(এ লেখাটি একটি পুরোদস্তুর নারীবাদী রচনা)
আপনি পুরুষ। সমাজের চোখে আপনি পুরুষ সিংহ। আপনার সংসারে সিংহভাগ ব্যয় আপনি বহন করেন। আপনার স্ত্রী সংসার ও সন্তান নিয়েই ব্যস্ত। তিনি উচ্চ শিক্ষিত, রুচিশীল মানুষ। উন্নত মননের মানুষ। কিন্তু শুধুমাত্র সংসারের কর্তা (?) হবার সুবাদে আপনি আপনার জীবনসঙ্গীকে অকথ্য অপমান করে যাচ্ছেন বছরের পর বছর। কথা বলার সময় ভুলে যাচ্ছেন তিনি আপনার সন্তানের মা, আপনার সহধর্মিণী ও সবার ওপরে তিনি একজন মানুষ। আপনার স্ত্রীর চারপাশে আপনি সীতার বলয়ের মত একটা অদৃশ্য বলয় তৈরী করে রেখেছেন। বাইরের মানুষ সে বলয় দেখেনা। খুব সুক্ষ্ম সে আঁক তদুপরি সুক্ষ্ম তার বাঁধন। যে যা যারা খুব নিকটে আসবে, তারা জানবে আপনি রাবন, না রাম।
আপনি পুরুষ সিংহ। সংসার আপনার টাকায় চলে। সে টাকার অনেক উত্তাপ। সেই তাপে, সেই ভাপে আপনি পুড়িয়ে দিচ্ছেন আপনার সঙ্গীকে। অবশ্য আপনি তাকে সঙ্গী ভাবেন না। আপনার অসুস্থ বেড়ে ওঠা আপনাকে শিখিয়েছে "ঘরের বৌ এর তেল বের করে দিতে হয়"। কিভাবে টাকা জমানর নামে তাকে সংসার খরচ অর্ধেকে নামিয়ে দিতে হয়, এ অস্বাভাবিক খরচের যুগে স্ত্রীকে টাকা উড়ানোর দায়ে দোষী করতে হয়। আপনি একটা টাকা উপার্জনের মেশিন, টাকা জমানোর কারিগর। আপনার জীবনের লক্ষ্য ভাগাড়ে একটা স্থায়ী আবাস কেনা আর কোটি টাকার ব্যাংক ব্যালান্স। এটা ভেবেও দেখেননা, সেই বোধই আপনার নেই যে প্রিয়জন সাথে না থাকলে এসবে কোন লাভ নেই। ভালবাসাহীন আবাস নরকসম।
আপনি মহামহিম। আপনি পুরুষ। এ সমাজে আপনি প্রায় দেবতার আসনে। আপনাকে ভোগ দিতে হবে গরম গরম ভাত, টাটকা তরকারি। ফ্রিজ ও মাইক্রোওয়েভ আভন নামক আধুনিক ব্যাবস্থায় আপনার বিন্দুমাত্র আস্থা নেই। আপনি সকালের রান্না রাতে খাবেননা। কারণ আপনার মাতাস্রী আপনাকে তাই শিখিয়েছেন। তিনি যা খাননা, আপনিও সেনখাবার এড়িয়ে চলেন। আপনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মত মাতৃভক্ত। প্রয়োজনে দামোদর নদী পাড়ি দেবেন, তবু আপনার স্ত্রীর কষ্টে আপনার কিছু যাবে আসবেনা। তাকে আপনি ঘুমোবার সময়টাও দেবেননা। কারণ সে চাকরি করেনা। বাড়িতে থ্বকে ভ্যারেন্ডা ভাজে।
আপনি পুরুষ কিনা, তাই এটা আপনার অধিকার স্ত্রীর প্রতিটা রান্না, প্রতিটা কাজে খুঁত ধরা। তার রান্না পরিচিত মহলে সমাদৃত, কিন্তু আপনি কখনোই প্রশংসা করবেননা। নারী জাতিকে এত মাথায় তোলার দরকার কি? আপনি চাণক্যের সরাসরি বংশধর।
আপনি পুরুষ মানুষ। আপনি বাড়িতে আসবেন। এসে দেখবেন আপনার স্ত্রী আপনার জন্য পটের বিবি সেজে বসে আছে চা - জলখাবার নিয়ে। কিন্তু, লক্ষ্মীছাড়া নারী তা করেনা। সে তার কাজের উদ্দেশ্যে নানান জায়গায় যায়। আপনার সেই অদৃশ্যবলয় স্বত্তেও সে নিজেকে তৈরী করতে মরিয়া। সে ফিরে আসার পর তার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলতে আপনার বাঁধেনা। তার অত্যন্ত জরুরী মিটিং, গানের আসর ইত্যাদি আপনার কাছে মদ গাঁজার আসর।
আপনি আবার ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির কিনা!
আপনি মহান, আপনি পুরুষ। আপনার কাছে নিজের মা, মা। আপনার সন্তানের মা হল নটী। একজন মানুষকে তিলে তিলে শেষ করার পণ নিয়ে এসেছেন। সে শেষ হলে তবেই আপনি থামবেন। আপনাকে স্বাগতম। আরও চেষ্টা করুন।
তবে ভাববেননা, সকলে আপনার মত পুরুষ সিংহ। এ সমাজে এমন পুরুষও আছে, যারা স্ত্রীর কাজের সুবিধার জন্য চাকরি ছেড়ে দেয়। যারা স্ত্রীকে সর্বোচ্চ সম্মান দেয়, যারা মুখ বুঁজে পোড়া রুটিটাও খেয়ে নেয় কারণ সারাদিন তাদের স্ত্রী সংসার সামাল দিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তারা স্ত্রীর রান্নার প্রশংসা করে। তারা স্ত্রীকে সব কাজে সাহায্য করে। স্ত্রী বাপের বাড়ি বেড়াতে গেলে দিনের পর দিন তার রেঁধে রাখা খাবার খেয়ে নেয়। কারণ তারা উদর ও রসনা সর্বস্ব নয়। সংসারে একত্রে দীর্ঘকাল থাকলে কলহ হবেই। কিন্তু তারা যেহেতু নবাব আলীবর্দি খাঁর সরাসরি বংশধর নয়, তাদের কলহ অপমানের সাগরে পরিণত হয়না।
আফসোস, নিজের অহংকার আর গোঁ বজায় রাখতে গিয়ে মানুষ হিসেবে তলানীতে গিয়ে ঠেকছেন আপনি। তা যতই আপনি সিংহ পুরুষ হোন না কেন।
তাই স্রষ্টার কাছে প্রার্থণা করি, "এবার মরিয়া পুরুষ হইব"। পুরুষ হয়ে দেখব কত মজা।