অকস্মাৎ শান্তি রামের কলার ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে জিজ্ঞাসা করছে কমল
—কেন কেন এসেছো এতদিন পর, কি জন্য এসেছো?খুনি একটা। আমার মায়ের খুনি তুমি।তোমার জন্যই আমার মা মারা গেছেন।
জামশেদ হক আটকালেন না কমলকে। ছেলেটা একটু হালকা হোক।একসাথে এতগুলো ধাক্কা সে নিতে পারছেনা।
শান্তি রামের চেহারা নির্বাক। মুখে কোনো কথা নেই।তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে মাটির দিকে।
কমল কাঁদছে।
একটু পর জামশেদ সাহেব শান্ত গলায় বললেন,
—সরাসরি জিজ্ঞাসা করছি,রণপ্রসাদ দত্তকে আপনি খুন করেছেন?
অবাক চোখে তাকাল শান্তি রাম। সব ভাষা হারিয়ে যেন পাথর হয়ে গেছে সে। অস্ফুট স্বরে বলল, বাবু মারা গেছেন?
—খুন হয়েছেন।
—এই লোকটা। এই লোকটা ও পারে আমার দাদুকে খুন করতে। বলো, তুমি খুন করেছো দাদুকে? সত্যি কথা বলো।
শান্তি ঃ—না বাবা না, আমি না। আমি খুন করিনি বাবুকে।
কমলঃ—মিথ্যা, মিথ্যা বলছো তুমি।
—না, না, আমি সত্যি বলছি।
জামশেদঃউনি সত্য বলছেন কমল।ওনাকে ছেড়ে দাও।
কমলঃ—আপনি ওনার কথায় ভুলবেন না স্যার।এই লোক সব পারে।যে তার শিশু পুত্র আর অসহায় স্ত্রীকে ফেলে চলে যেতে পারে সে নির্দয় লোক সব কিছু করতে পারে। সবকিছু।
জামশেদঃ—উনি মাত্রই এই এলাকায় এসেছেন।আর সরাসরি তোমার কাছেই এসেছেন। আমার মতে উনি যে এতদিন পর ফিরে এসেছেন এটা এখনো অব্দি তুমি আর আমি ছাড়া আর কেউ জানেনা।
শান্তিঃ—হ্যাঁ হ্যাঁ সত্যি সত্যি। আমি বাসস্ট্যান্ড থেকে সোজা তোমার এখানে এসেছি।আমাকে বিশ্বাস করো।
কমলঃ—স্যার,আপনি এত শিওর হলেন কিভাবে?
জামশেদঃ—ওনার সাথে থাকা ব্যাগ এর দিকে দেখো।আমার মনে হয় ওতে সামান্য কিছু জামা কাপড় পাওয়া যেতে পারে।চেইন পুরোটা লাগানো যায়না তাই দেখা যাচ্ছে ভিতরে।তার মানে উনি এখানে এসেছেন থাকার প্রস্তুতি নিয়ে।ওনার পায়ের জুতোতে কাদা লেগে আছে।। ময়লা পানি না।আজ এদিকে বৃষ্টি হয়নি।তার মানে উনি দূরে কোথাও থেকে এসেছেন।যেখানে বৃষ্টি হয়েছে। খুনি যদি খুন করে পালিয়ে গিয়ে আবার ফিরেও আসবে তবে সে থাকার প্রস্তুতি নিয়ে নিশ্চয়ই আসবে না। আমার ধারণা উনি ইচ্ছাকৃত ভাবে রাত করে এসেছেন যেন কেউ না দেখে।সুতরাং উনি খুনি হতে পারেন না।
কমল চুপ হয়ে আছে।
শান্তি রাম অবাক চোখে তাকিয়ে আছে লোকটির দিকে।
শান্তি রামের চোখের ভাষা বুঝেই যেন জামশেদ সাহেব নিজের পরিচয় দিলেন
আমি এই থানার ওসি -জামশেদ হক। এই মূহুর্তে রণ বাবুর কেসটা আমিই তদন্ত করছি।এখন বলুন ,শুরু থেকে সুন্দর করে সব গুছিয়ে বলুন।কেন এভাবে, আজ এখানে এলেন।
—একটু পানি খাবো।(শান্তিরাম)
কমল পানি এনে দিলো।
এক ঢোকে সবটুকু পানি খেয়ে ফেলল সে। এরপর কাঁপা কাঁপা গলায় বলতে আরম্ভ করলো,
“মাসখানেক আগে রণবাবু আমায় একটি চিঠি পাঠান।আমার প্রতিবেশী চিঠিটা হাতে পায়।আমি তার বেশ কিছুদিন আগেই এক কাজে অন্য জায়গায় গিয়েছিলাম। গত দু দিন আগে ফিরে এসে চিঠিটা হাতে পাই।”
শান্তি রাম ব্যাগ থেকে চিঠি বের করে জামশেদ সাহেবের হাতে দিলো।
চিঠিটা ডায়রির ভেতরে রাখলেন তিনি। এরপর আবার তাকালেন শান্তি রামের দিকে।
"চিঠি পেয়ে আমি ভাবনায় পরে যাই।এত বছর পর বাবু কেন আমাকে ডেকে পাঠাচ্ছেন। অনেক ভেবেও কোনো কূল কিনারা পাইনা।যদিও চিঠিতে তিনি কমলের জন্য আমায় আসতে বলেছিলেন তবে তার কিছু কথাও ছিলো আমার সাথে।ঠিক করলাম যাব দেখা করতে। আমি চলে যাওয়ার পর কি কি হয়েছে আমি সবই জানতাম। তাই এতদিন পর ফিরে আসতে লজ্জা লাগছিলো। এজন্য ই রাত করে এসেছি।
—সোজা এখানেই আসলেন কেন?
— ভেবেছি কমল আমায় চিনতে পারবে না।অন্য কোনো নামে থেকে যাবো। বাবুর কাছে এসেছি তার পরিচিত কেউ এইসব বলে।তারপর বাবু যদি চান কমলকে আমার আসল পরিচয় জানাবেন তাহলে তিনিই তা করবেন। কিন্তু এসে শুনছি বাবুকে কেউ…
কমল চুপচাপ শুনছে সব। কেন তার দাদু তার বাবাকে ডেকে পাঠিয়েছেন এসব হয়তো আরও ওর মাথাকে এলোমেলো করে দিচ্ছে।
জামশেদ সাহেব কমলকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
"কমল, উনি আর যেই হোন তোমার বাবা।অতীতের ভুল ক্ষমা করে তাকে তুমি আপন করে নিবে। এটাই হয়তো রণ বাবুর ইচ্ছা ছিলো। তাই কষ্ট হলেও ওনাকে তোমার কাছে রাখো আপাতত। কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলে তোমার কিছু বলার দরকার নেই।
আর শান্তি রাম– রণ বাবু যে আপনাকে ডেকে এনেছেন এ কথা কাউকে বলবেন না। নিজের ছেলের কাছে ফিরে এসেছেন।ব্যাস এইটুকুই।"
ঘাড় নেড়ে সায় জানাল শান্তি রাম।
কমল চুপচাপ বসে আছে।পুরোটা ধ্বকল সে এখনো সামলে উঠতে পারছেনা। ছেলেটার জন্য মায়া হচ্ছে জামশেদ সাহেবের।
রাত ১২ টা,জামশেদ সাহেব ঘড়ি দেখলেন। তার ঘুম পাচ্ছে। ডায়রি বা চিঠি কোনোটাই পড়ার ইচ্ছো হচ্ছেনা। তিনি ঘুমানোকেই শ্রেষ্ঠ বলে মনে করলেন।