সুইসাইড নোটটা লেখা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। আরেকবার পড়ে নেব নাকি? বানান ভুল হলে আবার একটা লজ্জার কথা। ওই দেখো। উপেক্ষায় লিখেছি ঊ। একটা সুইসাইড নোট লিখতেও এত ভুল!
আরে সুইসাইড নোটেই তো ভুল হবে। একটু পরেই ছেড়ে চলে যাচ্ছি এ পৃথিবী। অনেক তো হল। আমার লন্ডভন্ড জীবনটা নিয়ে আসলে আর কারো কাছেই যেতে ইচ্ছে করছেনা। দশতলা থেকে যদি লাফিয়ে পড়ি, তাহলে আর বাঁচার জো নেই। একটু কষ্ট হবে বৈকি। সে অল্পক্ষণ। অত ওপর থেকে লাফিয়ে পড়লে কতক্ষণ আর কষ্ট হবে? আমার মেয়ে দুটো কাঁদবে কিছুদিন। তা কাঁদুক। আমি থাকলে এই নিত্য কলহে ওরা এমনিও শেষ হয়ে যাবে। আর আজ যা হল, তারপর আর বাঁচার ইচ্ছে নেই। আমি সব লিখে যেতে পারতাম। না না, সবটা লিখবনা। কায়দা করে লিখতে হবে। সেখানে রাশেদের সব দোষের কথা লিখলে মেয়ে দুটোর কি হবে? কিন্তু রাশেদ যদি বিয়ে করে আরেকটা? করবেই তো। আমাকে কি সে ভালবাসে যে আমি মরে গেলে সন্ন্যাসী হয়ে যাবে? তাহলে আমার মেয়েদুটো? আচ্ছা, আমি না থাকলে ওদেরও তো বেঁচে থেকে লাভ নেই। তাহলে ওদেরও শেষ করে দিয়ে যাই৷ সৎ মায়ের হাতে মরার চাইতে আমার হাতেই মরুক। একসাথে থাকব আমরা ওপারে৷ ওরা নানা নানুকেও পাবে। আবার আমরা আগের মত একসাথে থাকব। ভাবতেই আমার আনন্দ হচ্ছে। তাহলে সুইসাইড নোটে রাশেদের সব কুকীর্তি লিখে ফেলি চটপট। সংক্ষেপে লিখতে হবে। একেবারে আঁটোসাঁটো কিন্তু সব তথ্য থাকবে।
ক'টা বাজল? ওরে বাবা, সাড়ে তিনটা! দেরী হয়ে যাচ্ছে। দুই মেয়েকে শেষ করে, নিজেকে শেষ করতে সময় লাগবে অনেক।
চারটা বাজল। ফযরের আযান দিচ্ছে। যাই, টেরাসে গিয়ে একটু দেখে আসি কতটা নিচে লাফিয়ে পড়ব। এই শেষ লাইনটা লিখে ফেললাম। "আমাদের মৃত্যুর জন্য একমাত্র দায়ী হল রাশেদ আবেদীন।" ব্যস, এবার যাবে কোথায়? কলমটা রেখে দিই। যাইরে কলম। কত লেখার সাক্ষী তুই।
পানি খেয়ে নিই। মরার আগে পানি না খেলে চলে? এখন কি করব? কলেমা পড়ব? আত্মহত্যার আগে কি কলেমা পড়তে হয়?
ঘুমন্ত সন্তানদের দিকে তাকিয়ে কেঁদে ফেললাম৷ তবু, রাশেদের কাছে থাকার চাইতে আমার সাথেই চলুক।
দরজা খুলে টেরাসে এসেছি। আহ! ভোরের বাতাস কি স্নিগ্ধ, কি পবিত্র। শেষবার প্রাণ ভরে বাতাস নিলাম বুকে। পূবাকাশ আলো হয়ে যাচ্ছে। সূর্যোদয় কি সুন্দর! কী এক নাম না জানা পাখি ডেকে চলেছে। হঠাৎ চোখ গেল আমার নিজের হাতে লাগানো অলকানন্দা গাছটার দিকে৷ বাহ! গাছটা বেঁচে উঠেছে যে! আবার ফুলও ফুটেছে। মনটা এখন চাইছে ঘরে চলে যেতে, বাচ্চা দুটোকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকতে। ভোরের আবছা আলোয় দাঁড়িয়ে খুব করে কেঁদে নিলাম। চোখ মুছে ঘরে এলাম। রিনিকা, বেণুকা কি অঘোরে ঘুমোচ্ছে! কি নিষ্পাপ, সুন্দর দৃশ্য! বরাবরের মত ওদের মাঝখানে শুয়ে পড়লাম। শেষবার। এই শেষবার।
চোখ মেলতে গিয়ে দেখি কড়া রোদ লাগছে। হায় হায়, মরিনি তবে? সারা গায়ে হাত বুলোলাম। কোথাও কোন রক্ত নেই, ক্ষত নেই। কিন্তু রাস্তার পিচ তো নরম হবেনা। ওহ! আমি তবে বিছানায়? লাফ দিইনি? বিষ খেয়েছি? মেয়ে দুটো কোথায়? ওরা বেঁচে আছে? ওদের আমি কী করেছি মনে করতে পারছিনা। ভাবতে ভাবতেই ছয় বছরের রিনিকা আর দুই বছরর বেণুকা দৌঁড়ে এসে জড়িয়ে ধরল। মা, ওঠনা কেন?ক্ষিদে পেয়েছে খুব।
অসম্ভব ভার হয়ে যাওয়া মাথা নিয়ে উঠে বসলাম। ওদের দুজনকে চুমু দিয়ে রান্নাঘরের দিকে গেলাম খাবারের ব্যাবস্থা করতে।
দুজনকে খাইয়ে দিয়েছি। নিজেও খেয়ে নিয়েছি। টেবিলে চিঠিটা এখনও চাপা দিয়ে রাখা। একটা স্যুটকেস, বাচ্চা দুটো আর চিঠিটা হাতে বেরিয়ে এলাম রাশেদ আবেদীনের প্রাসাদোপম ফ্ল্যাট থেকে। আপাতত গন্তব্য থানা। সেখানে চিঠিটা পৌঁছে দিয়ে ট্রেনে উঠব। আমাদের তিনজনের চুড়ান্ত গন্তব্য সেখানেই যেখানে গেলে আমরা প্রাণভরে বাঁচতে পারব।