কাক ডাকা দুপুর , শহরতলীর বেশিরভাগ দোকানপাঠ বন্ধ।দোকানীরা দুপুরের খাবার শেষে কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে পুনরায় দোকান খুলবেন। ঝাপ ফেলা সারি সারি দোকানের সরু গলি দিয়ে শীষ বাজিয়ে হেঁটে চলছে কমল।
কমল- বয়স ১৭ কি ১৮। প্রায় সব পাড়াতেই কিছু ছুটো লোক থাকে যারা কিনা সকলের কিন্তু কেউ তাদের না।তেমনই একজন কমল।বাবা শান্তি রাম ,ওদের জীবনের শান্তি নষ্ট করে যে সময় চলে যায়। সে সময় ওর বয়স দুই বছর।মা পারুল -অকালে আত্মহত্যা করে।সকলের ধারণা শান্তি রামের ধোঁকার কারণেই শিশু পুত্রের কথা ভুলে গিয়ে নিজের প্রাণ নিয়েছে সে । যদিও এ কথা কেউ কেউ বিশ্বাস করতে চায়না। কিন্তু বেচারা কমলের জন্য কারো এত সময় ছিলনা যে তার মায়ের মৃত্যু কারণ উদ্ঘাটন করবে কেউ। মায়ের মৃত্যুর পর দিদার কাছে বড় হয়েছে সে।বৃদ্ধা দিদাও গত হয়েছেন বেশ কয়েক বছর আগে।
অনাথের প্রতি যে দু শ্রেণির লোক বেশি দয়া পরবেশ হয় তাদের মধ্যে এক শ্রেণি হলো তারা –
যারা কিনা স্বভাবগত দিক থেকেই দয়ালু ।এরা সকলের প্রতিই নরম ,পরোপকারী।
আর আরেক শ্রেনী হলো তারা- যারা কিনা ব্যক্তিগত জীবনে নিঃসঙ্গ বা থেকেও কেউ নেই এমন।
এলাকায় যে কজন সিনিয়র সিটিজেন তথা বৃদ্ধ আছেন রণপ্রসাদ দত্ত তাদের মধ্যে অন্যতম। দত্ত বাড়ীর শেষ চিহ্নটুকু আগলে দোতলা বাড়িটার প্রাণ ধরে রেখেছেন তিনি। বিপত্নীক রণ বাবুর এক ছেলে। স্থায়ী বসতি গড়েছেন আমেরিকায় । বাবা রণপ্রসাদ, সাহেবী হাওয়ায় অভ্যস্ত হতে নারাজ। তাই একা জীবনকেই বেছে নিয়েছেন তিনি। তেমন কোনো শারীরিক সমস্যা নেই বললেই চলে ষাটোর্ধ রণপ্রসাদ দত্তের।পেশায় হাইকোর্টের উকিল ছিলেন তিনি। পেশাদারী ওকালতি করে জীবিকা নির্বাহ করতে হবে এমন ছিলনা। এলাকায় যে কয়টা ভাড়ায় দোকান আছে তার বেশিরভাগই তার পারিবারিক সূত্রে প্রাপ্য।জায়গা জমির প্রাচুর্যও বেশ । বাবার একমাত্র সন্তান হওয়ার দরুন সমস্ত সম্পত্তির একমাত্র উত্তোরাধীকারী কেবল তিনিই।
রণ বাবুর সাথে প্রতিদিনই দেখা হয় যে গুটি কতক লোকের তার মধ্যে অন্যতম কমল।নিঃসঙ্গ দুজনের বেশ জমে বলা চলে। রুটিন করে দু বেলা দাদুকে দেখে যায় কমল।
সরু গলি পার হয়ে বামে মোড় নিলে দু দোকান পার হয়ে রণ দাদুর বাড়ি।দোতলায় থাকেন রণপ্রসাদ আর নিচ তলায় ভাড়াটে মুকেশ বাবু। পেশায় কলেজ শিক্ষক ।প্রায় ৩০ বছর ধরে এ বাড়িতে ভাড়ায় থাকছেন তিনি ।নিজ বাড়ি এ এলাকায় হলেও বাবার সাথে মনমালিন্যের কারণে নব বধুকে নিয়ে এ বাড়ীতে বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলেন তিনি। আজ তার স্ত্রী-পুত্র- নাতি নিয়ে পুরো পরিবারই দত্ত বাড়ির স্থায়ী ভাড়াটে।
কমল দোতলায় যাবে ।এর মধ্যেই সিড়ির কাছে দেখা মিললো পুচকে এক বাঁদর-মুকেশ বাবুর নাতির সঙ্গে ।
—কিরে তুই আজ এসময় জেগে আছিস এখনো?তোর তো এখন গভীর ঘুমে থাকার কথা।
ভেতর থেকে ওর মা জবাব দিলো,
—না রে ভাই। আজ রান্না শেষ করতে দেরি হয়ে গেলো। তাই ওকে ঘুম পাড়াতে পারিনি। আমি মাত্র স্নান শেষ করলাম এখনই মশায়ের ব্যাবস্থা করা হবে।
কিছুক্ষণ তার সাথে দুষ্টমি করে সোজা ওপরে চলে গেলো কমল। সিঁড়ির সাথে একটা গেট আছে।সেটা পার হয়ে লম্বা বারান্দা। ঠিক তার মাঝ বরাবর ঘরের সদর দরজা।রোজ এ সময়ে চেয়ারে বসে দোল খেতে খেতে হালকা ঘুম দেন রণ প্রসাদ দত্ত।আজ চেয়ার খালি দেখে কমল ভাবল হয়তো বিছানায়ই শুয়ে পড়েছেন তিনি। কমল কোনোকিছু না ভেবে ঘরে ঢুকল।সোজা তার শয়ন কক্ষে উঁকি দিবে বলে ঠিক করলেও শেষ পর্যন্ত যেতে হলনা তাকে।সোফায় ঘাড় বাঁকা করে শুয়ে আছে রণ দাদু। এমন ভাবে ঘুমালে আজ আর তাকে ঘাড় সোজা করতে হবেনা সে কথা নিশ্চিত ।
কতবার বলেছি,দুপুরে খাবার খেয়ে সোজা বিছানায় শুয়ে পড়বে তা না।এখানে সেখানে বসে ঝিমাবে-বলতে বলতে সে কাছে গিয়ে রণ বাবুর ঘাড়ে হাত দিলো মাথা সোজা করবে বলে। কিন্তু একি!কাটা মুরগী জবাই করে ফেলে রাখলে যেমন গলা থেকে রক্ত বের হয়ে গড়িয়ে চলে।রণ বাবুর কন্ঠের ঠিক নিচে মোটামুটি আঙুল ঢুকানো যাবে এমন এক গর্ত। অবিরত রক্তের ধারা সাদা গেঞ্জি লাল রঙে রাঙিয়ে দিয়েছে। আকষ্মিক এ দৃশ্যে হতভম্ব কমলের গলা থেকে কোনো আওয়াজ বের হলো না।দৌড়ে গিয়ে হাজির হলো নিচ তলায়।আধো আধো বাক্য আর কমলের চোখের চাহনি দেখে কারো আর বুঝতে বাকি রইলো না ভয়ংকর কিছু একটা ঘটেছে।সবাই দৌড়ে এলেন দোতলায়।