগলো। 

 

মালেকের অসহায় বৃদ্ধ মা মালেককে বাঁচাতে গলা ছেড়ে ডাক চিৎকার শুরু করলো- “ আমার মালেক রে মারিছ না। ছাইড়া দে। তোরা কে কোথায় আছিস? আয়। পোলাডারে মাইরা ফালাইলো।”

 

বুড়ির চিৎকার শুইনা প্রতিবেশী সবাই আগাইয়া আসলো। তখনো ভাইরা মালেক কে পিটাইতেছিলো। প্রতিবেশীদের হস্তক্ষেপে এবার মালেক ভাইদের থেকে মুক্ত হলো। 

 

রক্তাক্ত মালেক কে জরিয়ে ধরে বৃদ্ধ মা কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো- " আমার মালেকরে আর মাইরো না তোমরা ; তোমাদের ইচ্ছে মতন যার যেটা ভাল লাগে নিয়া নাও।"

 

মায়ের কথা শুনে রক্তাক্ত মালেক বলে ওঠলো - " আমার কোন জমিন ই লাগবো না মা। ওরা সবাই বাপের সব জমিন নিয়া যাইক। আমারে শুধু তোমারে দিয়া দিক। আমি শুধু তোমারে নিয়াই থাকুম। ওরা জমিন নিয়া থাকুক।"

 

কথাটা বলেই অভিমানী কৃষক আবদুল মালেক চোখ মুছলো। তারপর খুড়াতে  খুড়াতে বাড়ি থেকে বের হয়েই জোরে দৌড় দিলো। এক দৌড়ে বাপ দাদার প্রিয় সেই জমিনটাতে এসে বসে ধপ করে পড়লো। তখনো তাঁর আহত শরীর থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে; রক্তের ফোঁটায় এক টুকরো জমিন ; সবুজের গান গাচ্ছে।

 

চারিদিকে শুনশান নীরবতা। সন্ধ্যার মৃদু বাতাস বইছে। পাখিরা ঘরে ফিরছে। মাথার উপর রক্তাক্ত আকাশের নীচে ; এক টুকরো জমিন বুকে নিয়ে বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে অশ্রুসিক্ত রক্তাক্ত কৃষক।