১০ অক্টোবর প্রথম আলো পত্রিকায় সংবিধান নিয়ে জামায়াতের আমির শফিকুর রহমানের বক্তব্য ছাপা হয়। সেখানে জামায়াতের আমির বলেছেন, ‘বাংলাদেশের সংবিধান ভারতের মাটিতে বসে রচনা করা হয়েছিল। তাই আমাদের সংবিধান জন্মভূমি হিসেবে বাংলাদেশকে পায়নি।’ তাই তিনি তাঁর ভাষায় বাংলাদেশে বানানো নতুন সংবিধান চেয়েছেন। প্রথমত অভিযোগটা ডাহা মিথ্যা। এবং অভিযোগের যুক্তিটা ভয়াবহভাবে খোঁড়া। ডা. শফিকুর রহমানের মতো সজ্জন ও মিষ্টভাষী ব্যক্তি এমন হীনজ্ঞানপ্রসূত মিথ্যা অভিযোগ দাড় করাতে পারেন -এটা অবিশ্বাস্য।
ইন্টেরিম গভমেন্ট হয়ত সংবিধান বিষয়ে কোনো মন্তব্য করবার অধিকার রাখে না। তবে যথোচিতভাবে এই অসত্য অভিযোগের কড়া প্রতিবাদ এসেছে সংবিধান প্রণয়ন কমিটির পরিবারগুলো থেকে। সংবিধান প্রণয়ন কমিটির ৩৪ জনের মধ্যে এখনো চারজন জীবিত আছেন। তাঁরা হলেন ড. কামাল হোসেন (সভাপতি), ব্যারিস্টার আমীর–উল ইসলাম, অধ্যাপক আবু সৈয়দ ও আবদুল মুত্তাকিম চৌধুরী।
জামায়াতের আমিরের ওই বক্তব্যের প্রতিবাদে খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্যদের পরিবারগুলোর বিবৃতিতে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের মাটিতেই সংবিধান রচিত হয়েছে। বাংলাদেশ সংবিধান খসড়া কমিটির সদস্যরা দিনরাত পরিশ্রম করে জনগণের স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে রচনা করেন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সংবিধান। দীর্ঘ সময় ধরে আলাপ-আলোচনা ও তর্কবিতর্কের পরে ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের মাটিতে সংবিধান বিল গণপরিষদে পাস হয়। ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর প্রথম বিজয় দিবসে সংবিধান কার্যকর হয়।
জামায়াতের আমিরের অভিযোগের পার্সপেক্টিভে আমরা দুইটা ঐতিহাসিক সত্য তুলে ধরতে পারি।
রাজনৈতিক ও ডানপন্থী মুসলিম জাতীয়তাবাদী আন্দোলন জামায়াতে ইসলামী (উর্দু: جماعت اسلامی) ইসলামি ধর্মতত্ত্ববিদ ও সামাজিক-রাজনৈতিক বিশ্লেষক সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদুদী দ্বারা ১৯৪১ সালে ব্রিটিশ ভারতে প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৪৭ এ দেশভাগের পর মওদুদীর জামায়াত পড়ে যায় পশ্চিম পাকিস্তান অংশে। ওটার শাখা বাংলাদেশে গড়ে উঠলেও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের এখানকার অংশ আমাদের মুক্তিকামী জনতার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়। পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর সমস্ত যুদ্ধাপরাধে কোলাবোরেটর হিসেবে কাজ করে।
এখন বলেন ভারতীয় প্রোডাক্ট হিসেবে একটি রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের ঘোরতর বিরোধিতা করেও 'জামায়াতে ইসলামী' কিভাবে বাংলাদেশকে পায়?
আমরা ডা. শফিকুর রহমানের দলের অতীত কীর্তি কীর্তিনাশায় ডুবিয়ে দিয়ে তাদের আপন করে নিয়ে মনের গহিনে জায়গা দিয়ে রেখেছি। দলটি তিপ্পান্ন বছরের বাংলাদেশের ইতিহাসে এই মুহূর্তে ক্ষমতার ভরকেন্দ্রে অবস্থান করে সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। অচিরেই হয়ত জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে মহামহিম মসনদে বসে পড়বেন। তারপরও ডা. শফিকুর রহমানরা আর কী অর্জন করতে চান যে, বাংলাদেশের সাংবিধানিক সত্য নিয়ে মিথ্যাচার করতে হয়? ডা. শফিকুর রহমান আপনার মুখনিঃসৃত ভাষণ আমরা পছন্দ করি। কিন্তু মিথ্যা কথা একদম না!
পবিত্র কুরআনের সুরা বাকারার ৪২ নাম্বার ভার্স 'তোমরা সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশ্রিত করো না এবং জেনে শুনে সত্য গোপন করো না' -আমাদের সবার চেয়ে ভালো জানে ধর্মকে রাজনৈতিক উদ্দেশে ব্যবহার করা জামায়াত।
ফুটনোটস:
১.
১৯৪৭ এ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ৮ বছর অপেক্ষা শেষে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ্'র নেতৃত্বে ১৯৫৬ তে সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। সেই সংবিধানও ব্যর্থ হয় ১৯৫৮ সালে। পাকিস্তানের পরের দিনগুলো সংবিধানবিহীন মার্শাল ল'তে কেটে যায়। যদিও রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে ১৯৫৮ সালে অন্য সব দলের সাথে জামায়াতের কার্যক্রমও নিষিদ্ধ করেন তখনকার সেনা শাসক আইয়ুব খান। তবে সত্তরে চারটি আসন পাওয়া জামায়াত পাকিস্তান আমলের শেষের দিকে সামরিক শাসনের অন্যতম বড় সুবিধাভোগী।
২.
পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বড় সংবিধান ভারতের আর ছোট সংবিধান (মাত্র ১৫-১৬ পাতা) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের, তবে ছয় হাজার শব্দের বেশি নয়। ১৭৭৬ সাল থেকে আজ পর্যন্ত তাদের সংবিধান ছাব্বিশ বার সংশোধিত হয়েছে। যুক্তরাজ্যের সংবিধান অলিখিত। আমাদের সংবিধান লিখিত, দুষ্পরিবর্তনীয়, মৌলিক অধিকার দ্বারা স্বীকৃত, এককক্ষ বিশিষ্ট আইন সভা, ১৫৩টি অনুচ্ছেদ, ১১টি ভাগ, ৪টি মূলনীতি, ৭টি তফসিল, ১টি প্রস্তাবনাসহ পরিপূর্ণ একটি সংবিধান। তবুও আজ পর্যন্ত এ সংবিধানে পনেরবার সংশোধনী আনা হয়েছে। এবার পুরো সংবিধান সংস্কারের আয়োজন চলছে।
৩.
সংবিধান বা পলিটিয়াই ( প্রাচীন গ্রীক : Πολιτεῖαι), ছিল অ্যারিস্টটলের অনুপ্রেরণায় খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে স্বয়ং অ্যারিস্টটল বা তাঁর ছাত্রদের দ্বারা লেখা মনোগ্রাফের একটি সিরিজ। ১৫৮টি অংশের প্রতিটিতে গ্রীক পোলিসের ইতিহাস এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থা বর্ণনা করা হয়। একমাত্র প্রায় সম্পূর্ণ সংরক্ষিত সংবিধান হল এথেনীয়দের সংবিধান এই পলিটিয়াই ।
-ফারদিন ফেরদৌস
১৩ অক্টোবর ২০২৪