পোস্টস

পোস্ট

“পৃথিবীর ইতিহাস বদলে দেওয়া এক মহীয়সী নারী হলেন উম্মুল মু'মিনিন খাদিজাতুল কুবরা বিনতে খুওয়াইলিদ (রা:)

১৩ অক্টোবর ২০২৪

শাহেদ মামুন শাহিন

 

 

 

জন্ম


উম্মুল মু’মিনীন হযরত খাদিজা (রাঃ) এর জন্ম হয় আব্রাহার হস্তীবাহিনীসহ মক্কা আক্রমণের ১৫ বছর আগে ৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে। অর্থাৎ রাসুল ( ﷺ)-এর নবুয়ত প্রকাশের ৫৫ বছর আগে পবিত্র নগরী মক্কায়। তিনি বিখ্যাত কুরাইশ বংশের আবদুল উয্যা নামক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি ছিলেন মক্কার উচ্চ শিক্ষিত ও বিখ্যাত ব্যবসায়ী খুয়াইলি বিন আসাদের দ্বিতীয় সন্তান।


নাম:


নাম- খাদিজা। উপাধি- মুবারাকাহ, তাহেরাহ, কুবরা।উপনাম- উম্মে কাসিম, উম্মে হিন্দ, উম্মুল মু‘মিনীন, উম্মে জাহরা। তাঁর পিতার নাম ছিল খুওয়াইলিদ বিন আসাদ ও মাতার নাম ছিল ফাতিমা বিনতে জায়েদ।

 

শৈশব ও প্রাথমিক জীবনঃ


তৎকালীন প্রতিকুল পরিবেশে লেখা পড়ার কোন সুযোগ না পেলেও শৈশব কাল থেকেই হযরত খাদিজা (রাঃ) বুদ্ধিমতী ও তীক্ষ্ণ মেধাবী ছিলেন। এজন্যই হয়তোবা আরব সমাজের অন্যান্য পরিবারে যখন নারীর স্থান ছিল একেবারেই নিম্ন স্থানে, খুওয়ালিদ পরিবারে খাদিজার (রাঃ) স্থান ছিল তখন অতি উচ্চ স্থানে।

 

প্রথম বিবাহ:


রাসূলুল্লাহ্‌র( ﷺ)-এর সঙ্গে বিয়ের আগে খাদীজার (রাঃ)-এর দু’বার বিয়ে সম্পন্ন হয়। তাঁর প্রথম স্বামীর নাম আবু হালাহ বিন জুরারা তামিমী । আবু হালাহ্‌র সংসারে তাঁর দু’টি সন্তান জন্মগ্রহন করে। এ সংসারে তাঁর গর্ভ থেকে হিন্দ ইবনে আবু হালাহ নামে এক পুত্র ও জয়নাব বিনতে আবু হালাহ নামে এক মেয়ের জন্ম হয়। তবে অন্য একটি বর্ণনা মতে, তাঁর আরও এক পুত্র সন্তানের কথা উল্লেখ রয়েছে যার নাম হালাহ ইবনে আবু হালাহ। এর কিছুদিন পর তাঁর প্রথম স্বামী আবু হালাহ মারা যান।


দ্বিতীয় বিবাহ:


আবু হালাহ্‌র ইন্তিকালের পর আতিক বিন আবিদ  মাখজুমীর সাথে দ্বিতীয়বার তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।সেখানে তাঁর গর্ভে আব্দুল্লাহ ইবনে আতিক নামে এক পুত্র সন্তান ও হিন্দা বিনতে আতিক নামে এক মেয়ে জন্মগ্রহণ করে। তবে তার স্বামী সিরিয়ায় বসরা শহরে মহামারিতে মারা যান,আর রেখে যান অগাধ ধন-সম্পদ।


তবে কা'তাদা এবং ইবনে ইসহাকের মতে তার প্রথম স্বামী আতিক এবং দ্বিতীয় স্বামী আবু হালাহ। ইবনে ইসহাকের এই মত ইউনুস ইবনে বুকাইরের বর্ণনায় পাওয়া যায়। অবশ্য প্রথমোক্ত মতটিই অধিক গ্রহণযোগ্য।

 

ব্যবসা-বানিজ্য:


বার্ধক্যের কারণে এবং কোন পুত্র সন্তান না থাকায় খাদীজার (রাঃ)-এর পিতা তাঁর সমস্ত ব্যবসায়িক দায়-দায়িত্ব কন্যার হাতে সোপর্দ করেন এবং চাচা আমর বিন আসাদের উপর তাঁর অভিভাবকত্বের দায়িত্ব দিয়ে কিছুদিনের মধ্যে তিনি মারা যান। পিতা ও দ্বিতীয় স্বামীর অর্পিত ব্যবসায়িক দায়িত্ব তিনি অত্যন্ত সুষ্ঠুভাবে পালন করতে থাকেন। 

 

খাদিজা (রা:) হয়ে উঠেন মক্কার এক সম্ভ্রান্ত ও ধনাঢ্য নারী। সিরিয়া,ইয়ামেনসহ বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে যাঁর বানিজ্য চলত। তিনি বিভিন্ন মানুষের মাধ্যমে ব্যবসা করতেন,আর মুজারাবা চুক্তির ভিত্তিতে একটি অংশ ওই ব্যক্তির জন্য শুরুতেই নির্ধারণ করে নিতেন। তিনি কেবল একজন সফল ব্যবসায়ী ছিলেন না বরং তার বিশ্বস্ততা, গাম্ভীর্য, সাহস আর দূরদর্শিতার কারণে সমগ্র কুরাইশের মধ্যে ছিলেন অত্যন্ত শ্রদ্ধার পাত্রী।

 

হযরত খাদিজা (রা:)-এর ব্যবসায়িক প্রস্তাব:


এ সময় তিনি এমন একজন যোগ্য মানুষ খুঁজছিলেন, যার হাতে ব্যবসার সকল দায়-দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে তিনি নিশ্চিন্ত হতে পারেন। তিনি মুহাম্মদ (সা:)-এর সততা আমানতকারীতা ও চারিত্রিক পবিত্রতা সম্পর্কে জানতে পারেন। তখন তিনি মুহাম্মদ (সা:) নিকট এক প্রস্তাব করেন যে,তিনি তাঁর পণ্য নিয়ে ব্যবসার উদ্দেশ্যে তাঁর গোলাম মায়সারার সঙ্গে সিরিয়ায় গমন করতে পারেন। এছাড়া খাদিজা (রা:) প্রস্তাব করেন,অন্যান্য ব্যবসায়ীগণকে যে হারে মুনাফা প্রদান করা হয়, তাঁকে তার চাইতে অধিক মাত্রায় মুনাফা প্রদান করা হবে। হযরত মুহাম্মদ  (সা:) এই প্রস্তাব গ্রহণ করলেন এবং তার পণ্য-সামগ্রী নিয়ে গোলাম মায়সারার সঙ্গে সিরিয়ার অভিমুখে গমন করলেন। 

 

সিরিয়াতে তিনি এক যাজকের গির্জার নিকটবর্তী এক গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নেন। এমন সময় যাজক এসে মায়সারাকে জিজ্ঞেস করেন,'গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নেওয়া যুবকটি কে?' তখন মাইসারা বলল,'তিনি বায়তুল্লাহ কাছে বসবাসকারী কুরাইশ বংশের একজন'। যাজক বলেন,'এ গাছের ছায়ায় নবী ছাড়া আর কেউ কখনো বিশ্রাম নেয়নি।' এরপর মুহাম্মদ (সা:) নিয়ে আসা পণ্যসামগ্রী বিক্রি করেন, তারপর প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসও কিনলেন। এরপর মাইসারাকে নিয়ে মক্কার পথে রওয়ানা হলেন। পথিমধ্যে মাইসারা দেখে, যখন সূর্য ওঠে আর প্রচন্ড গরম পড়ে,তখন দু'জন ফেরেশতা মুহাম্মদ (সা:)-কে সূর্য থেকে ছায়া দিচ্ছেন,আর তিনি উটের পিঠে চড়ে চলতে থাকেন। সিরিয়া থেকে যুবক মুহাম্মদ (সা:) প্রত্যাবর্তনের পর হিসাব-নিকাশ করে আমানত সহ এত বেশী পরিমাণ অর্থ তিনি পেলেন, যা ইতিপূর্বে কোন দিনই পাননি।


খাদিজা (রা:)-এর গোলাম মাইসারা হযরতের মুহাম্মদ  (সা:) মিষ্টভাষিতা, সত্যবাদিতা, উন্নত চিন্তা-ভাবনা, আমানতদারী এবং পথে যাজকের কাছে যা শুনেছে সব বিষয় অবগত করেন।

 

খাদিজা (রা.) কী ধরনের ব্যবসা করতেন?

 

সাইয়িদা খাদিজা (রা.)–এর জন্য জীবন সামলে নেওয়া খুব সহজ ছিল না। স্বামীর বিয়োগ–বেদনায় ক্লিষ্ট ছিল তাঁর জীবন। কঠিন সেই সময় সামলে নিতে ব্যবসায় মনোযোগী হন তিনি। জীবনের সব বিপদ-আপদ অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে সামলে নেন খাদিজা (রা.)। কোনো হতাশা থামিয়ে দিতে পারেনি তাঁকে। একাকী জীবনটা এগিয়ে নেওয়ার তাগিদেই সম্পদ বৃদ্ধি এবং ব্যবসায় মনোনিবেশ করেন তিনি। বহুকাল ধরে পিতা যে ব্যবসার কাজে নিমগ্ন ছিলেন এবং স্বামী যে ব্যবসার সমৃদ্ধিতে দেশ-বিদেশে সফর করেছেন; সেই ব্যবসা এগিয়ে নিতে পূর্ণভাবে ব্যবসায় মনোযোগী হয়েছেন খাদিজা (রা.)। তখনো কি তিনি জানতেন, ব্যবসার এই পথে তাঁর স্বপ্নপুরুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে? তিনি কি আদৌ ভেবেছেন, বাণিজ্যের এই অঙ্গনে একজন মহামানবের সংস্পর্শে ধন্য হবে তাঁর ভবিষ্যৎ জীবনসংসার? 

 

খাদিজা (রা.) কী ধরনের ব্যবসা করতেন, এ ব্যাপারে ইতিহাসের গ্রন্থগুলোতে স্পষ্টভাবে বিস্তারিত বিবরণ তেমন পাওয়া যায় না। তবে তাঁর ব্যবসা–সংক্রান্ত আলোচনায় যে বিষয় বারবার উল্লেখিত হয়েছে, সেটা হলো দূরদেশে বা দূরবর্তী শহর-নগরীতে তাঁর বাণিজ্য কাফেলা যেত এবং নারী হওয়ার কারণে যেহেতু তিনি কাফেলার সঙ্গে যেতে পারতেন না; এ জন্য ব্যবস্থাপক নিয়োগ করতেন। এসব বর্ণনা থেকে অনুমান করে ইতিহাসবিদেরা বলেছেন, খাদিজা (রা.)-এর মূল ব্যবসা ছিল আমদানি ও রপ্তানি। সিরিয়ার মতো দূরবর্তী বাজারে তিনি পণ্য রপ্তানি করতেন এবং তাঁর নিয়োগ করা ব্যবস্থাপকেরা মক্কার বাজারে বিক্রি করার জন্য দূরবর্তী শহর ও বাজার থেকে পণ্য কিনে আনতেন। প্রায় সব অঞ্চলেই কুরাইশের বাণিজ্য–কাফেলার যাতায়াত ছিল। এ কারণে তারা প্রত্যেক এলাকার পণ্যসামগ্রী নিয়ে আসত। নিজেদের এলাকার পণ্য অন্য এলাকায় নিয়ে গিয়ে বিক্রয় করত। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘আমি কি তাদের একটি নিরাপদ হারামে প্রতিষ্ঠিত করিনি, যেখানে সর্বপ্রকার ফলমূল আমদানি হয় আমার দেওয়া রিজিকস্বরূপ? কিন্তু তাদের অধিকাংশই এটা জানে না’ (সুরা কাসাস, আয়াত: ৫৭)।


ইতিহাসের বিভিন্ন বর্ণনা থেকে জানা যায়, সে সময়ে সাধারণত তিন ধরনের ব্যবসায়িক পণ্যের আদান-প্রদান হতো:


১. মসলা, সুগন্ধিজাতীয় দ্রব্যাদি, আতর, রেশম, কাতান, জাফরান, কাঁচা খেজুর ও মোনাক্কা প্রভৃতি।
২. স্বর্ণ, রুপা, হীরা, তামা ও লোহার পাত্র।
৩. গোশত, চামড়া, হাওদা, উল, হাতির দাঁত, ছাগল-ভেড়া ইত্যাদি।


আরব অঞ্চলে শাম থেকে সবচেয়ে বেশি আমদানি করা হতো গম, আটা, জয়তুনের তেল ও লোবনানের তৈরি সামগ্রী। রপ্তানি পণ্যসামগ্রীর মধ্যে ছিল আরবে উৎপন্ন চর্বি–জাতীয় দ্রব্যাদি, কাঁচা খেজুর, বাবলার মতো দেখতে কারাজগাছের পাতা, যা চামড়া রং করার কাজে ব্যবহার হতো, উট ও অন্যান্য প্রাণীর পশম, চামড়া, ঘি ইত্যাদি।


এ ছাড়া তায়েফের মোনাক্কাও রপ্তানি করা হতো। মক্কার ব্যবসায়ীরা সাধারণত এসব পণ্য শীতকালে ইয়ামান ও গ্রীষ্মকালে শামে নিয়ে যেত। এ থেকে অনুমান করা যায়, খাদিজা (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মাধ্যমেও আরব অঞ্চলে যা উৎপন্ন হতো ওই সব পণ্য বিক্রির জন্য প্রেরণ করেছেন এবং শামের যেসব পণ্যের চাহিদা আরব অঞ্চলে ছিল, সেগুলো এখানে বিক্রির জন্য আমদানি করেছেন।

 

মুহাম্মাদ (সা.) সাথে খাদিজা (রা:)-এর বিবাহ:

 

যুবক মুহাম্মাদ (সা.)-এর সততা, বিশ্বস্ততা, উন্নত চরিত্র ও বুদ্ধিমত্তায় মুগ্ধ হয়ে খাদিজা (রা:) তাকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান। যুবক মুহাম্মদ (সা:) বিয়ের প্রস্তাবের বিষয়টি চাচাদের জানালেন। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর চাচা আবু তালিব /হামজা তখনই তাকে নিয়ে খাদিজা (রা:)-এর পিতা খুওয়ালিদের কাছে যান। খাদিজা (রা:)-এর পিতার সাথে দেখা করার পর উভয় পরিবারের সম্মতিতে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব ও দ্রুত বিয়ে সম্পন্ন হয়। মুহাম্মদ (সা:)-এর চাচা আবু তালিবের সম্মতিক্রমে ২০টি বড় উট মোহর হিসেবে তিনি খাদিজা (রা:) দিয়েছিলেন।খাদিজাতুল কুবরা (রা.) হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রথম স্ত্রী। যখন তাঁর বয়স ৪০ ও মুহাম্মদ (সা.)-এর বয়স ২৫, তখন তাঁদের বিয়ে হয়। বিবাহের পর হযরত খাদিজা (রা.) তাঁর সকল সম্পদের দায়দায়িত্ব রাসুল (সা.)-এর উপর ছেড়ে দেন এবং তাঁকে ইচ্ছামতো সম্পদ খরচ করার অনুমতি দেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) ঐ সম্পদ অসহায় ও গরীব-দুঃখীদের মাঝে বিলিয়ে দেন।

 

সন্তানাদি:


নবীজীর ঔরশে খাদিজা (রা.)-এর দু’জন পুত্র সন্তান এবং চার জন কন্যা সন্তান জন্মগ্রহন করেন। 
দু’জন পুত্র সন্তান হচ্ছেন- 
১). কাসিম (উপনাম তাহির)ও
২). আবদুল্লাহ (উপনাম তায়্যেব)


মুহাম্মদ (সা.)-এর দু’সন্তানই শৈশবে মৃত্যুবরণ করেন। কারো কারো মতে, জন্মের পরপরই তারা মৃত্যুকোলে পতিত হয়।
আর চার কন্যা সন্তান হচ্ছেন-
১).  জয়নব (রা:)
২).  রুকাইয়া (রা:)
৩).  উম্মে কুলসুম (রা:) ও 
৪).  ফাতিমা (রা:)।

 

চারিত্রিক গুণাবলি:

 

তিনি একজন আদর্শ নারী, আদর্শ স্ত্রী, আদর্শ ব্যবসায়ী ও আদর্শ মা ছিলেন। হযরত খাদিজা (রা.) জাহিলি যুগে জন্মগ্রহন করেও সৎ চরিত্রের অধিকারি ছিলেন। হজরত খাদিজা (রা.) তাঁর চারিত্রিক গুণাবলির জন্য ‘তাহিরা’ (পবিত্র) নামে সুপরিচিত ছিলেন। কখনো কোনো অন্যায় ও অসৎ কাজ করেননি। মহানবি (সা.) -এর প্রতি তাঁর প্রবল ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা ছিল। তিনি নারীদের কল্যাণমূলক কাজে বিশেষভাবে মনোনিবেশ করেন। তিনি বিধবা নারীদেরকে আশ্রয় দিতেন ও অবহেলিত নারীদেরকে নিজ বাড়িতে শিক্ষা দিতেন। তিনি অবসর সময়ে সেলাই করতেন।

 

তিনি ছিলেন একজন দানশীল ও দয়ালু ব্যক্তি। তিনি শিশু, অসহায় ও এতিমদের ভালোবাসতেন। ইসলামের কল্যাণে তাঁর সকল সম্পদ দান করার কারণে আল্লাহ তাঁর উপর সন্তুষ্ট ছিলেন। হযরত খাদিজা (রা.)-এর স্বামীভক্তি ছিল অতুলনীয়। তিনি রাসুল (সা.)-এর সকল কাজে শক্তি ও সাহস যোগাতেন। বিপদে-আপদে কাছে থাকতেন, তাঁকে সান্ত্বনা দিতেন।

 

খাদিজাতুল কুবরা (রা.)-এর শ্রেষ্ঠত্ব 


ইসলামের বৈশিষ্ট্য ব্যক্তিবর্গের সাথে খাদিজা (রা.)-এর সম্পর্কই তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব বহন করে। এ ছাড়াও রাসূলে করীম (সা.) নিজ মুখে খাদিজা (রা.)-এর শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করে গেছেন। হযরত আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণিত -তিনি বলেন আমি রাসূল (সা.)-এর মুখে বার বার হযরত খাদিজার (রা:) প্রশংসা শুনে একবার বিরক্ত হয়ে মুহাম্মদ (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করলাম, "আপনি কি খাদিজার (রা.) মত আর কোন নারী দেখেন না?" আপনার মুখে সব সময় তার প্রশংসার কথা শুনি। উত্তরে নবীজী (সা.) বললেন না, 'খাদিজার মত আমি আর কোন নারীকে দেখি না। দুনিয়ার কোন নারীর পথে তার তুলনা হয় না।'

 

উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়িশা (রা.) অপর একটি হাদীসে বর্ণনা করেন,একদা আমি রাসূল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলাম, "আপনি খাদিজার মত এক বৃদ্ধার কথা কেন ভুলতে পারেন না"? খাদিজা অপেক্ষা ভাল স্ত্রী আল্লাহ তা‘আলা এখন আপনাকে দান করেছেন। আমার একথায় রাসূলুল্লাহ (সা.) এত রাগ করলেন যে, তার চেহেরার দিকে আমি তাকাতে সাহস করলাম না। আমি ভীত হয়ে অন্তর থেকে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করলাম- ''হে আল্লাহ আমার প্রতি রাসুলের রাগ কমিয়ে দাও''। কোনদিনই আমি খাদিজা (রা:) বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ করব না। আমার অনুতপ্তের অবস্থা বুঝতে পেরে অবশেষে রাসূল (সা:) অপেক্ষাকৃত শান্ত সুরে আমাকে বললেন হে আয়েশা! খাদিজা সম্পর্কে এমন কথা তুমি কিভাবে বলতে পারলে? যখন দুনিয়ার প্রত্যেকটি লোক আমার শত্রু ছিল,তখন একমাত্র খাদিজায় আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল, সেই সর্বপ্রথম ইসলাম কবুল করেছিল। হে আয়েশা! সেই সত্তার কসম যার হাতে আমার প্রাণ, আল্লাহ তাআলা এখন পর্যন্ত খাদিজা অপেক্ষা উত্তম স্ত্রী আমাকে দান করেন নি।


হজরত খাদিজা রা. সম্পর্কে বলতে গিয়ে নবী করিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন" যে সময় লোকেরা আমার সঙ্গে কুফরি করল সেই সময়ে তিনি আমার প্রতি নিটোল বিশ্বাস স্থাপন করলেন, যে সময় লোকেরা আমাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করল সে সময় তিনি আমাকে দান করলেন, আর লোকেরা যখন আমাকে বঞ্চিত করল, তখন তিনি আমাকে তার সম্পদে অংশীদার করলেন। আল্লাহ আমাকে তার গর্ভে সন্তানাদি প্রদান করলেন, অন্য কোনো স্ত্রীর গর্ভে সন্তান দেননি। (মুসনাদে আহমাদ, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. : ১১৮)"


রাসূলের জীবনের কঠোরতম সংকটময় সময়ে খাদিজার (রাঃ) এই সীমাহীন অবদানের জন্য রাসূলুল্লাহ (সা:) তাকে এত বেশী ভালবাসতেন যে, আয়েশা (রা:)মত পতিপ্রাণা, জ্ঞানী ও খোদাভীরু মহিলা তাঁর প্রতি ঈর্ষান্বিত না হ’য়ে পারেননি। মা আয়েশা (রা:) নিজেই বলেছেন, ‘আমি কখনই রাসূলের (সা:) অপর কোন সহধর্মিণীর প্রতি তেমন ঈর্ষাপরায়ণ ছিলাম না-যেমন ছিলাম হযরত খাদীজা (রা:)-এর প্রতি। আমি অনেক সময় রাসূল (সা:) খাদিজা (রা:)-এর প্রশংসা করতে শুনেছি এবং বলতে শুনেছি ‘তাঁকে আল্লাহ জান্নাতে মণিমুক্তা খচিত একটি ঘরের শুভসংবাদ প্রদানের হুকুম দিয়েছেন’। আর যখনই রাসূল (সা:) কোন ছাগল জবাই করতেন, তখন তার থেকে একটি বড় অংশ খাদীজা (রা:)-এর বান্ধবীদের নিকট হাদিয়া স্বরূপ পাঠাতেন।

 

খাদিজাতুল কুবরা বিনতে খুওয়ালিদ (রা:)যেভাবে ইন্তেকাল করেছিলেন

 

নবীজির চাচা আবু তালিবের মৃত্যুর দু-মাস পর (মতান্তরে মাত্র তিন দিন পর) উম্মুল মুমিনিন খাদিজাতুল কুবরা রা. মৃত্যুমুখে পতিত হন। তার মৃত্যু নবুওয়াতের ১০ম বর্ষের রমজান মাসে হয়। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৫ বছর। রসুলুল্লাহ তখন অতিবাহিত করেছিলেন তার জীবনের ৫০তম বছর। রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনে খাদিজা রা. ছিলেন আল্লাহ তা'য়ালার এক বিশেষ নেয়ামতস্বরূপ। দীর্ঘ ২৫ বছর যাবৎ আল্লাহর নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সাহচর্য দিয়ে, সেবা-যত্ন দিয়ে, বিপদাপদে সাহস ও শক্তি দিয়ে, অভাব-অনটনে অর্থসম্পদ দিয়ে, ধ্যান ও জ্ঞানের প্রয়োজনে প্রেরণা ও পরামর্শ দিয়ে ইসলাম বীজের অঙ্কুুরোদগম এবং শিশু ইসলামের লালন-পালনের ক্ষেত্রে তিনি যে অসামান্য অবদান রেখেছেন ইসলামের ইতিহাসে তার কোনো তুলনা মিলে না।

 

                         সমাপ্ত