জানালার বাইরে শেষ বিকেলের সোনালী আলো ছড়িয়ে পড়েছে। সে আলোর আভা এসে পড়েছে কৃষ্ণব্রতর রেওয়াজের ঘরেও। ঘরের একদিক জুড়ে কৃষ্ণব্রত ভট্টাচার্যের তানপুরা, তবলা, হারমোনিয়ম সাজিয়ে রাখা, আরেক পাশে আছে ছোট্ট একটি ডিভান। ডিভানের পাশেই রাখা আছে একটি অত্যাধুনিক মিউজিক সিস্টেম। তাতেই বেজে চলেছে পন্ডিত শিবকুমার শর্মা আর পন্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার বিখ্যাত যুগলবন্দী “Call of the Valley”। ঘরের আবহটা এত চমৎকার যে আবেশে চোখ বুঁজে আসছে রিমিকার। রিমিকা মাহমুদ, পেশায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষিকা ও উদীয়মান উচ্চাঙ্গ সংগীত শিল্পী। আজ বিখ্যাত শিল্পী কৃষ্ণব্রত ভট্টাচার্যের ফ্ল্যাটে এসেছে রেওয়াজ করতে। গত সপ্তাহে যখন শিল্পকলা একাডেমী থেকে চিঠি পেল কৃষ্ণব্রতর সাথে যুগলবন্দী পরিবেশনের, তাও আবার জাতীয় উচ্চাঙ্গ সংগীত সম্মেলনে, বিশ্বাসই করতে পারেনি সে। গুরুজী অবশ্য তাঁর শিস্যকে সবসময় বলে এসেছেন “রিমিকা, তুই পারবিই, শুধু প্রতিদিন রেয়াজটা করিস, তোর কন্ঠের রেঞ্জ অসাধারণ”। নিজের ওপর সেই আস্থাটা তার আছে, তবে এতটা সে আশাই করেনি। কৃষ্ণব্রত তার প্রিয় শিল্পী। কত নিদ্রাহীন রাত সে কাটিয়ে দেয় তার কন্ঠের মালকোষ, ললিত কি মাল্যশ্রী শুনে! দেখাসাক্ষাৎ তাদের হত প্রায়ই বিভিন্ন সংগীত আসরে। কথাও হৎ মেসেঞ্জারে। তবে আজই প্রথম সে কৃষ্ণব্রতর বাড়িতে এসেছে, তারই আমন্ত্রণে। সে জেনেশুনেই এসেছে যে, কৃষ্ণব্রতর স্ত্রী ও সন্তানেরা দেশে নেই। রিমিকা স্বভাবগত বিদ্রোহী, সাহসী। আর কৃষ্ণব্রতর সে অন্ধভক্তও। তাই আর দ্বিমত করেনি।
সংসারের শত ঝামেলা, অনুযোগ বাড়িতে জমা রেখে, এই যে বিকেল শেষের আলোয় সে ভেসে যাচ্ছে সন্তুর আর বাঁশীর মোহনীয় সুরের আবেশে – এ যেন তার কাছে স্বপ্ন। মাঝে মাঝে দুজনে টুকটাক কথা বলছে। কৃষ্ণব্রত রিমিকাকে একটূ বেশীই মনযোগ দেয়। কর্মক্ষেত্র ও সঙ্গীত নিয়ে সদাব্যস্ত থাকলেও রিমিকার সকল ফোন, মেসেজ এর উত্তর সে প্রায় সাথে সাথেই দেয়। রিমিকাও তার মনযোগটাকে বেশ উপভোগ করে, একজন বিখ্যাত মানুষের মনযোগ একজন নবীন শিল্পীর কাছে যথেষ্টই গুরুত্ববহ। দুজন পরিণত বয়সের মানুষ, চল্লিশ পেরনো নরনারী একে অপরের প্রতি মনযোগী হওয়াটা অন্যায় কিছু নয়। অন্ততঃ তারা মনে করেনা। সে সংস্কারও তাদের নেই।
দুজনের হাতের কফি শেষ হয়ে এসেছে। রিমিকার কাছে এ কফিটাও খুব বিশেষ কিছু। এই প্রথম কোন পুরুষ তার জন্য কিছু নিজে হাতে বানিয়ে এনেছে। যতই মাস্টারি কর আর গান গেয়ে বেড়াও, তার স্বামী কুটোটি নাড়বেনা। একসময় সংসারে জুতো সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ করতে হত তাকেই। অবশ্য আজকাল তার হাতে টাকা আসতে শুরু করেছে। সংসার থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছে সে। যতটুকু না করলেই নয়, তার বাইরে সে আর কিছুই করেনা, লোক রেখে দিয়েছে, সময় দিচ্ছে নিজের কাজে। কফি খেতে খেতে এসব সংসারী আলাপ, বাচ্চাদের কথা, গানের কথাই হচ্ছিল তাদের।
হঠাৎ কৃষ্ণব্রত তার হাতের সিগারেট ছাইদানে গুঁজে উঠে এলো ডিভানে বসে থাকা রিমিকার একেবারে সামনে – খুব কাছে। দুহাতে ওর মুখ তুলে ধরল, বলল “আপনি সংস্কারমুক্ত তো”? রিমিকাও তার দুহাত রাখল প্রিয় শিল্পীর দুই হাতের ওপর “আমি সমাজ, সংস্কার কিছুই মানিনা, আপনি জানেন সেটা। তবে আমাকে আপনার ভাল লাগবেনা”। এবার মুখটা নামিয়ে আনে কৃষ্ণব্রত। রিমিকার পেলব মসৃণ কপোলে চুম্বন রেখা এঁকে দিতে দিতে বলে “ভাল লাগছেতো রিমি, আমার যে ভীষণ ভাল লাগে তোমায়”। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে রিমিকার, বুকের ভেতরে ভেঙে চলেছে যেন মেঘনার পার। সেই পার ভাঙা উত্তাল স্রোতে ভেসে যেতে যেতে সে নিজেকে আবার সামলে নেয়, বাধা দেয় কৃষ্ণব্রতকে। কৃষ্ণ কিন্তু কিছু মেনে নেবার অবস্থায় নেই। তার শরীরের ভেতরে বেজে চলেছে দামামা। তার মন বলে চলেছে “এ নারী আমার”- আদরে আদরে সে টালমাটাল করে দিচ্ছে তার সহশিল্পীকে। ওদিকে জানালার বাইরে পশ্চিমের সূর্য পাটে বসেছে। গোধুলী আলোয় ভেসে যাচ্ছে কৃষনপ্রিয়র গানের ঘর, সুরের ঘর। কৃষ্ণ এদিকে রিমিকার পাশে শুয়ে ওকে একটানে ওকে টেনে নিল বুকের ওপর। রিমিকা বাধাও দিচ্ছেনা, সাড়াও দিচ্ছেন, বুঝিবা কিছুটা হতবিহবল সে অথবা পুরোপুরি ঘোরের মাঝে চলে গেছে। সে অবস্থাতেই জিজ্ঞেস করে বসে “আপনি বৌদিকে ভালবাসেননা”? কিছুটা থমকে যায় এবার কৃষ্ণব্রত, অকপটে বলে –“ভালবাসা? ছিল তো, হয়ত এখনও আছে। তবে টান আছে, সেখানে কোনও খাদ নেই”।
“তাহলে”?
“দেখুন, মানুষ মাত্রই বহুগামী, আর দাম্পত্য বয়ে নিয়ে যাওয়াটা খুব একঘেয়ে। আমি স্বাধীন মুক্ত মানুষ। অন্যের ক্ষতি না করে যদি কাউকে কাছে টানি, অবশ্যই তার সম্মতিতে এবং আমার স্ত্রী সেটা না জানে, তবে ক্ষতি কি? আমি তো দায়িত্বে কোনও অবহেলা করছিনা”।
-কিন্তু আমায় তো আপনি ভালবাসবেননা
আবারোও হয়ত থমকে যায় কৃষ্ণ। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে “ভালবাসার তো কত রূপ রিমিকা, আমরা প্রাপ্তবয়স্ক, আমাদের একের অন্যকে ভাল লাগে। আর একটা সম্পর্ক তো আছেই আমাদের তাইনা? সেটাই বা কম কি?” রিমিকা আর কথা বলেনা। কৃষ্ণব্রতর হাত ঘুরে বেড়ায় তার দেহের যত্রতত্র। তবু নিজেকে ধরে রেখেছে সে। হঠাৎ তার ঠোঁটে কৃষ্ণব্রতর ঠোঁটের স্পর্শ পেতেই আর বুঝি পারেনা নিজেকে ধরে রাখতে। জড়িয়ে ধরে তার মধ্যবয়সের গোপন প্রেমিককে। সমাজের চোখে অবশ্যই তা অবৈধ। তবে সে তো সমাজ মানেনা, সে সংস্কারমুক্ত নারী। তার জীবনসঙ্গীর কাছ থেকে পাওয়া অবহেলা, উপেক্ষা অপমানের যে মালা সে গলায় পরে থাকে, আজ তা ছিন্ন করার অবকাশ মিলেছে। সংশয় তবে কেন আর? দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ, নির্জন এক গোধুলিবেলায় একে অপরের কাছে যেন আশ্রয় ঝুঁজে চলেছে। আগ্রাসী কৃষ্ণকে আর থামাবার চেষ্টা করছেনা রিমিকা। তার বসন বিস্রস্ত, তবু সে বিব্রত নয়। যেন কৃষ্ণব্রত তার কতদিনের চেনা।
আচমকা কৃষ্ণব্রত বলে ওঠে, রিমি, আজ থাক।
রিমিকা অবাক হয়না । শুধু জিজ্ঞেস করে, “কেন?”
“নিজেকে ভীষণ আগ্রান্সী মনে হচ্ছে রিমি। আজ প্রথমদিনেই অতটা…।।
তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে রিমিকা বলে ওঠে “সে আপনার ইচ্ছে, আমার দিক থেকে আপত্তি নেই কোনও”।
-“ না গো সুরের রাণী, আমরা সুরের পূজারী। অসুর আমাদের সইবেনা”।
কি জানি কি হয় রিমিকার, কী এক গভীর, পরম নির্ভরতায় মুখ লুকায় কৃষ্ণর প্রশস্ত বুকে। কৃষ্ণপ্রিয়্ও আশ্লেষে জড়িয়ে ধরে তাকে। তার আঙুলে বুনে চলে রিমিকার রেশম মসৃণ চুল, কপালে আঙুল ছোয়, সে আঙুলে ছুয়ে দেয় তার মুদে থাকা দুই চোখের পাতা, তার ভ্রু যুগল। জিজ্ঞেস করে “রিমি, বরকে ভালবাস না তাইনা”?
- “নাহ। বাসিনা। বাসতাম। কতযে ভালবাসতাম তাকে! তাকে ছাড়া কিচ্ছু বুঝিনি। তার জন্য জীবন থেকে চলে গেছে দেড় যুগ। কী পেলাম অসম্মান আর অবহেলা ছাড়া। আমি ভালবাসিনা। শুধু বাচ্চাদের বাবা, মা এই পরিচয়ে পার করে দিচ্ছি জীবন। সবার কপাল তো বৌদির মত নয়” ।
ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে কৃষ্ণ। ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত রিমিকার চোখ বুঁজে আসে। কতদিন, কত বছর পর এ স্পর্শ! চোখ মেলে জিজ্ঞেস করে “দেহের কোন পাপ নেই, তাইনা কৃষ্ণ”?
- “না নেই” ।
- মনের?
- “অপরাধবোধ থাকলে পাপ আছে। তবে সংস্কার না মানলে , পাপপূণ্যে কি যায় আসে? নির্বাণপ্রাপ্তি হলে মানুষ সংস্কার মুক্ত হয়”
- “অথবা সংস্কারমুক্ত হয়েই মানুষ নির্বাণের পথে বেরিয়ে পড়ে”।
জানালার বাইরে নবীন সন্ধ্যার অন্ধকার আকাশে উদাস চোখ রেখে রিমিকা জিজ্ঞেস করে “কিন্তু আমি যদি আপনাকে ব্ল্যাকমেইল করি? যত যাই হোক মানুষটা কৃষ্ণব্রত ভট্টাচার্য”।
স্মিত হেসে কৃষ্ণব্রত বলে “সে বিশ্বাস আমার আছে, নইলে বাড়িতে আসতে বলতাম না”।
-সে বিশ্বাস আমারও আছে আপনার ওপর, নইলে আমিও আসতামনা।
দুজনেই হেসে ওঠে। উঠে পড়ে বিছানা ছেড়ে। সাতটা বেজে গেছে। রেয়াজে বসতে হবে। তারা গাইবে পুরিয়া ধানেশ্রী - সবচাইতে কঠিন রাগগুলোর একটা। পুরবী ঠাটের রাগ, বাদী পঞ্চম সমবাদী ঋষভ। দুজনে রেয়াজে বসে। তানপুরা হাতে কৃষ্ণব্রত। তার সামনে রিমিকা। আলাপ শুরু করে রিমিকাই। কিন্তু পঞ্চমে সুর লাগেনা। এই এক ঝামেলা ধানেশ্রীর। পঞ্চম বড় বেশী স্পষ্ট, জোরালো। দুজনের আলাপের সুর ছড়িয়ে পড়ছে সন্ধ্যার আবহে। কি মায়াময় আবেশ! বিলম্বিত শুরু করে কৃষ্ণব্রত। তার সাথে সঙ্গত করে রিমিকা। বিস্তার শেষে কোনওভাবেই আর সমে আসেনা। দুজনেরইর যেন হঠাত করে রেশ কেটে গেছে। ওদিকে রাত বাড়ছে। কখন ন’টা বেজে গেছে। উঠে পড়ে রিমিকা। দুজনে বিদায় নেয়। রিমিকা কৃষ্ণপ্রিয়র চোখে তাকায়। সে চোখে কেমন এক অস্থিরতা, বুঝিবা অপরাধবোধ। তবু কাছে এসে জড়িয়ে ধরে রিমিকাকে। বলে “ আমি এগিয়ে দিয়ে আসব কিছুটা”? রিমিকা বলে ওঠে “নাহ, আমি একা চলেই অভ্যস্ত কৃষ্ণ, আমি পার্বতী বৌদির কপাল করে আসিনি। আচ্ছা, কৃষ্ণের বৌ পার্বতী কিভাবে হল?”। হেসে উঠে বেরিয়ে পড়ে ব্যাগটা কাঁধে করে। রিক্সায় উঠে একটা মেসেজ পায় মোবাইলে। দেখে কৃষ্ণব্রত পাঠিয়েছে “সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হোক”। উত্তরে সে লেখে “বন্ধু হই কৃষ্ণ, সম্পর্ক বড় বেশী গোলমেলে ব্যাপার”।
বাড়ি পৌঁছে হাতমুখ ধুয়ে ছেলেমেয়ের সাথে বসে পড়ে। আসাদ এখনো ফেরেনি। বাচ্চারা টিভি দেখছিল, মা কে পেয়ে কলকলিয়ে ওঠে। এই নিরানন্দ, একঘেঁয়ে সংসারে সন্তানরাই তার আনন্দের উৎস, একমাত্র নিঃশ্বাস নেবার জানালা। ওদের সাথে কিছুক্ষণ গল্প করে দুজনকে নিয়েই রাতের খাবার খেতে বসে যায়। আসাদ ফিরতে রাত করবে বলেই গিয়েছে। সুতরাং আর অপেক্ষা করেনা। বাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়লে বারান্দায় গিয়ে বসে। আজ মনটা বড় অস্থির। আসাদের মিনি বার থেকে ভদকা নিয়ে এসেছে সামান্য। না নিট নিতে পারেনা সে, মিলিয়েই এনেছে, ধীরে ধীরে চুমুক দিচ্ছে আর ভাবছে আজ সন্ধ্যেটার কথা। তার মনে কোন অপরাধবোধ নেই, কোন গ্লানি নেই। শুধু একটা আশংকা আছে – সুর হারিয়ে ফেলার। তাদের সম্পর্কটা এতদিন পবিত্রতার চাদরে ঢাকা ছিল। আজ যা হল তাতে সেই নির্ভেজাল বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কটা থাকবে কি? আবার ভাবছে, থাকবেনা কেন? শরীর তো আসতেই পারে সম্পর্কের মাঝে। এতে অন্যায় কোথায়? তার তো কোন পিছুটানও নেই। তাকে ছুঁয়েও দেখেনা আসাদ। আজ কতগুলো বছর ধরে বিছানাও আলাদা। তবে আর অন্যায়টা হচ্ছে কোথায়?
ওদিকে ভেবে চলে কৃষ্ণব্রত। রিমিকাকে প্রথম দেখাতেই তার বড় ভাল লেগে গিয়েছিল। অদ্ভুত এক মায়া তার চোখে। মুখশ্রীতে লাবণ্য আর ব্যাক্তিত্বের ছাপ। রিমিকা রুচিশীল, উন্নত মননের অধিকারী, জ্ঞানী ও গুনী নারী। পার্বতী অনেক গ্ল্যামারাস, অনেক গোছানো, সংসার অন্তপ্রাণ। তাকে অসম্মান সে কখনোই করেনা। রিমিকার আগেও দু’ জনের সাথে তার সম্পর্ক হয়েছিল। কিন্তু তাতে শুধু শরীর ছিল, তাই ভাবনা ছিলনা কোন। উভয়পক্ষের কোনদিকেই ভালবাসা ছিলনা। কিন্তু আজ রিমিকার চোখে সে ভালবাসা দেখেছে। শেষ মুহুর্তে সরে যাওয়ার একটাই কারণ – রিমিকাকে সে ভালবাসতে শুরু করেছে। ভালবাসবার মত মেয়েই বটে সে। তার হিংসা নেই, অহংকার নেই, মুক্তমনা, সংস্কারহীন, জড়তাবিহীন। সহশিল্পী হিসেবেও সে চমৎকার। পুরিয়া ধানেশ্রী তো আর সবার আয়ত্তে থাকেনা, রিমিকার আছে। কিন্তু আজ সন্ধায় যে সেই ধানেশ্রীই বিগড়ে গেল। লয় কেটে গেছে, ছুটে গেছে সুর। এমনটা কৃষ্ণব্রত চায়নি, হয়ত রিমিকাও চায়নি।
টুং করে তার ফোনে মেসেজ এলো। রিমিকা পাঠিয়েছে “আজ রাতটা ঘুম কেড়ে নিলেন”। ভীষণ এক অপরাধবোধ গ্রাস করে ফেলল তাকে। এ কী করল সে? শুষ্ক বিশুষ্ক জীবন যে নারীর, তার জীবনে সে কোন মাতাল হাওয়া বইয়ে দিল? এ হাওয়া পরে কালবোশেখীর ঝড় হয়ে উঠবে। থামাতে তো পারবেইনা, গ্রাস করে নেবে সব আলো, সব সুর। আজ মদ্যপানের বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ছিলনা তার। সন্ধ্যের আবেশটা দেহে মনে ছড়িয়ে ছিল। কিন্তু এখন সেই সন্ধ্যের কথা মনে করেই অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে তার। সুন্দর সন্ধ্যেটাই কি ভীষণ গ্লানি, কি ভয়ংকর অপরাধবোধ নিয়ে সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে! শেলফে রাখা হুইস্কি বোতল থেকেই একেবারে নির্জলা ঢালতে থাকে গলায়। নেশার ঘোরে দেখে পার্বতী ঘুরে বেড়াচ্ছে বাড়িতে, সাথে চন্দ্রমান সূর্যমান দুই ভাইও বাবা বাবা করে ঘুরছে পেছন পেছন। নেশার অতলে ডূবে যেতে যেতে আচ্ছন্নের মত রিমিকার কন্ঠে শোনে একবার “ আচ্ছা কৃষ্ণের বৌ কিভাবে পার্বতী হয়”?
ঘুম যখন ভাংল, তখন সকাল এগারোটা। ফোন হাতে নিয়ে দেখে পার্বতী ফোন করেছিল দু’বার। স্ত্রীকে ফোন করে কৃষ্ণব্রত। রুটিনমাফিক কথার পর দুই ছেলেকে ফোন দিয়ে দিদির কাছে চলে গেছে পার্বতী। চন্দ্রমান সূর্যমানের কথা শেষ হলে ফোন রেখে দেয়। ইনবক্সে দেখে রিমিকার মেসেজ “কি, ঘুম ভাংল”? কোনও উত্তর দিতে ইচ্ছা করছেনা তার। মাথা ভার হয়ে আছে অস্বাভাবিক। উঠে মুখ ধুয়ে কফি মেশিন চালু করে দেয়। ব্রেকফাস্ট তৈরী করে খেতে বসেছে, এমন সময় আবার মেসেজ “কি হল কেষ্ট ঠাকুর, ঘুম ভাঙেনি”?
-হুম ভেঙেছে। মাত্র উঠলাম।
-আজ ফ্রি আছি বিকেলে। আসব?
-না রিমিকা, আজ বাদ দিন। শরীরটা ভাল নেই। বাড়িতে বিশ্রাম নেব।
-আচ্ছা।
বলে আর কথা বাড়ায়না রিমিকা। মনের মাঝে একটা অশান্ত মেঘ জমে উঠছে। কৃষ্ণ এড়িয়ে চলছে তাকে। কোথায় সেই রিমি ডাক, কোথায় তুমি সম্বোধন? তার অস্থিরতা তার চলাফেরা, কাজ, বাচ্চাদের সাথে আচরণ সব কিছুতে প্রকাশ পাচ্ছে। আর দশ দিন পরই তাদের মঞ্চ পরিবেশনা। অথচ তার কোন তাগিদ নেই তানপুরায় সুর বাধার। নিজেকে আড়াল করতেই রান্নার কাজে লেগেছে। লম্বা ছুটি শুরু হয়েছে আজ থেকে। আগামীকাল নিজের জন্মদিন উপলক্ষে বাসায় ছোটখাট একটা পার্টি রেখেছে আসাদ। তাই আসাদও সন্দেহ করবেনা কিছু, কারন ঈদ, বাচ্চার জন্মদিন ইত্যাদি বিশেষ দিনের রান্না সে নিজ হাতেই করে মনের আনন্দে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে বিদ্যুৎ ঝলকের মত মনে পড়ে যাচ্ছে গতকাল সন্ধ্যের কথা। দেহে কিশোরীকালের পুলক, মন বিক্ষিপ্ত। রান্নায় ভুল করে ফেলেছে অজান্তে।
যেকোন উপলক্ষের আগে কলহ, অশান্তি আসাদের প্রিয় কাজ। আজও তাই হল। সামান্য কারণে খাবার টেবিলে ছেলেমেয়ের সামনে রিমিকার সাথে এমন আচরণ শুরু করল যা সহ্য করার মত না। এক পর্যায়ে সেখানেই কেঁদে ফেলল সে। বর্ণ , পূর্ণ দুইভাইবোনের চোখও ছলছল করছে। ওরা বড় হয়েছে, কিছুতেই আর এসব সহ্য করতে পারেনা। রিমিকা চোখের জল না মুছেই উঠে পড়ে আধাখাও্যা ভাত ফেলে। ফোনটা হাতে নিয়ে কৃষ্ণকে মেসেজ পাঠায় , “আপনাকে অনেক ধন্যবাদ একজন ক্লান্ত মানুষকে মূল্যবান সময়ের এতটা দেবার জন্যে। ভাল থাকবেন”। মনের মাঝে অশান্তির ঝড় উঠেছে তার। সত্যিই কেউ নেই, কিছু নেই। সন্তান আর সুর ছাড়া। সন্তানরাও তো চলে যাবে বছর পাঁচেক পরই। তখন? এই গবেষণা আর সঙ্গীত নিয়েই কাটিয়ে দেবে জীবন। বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ আসাদ চৌধুরী, অগাধ টাকার মালিক। সাড়ে তিন হাজার স্কয়ারফিটের বিশাল এক ফ্ল্যাট, একটা প্রটোন সাগা আরেকটা হ্যারিয়ার। প্রটোন সাগা ছেলে মেয়েরা ব্যাবহার করে। হ্যারিয়ার আসাদের দখলে। রিমিকার স্বচ্ছলতা আছে। কিন্তু সে গাড়ি কেনেনা। তার রিক্সা, অটোরিক্সা খুব বেশী হলে উবার ট্যাক্সি হলেই চলে যায়। খুব প্রয়োজন না হলে সে আসাদ চৌধুরীর গাড়িতে ওঠেনা সাড়ে তিন বছর হয়ে গেল। এত অসম্মান সহ্য করে এসব আর প্রাণে সয়না। সে শিল্পী, সে গবেষক। টাকার চামার নয়। তার এই বিশাল ফ্ল্যাটে ঝলমল করছে বৈভব, শান্তি নেই কোথাও। অথচ গতকাল কৃষ্ণব্রতর পনেরশ স্কয়ারফিটের ফ্ল্যাটটায় সে দেখেছে ভালবাসার ছড়াছড়ি। প্রতিটা জিনিসে পার্বতীর হাতের ছোঁয়া। এমনটা তো তার সেই আগের ভাড়া বাসাটাতেও ছিল। এই ফ্ল্যাট কেনার পর তার সেসব শখের জিনিস বাতিল করে দিয়েছে আসাদ। ইন্টেরিয়র করিয়েছে নামী আর্কিটেক্টকে দিয়ে। খুব কৃত্রিম লাগে সব তার কাছে, খুব মেকী। শুধু তার ঘরটায় সে হাত দিতে দেয়নি। হ্যাঁ তার ঘর। সে আর আসাদ এক ঘরে এক বিছানায় থাকেনা এখন আর। বার বার এত বেশী অপমানিত হয়েছে যে এখন আর স্বামী স্ত্রীর স্বাভাবিক সম্পর্কটাও রাখেনি রিমিকা। তাতে অবশ্য আসাদ খুব একটা আপত্তিও করেনি। অন্য কারও সাথে সম্পর্ক আছে কিনা তা জানার আগ্রহও আর নেই রিমিকার। সে তার নিজের জগতেই ভাল আছে। মাঝে মাঝে হারিয়ে যাও্যা বাবা মায়ের কথা মনে করে চোখের জলে ভেসে যায়। বড় বেশী একলা সে। সেই একলা জীবনে কৃষ্ণব্রত এসে গিয়েছে স্বাভাবিকভাবেই। কিন্তু সে সম্পর্কেরও তো কোন বৈধতা নেই। দিনে দিনে আরোও জটিল হয়ে উঠবে সব। তখন কিভাবে সামাল দেবে?
সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে সে তানপুরা নিয়ে বসল। নাহ, সুর লাগছেনা। গাইছে ধানেশ্রী, শোনাচ্ছে পুরবীর মত। বেশ কিছুক্ষণ নিজের সাথে, স্বরের সাথে, তালের সাথে তার যুদ্ধ চলল। চিরচেনা দ্রুত খেয়াল “পায়েল কি ঝনকার মোরি” এমন ভাবে গাইছে, যেন মনে হচ্ছে আজই প্রথম কন্ঠে তুলল। খুব অস্থিরবোধ করলে সে তার গুরুজীর সাথে কথা বলে। নিজের ঘরে এসে ফোন হাতে নিল রিমিকা। গুরুজী একবারেই ফোন ধরলেন যেন অপেক্ষায় ছিলেন তার এমন স্বরে বললেন –“ কিরে কি হয়েছে রিমিকা?” এপাশে রিমিকা কথা বলছেনা দেখে বললেন “কাঁদিস কেন? কি হল”? রিমিকা কান্না সামলে বলল “গুরুজী, সুর লাগেনা, তাল কেটে যায়, লয় ঝুলে যায়- আমার ধানেশ্রীও আমায় ছেড়ে চলে যাচ্ছে গুরুজী”। খানিক্ষণ চুপ থেকে পন্ডিত সুনীল রায় বললেন “মন তোর অস্থির। অস্থির মনে কোনও রাগই কন্ঠে বসেনা, আর এ হল পুরিয়া ধানেশ্রী। অস্থিরতা কমাতে হবে। আমার মন বলছে তোর চারপাশে অসুরের ছায়া পড়েছে। অসুরের সাথে সুরের মিতালী হয় কি? তোর জীবনের অসুর তোকেই বধ করতে হবে”। ফোন রেখে দিয়ে স্তব্ধ রিমিকা তাকায় দূর আকাশের পানে। আজ চাঁদ উঠেছে কোজাগরি পূর্ণিমার। সে কি আলো। সে চাঁদ ধরা যায়না, ছোঁয়া যায়না শুধু দেখেই সুখ। মনে মনে গুণগুণ করে গেয়ে ওঠে “হাতের কাছে রহো রাতের চাঁদ গো, ধরা নাহি যায়, ওগো ছোঁয়া নাহি যায়”। ঘরে এসে ল্যাপটপটা খুলে একটা চিঠি লিখতে বসে। তার দীর্ঘ চিঠিটি লেখা শেষ করে পাঠিয়ে দেয় কৃষ্ণব্রতর ইমেইল আইডিতে। একটার পর একটা সিগারেট ধরায় বারান্দায় এসে। চরাচর ভেসে যাচ্ছে পূর্ণিমার আলোয়। আর চোখের জলে ভেসে যাচ্ছে রিমিকা।
সকালে ঘুম ভেঙে নোটিফিকেশন দেখছে কৃষ্ণব্রত। দেখে রিমিকার মেইল এসেছে একটা। পড়তে শুরু করে সব কাজ রেখে। পড়তে পড়তে ওর গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। এ কী হল? কিভাবে সে জড়িয়ে গেল এমন করে? তাকে যে দায়মুক্তি দিল রিমিকা, কিন্তু আদৌ কি সে দায়মুক্ত হতে পারবে? সে পড়ছে সম্বোধনহীন চিঠিটা,
“নিজেকে ভীষণ সস্তা মনে হচ্ছিল। ভেতরের অস্থিরতা কমাতেই চিঠিটা লিখছি। ভুল বুঝবেনা আশা করি। আমি সহজ মানুষ। কপটতা আমার স্বভাব বিরুদ্ধ। তোমায় ভালবাসি, এ সরল কথা সরল ভাবেই বলতে চাই। তোমাকে এক নজর দেখেই আমার সুখ। লোকে বলে, "প্রেমে মজিলে মন, কিবা হাড়ি, কিবা ডোম"। তুমি তো আর তা নও, সে প্রশ্নই আসেনা৷ তুমি আমার কেষ্ট ঠাকুর। যাকে আরাধনা করা যায়, ধরা ছোঁয়া যায়না।
ভেবোনা, সম্পর্ক বা ভালবাসার দাবী নিয়ে তোমার কাছে এসে দাঁড়াব কখনো। কেনই বা আসব বল? তুমি তো আমার নও। ভালও তুমি আমায় বাসবেনা। সে আশাও আমি করবনা।
"ভালোবাসা-যার থেকে আলোকবর্ষ দুরে জন্মাবধি অচ্ছুৎ হয়ে আছি"- হিসেব করে দেখেছি, আজ অব্দি আমায় কেউ ভালবাসেনি। যারাই কাছে এসেছে, খুব হিসেব কষে এসেছে। আমার মনটার দাম কেউ দেয়নি।
হ্যাঁ আমি দাম্পত্য জীবনে একেবারেই সুখী নই। সেখানে অবহেলা, উপেক্ষা, অসম্মান, অর্থ-সম্পদ-প্রতিষ্ঠার মোহ, দোষারোপ সকল কিছুর এক জটিল সহাবস্থান আছে। এসবের সাথে আমার অসম লড়াই চলেছে বহুদিন। কারণ আমি ভালবেসেছিলাম। যখন বুঝেছি লড়াইটা করে লাভ নেই কোন, ততদিনে পেরিয়ে গেছে দেড় যুগ। জালে জড়িয়ে পড়েছি, বেরোবার পথ বন্ধ। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। দায়িত্বগুলো শেষ করে ছড়িয়ে দেব নিজেকে এ পৃথিবীতে, যদি বেঁচে থাকি ততদিন।
তবে সেজন্যে ভেবোনা নিজ প্রয়োজনে, একাকীত্ব ঘুচাতে আমি সেদিন বিকেলে গিয়েছিলাম। আসলে নিজেকে যাচাই করতে গিয়েছিলাম। অথবা, নিছক তোমার সঙ্গ, স্পর্শটা পেতেই। তাই তোমায় বার বার বলছিলাম, তাড়াহুড়ো করোনা। আমায় তোমার ভাল লাগবেনা। হয়ত লাগেওনি।
তোমায় ধন্যবাদ। সেদিনের সেই স্পর্শগুলো আমার বাকী জীবনের উপহার কৃষ্ণ। তোমার কাছে আমি কোনদিন ফিরতি ভালবাসা প্রত্যাশা করবনা। প্রতীক্ষা থাকবে হয়ত। নিজের মনের গ্লানিতে ভুগোনা। তোমাকে আমি ভালবাসি, এর জন্য তোমার বিন্দুমাত্র দায় নেই। সে দায় সম্পুর্ন আমার।
বহুকাল ধরেই শুষ্ক মরুর মত জীবন আমার। তুমি তাতে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে এলে। সম্পর্কটা সেদিন বিকেলের আগ পর্যন্ত যেমন ছিল, তেমনিই থাকুক। ওতেই আমার সুখ। জানোতো দেবতার বেশী কাছে যেতে নেই? তবে দেবতা ডাকলে তার ডাক উপেক্ষাও করতে নেই।
আমি ভালবাসা না পেয়েই অভ্যস্ত। আমি অবহেলা পেয়েই অভ্যস্ত। আর তোমার ভালবাসা? সে আশা করবার দুঃসাহস আমার নেই। শুধু এতদিনের চেনাশোনা, আর সম্পর্কের খাতিরে একটা অনুরোধ করব, আমার কেষ্ট ঠাকুরকে চোখের দেখাটা দেখতে দিও কদাচিৎ। তাতেই আমার সুখ। কেজো কথাতেই না হয় খুঁজে নেব তোমার স্পর্শ। তোমার সুরে খুঁজে পাব ভালবাসা।
এ জীবন তুমি পার্বতীর হয়ে থাকো। জানিনা ঈশ্বর বলে কেউ আছে কিনা, পরজনম বলে কিছু আছে কিনা। যদি থেকেই থাকে তবে আর জনমে তুমি আমার হয়ে এসো। কৃষ্ণব্রত হয়েই জন্ম নিও। এ জীবন না হয় তোমায় চোখে দেখেই কাটিয়ে দেব।
ভাল থেকো কেষ্ট ঠাকুর। শুভ কামনা নিরন্তর। শুভ রাত্রি”।
পড়া শেষ হলে স্তব্ধ হয়ে বসে রইল কৃষ্ণব্রত। গত দু’দিন ধরে সে টালমাটাল হয়ে আছে। রেওয়াজে তো বসেইনি, উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়িয়েছে এখানে সেখানে। সুন্দর স্বাভাবিক একটা সম্পর্ককে নষ্ট করে ফেলার গ্লানি তাকে তাড়িয়ে ফিরছে। নিজেকে আড়াল করতেই সে এড়িয়ে চলছে রিমিকাকে। বুদ্ধিমতি রিমিকাও বুঝে গিয়েছে তার পরিবর্তন। সেদিন যখন তাদের ধানেশ্রীর সুর লাগলনা, তখনই খটকা লেগেছিল তার। সুরের আরাধনা তার আজন্ম সাধনা। সুর তাকে পথ দেখায়। সেদিনও দেখালো। মনের অসুর তার সুর কেড়ে নিচ্ছে। এ কথা অস্বীকারের উপায় নেই যে সে দাম্পত্যজীবনে খুব সুখী নয়। তার গানের জগতটা একেবারেই পছন্দ করেনা পার্বতী। তবু কৃষ্ণব্রত এমন দায়িত্বহীন হতে পারেনা। এ হয়না।
সময় নিয়ে ফিরতি চিঠি লিখতে বসে কৃষ্ণব্রত। না সে হারাতে পারবেনা তার সুরের রাণীকে। বরং আগের মতই সহজ স্বাভাবিক সম্পর্ক থাকুক। অন্ততঃ যুগলবন্দী তো করা যাবে। রিমিকা ছাড়া আর কাউকেই সে পায়নি যার এতটা আয়ত্তে পুরীয়া ধানেশ্রী। গাইবার সময়টুকু অন্ততঃ পাশে থাকা যাবে। সুরের স্পর্শেই না হয় স্পর্শ নেবে তার মানসীর।
চিঠিটা লিখে ফেলে কৃষ্ণব্রত ।
“ সম্পর্ক তৈরি হতে সময় লাগে। নষ্ট হতে এক মুহূর্ত। সম্পর্ক স্বাভাবিক থাকুক। স্বাভাবিক থাকাটা কল্যাণকর মনে হচ্ছে। অস্বাভাবিকতা প্রবেশ না করুক। আমার মনে হলো আমার পুত্রদ্বয় আছে, স্ত্রী আছে। আপনারও স্বামী সন্তান আছে। ফলে আমরা দায়বদ্ধ। তাই স্বাভাবিক সম্পর্ককেই সুন্দর মনে হলো। শুভ কামনা নিরন্তর। আগের মতো সহজ সম্পর্ক সবসময় বজায় থাকবে আশা করি। সুরের সাধনায় অসুরের থাকতে নেই। আমরা আবার রেওয়াজ শুরু করব। আমাদের যে কোন একজনের গুরুর বাড়িতে বসেই তা করা যাবে। যুগলবন্দীটা তো করতে হবে নাকি? দেখা হচ্ছে আগামী কাল”।
ফিরতি মেইলটা যখন পেল রিমিকা, তখন তার বাড়ীতে আসাদের জন্মদিনের পার্টি চলছে। সামনে অতিথিরা সব বসে আছেন। ওদের সামনে থেকে উঠে বারান্দায় চলে যায় রিমিকা। পড়তে থাকে, পড়তেই থাকে চিঠিটা আর অঝোরে ঝরে অশ্রু। মনে মনে আওড়াতে থাকে ;
“তুহুঁ নহি বিসরবি
তুহুঁ নহি ছোড়বি,
রাধা হৃদয় তু কবহি ন তোড়বি
হিয় হিয় রাখিবি অনুদিন অনুক্ষণ”।
চোখের জলে ভেসে চিঠি লেখে আবার ,
“সময়, পারিপার্শ্বিকতা এসবের কারণে প্রায় সময়ই মানুষ আবেগের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেনা। আর মনের ওপর তো কোন জোর চলেনা, মনের বিরুদ্ধে যুদ্ধও চলেনা। ক্ষণিকের অস্থিরতা, আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে আপনাকে বিব্রত করেছি। ওভাবে লেখা আমার উচিত হয়নি। সেজন্যে লজ্জিত ও ক্ষমাপ্রার্থী। সম্বোধন ও সম্পর্ক আগের মতই স্বাভাবিক থাকবে। আমি কাল রেওয়াজ করতে যাব। দেখা হচ্ছে তবে” । চিঠিটা পাঠিয়ে কিছুটা ধাতস্থ হয়ে আবার চলে আসে লিভিং রুমে মুখে হাসি ঝুলিয়ে, ভেতরে ভিসুভিইয়াসের উত্তাপ ছড়িয়ে আছে। তবু, এই তো জীবন।
দশদিন পর
শিল্পকলা একাডেমীর বিশাল মিলনায়তন। মঞ্চে আসন নিয়ে বসেছে বিখায়ত শিল্পী কৃষ্ণব্রত ভট্টাচার্য আর নবাগত শিল্পী রিমিকা মাহমুদ। তারা গািইছে পুরবী ঠাটের সায়ংকালীন সন্ধি রাগ পুরিয়া ধানেশ্রী। তানপুরার ঝংকার আর তবলার বোল সাথে দুই শিল্পীর কন্ঠের জাদুতে মোহাবিষ্ট পুরো হল। মহল জমে উঠেছে যেন। বিলম্বিত শেষ করে তারা দ্রুত খ্যেয়াল গাইছে “পায়েল কি ঝনকার মোরি”। তান, সপাট তানে মুখরিত চারিপাশ। কৃষ্ণব্রত বোলতান করলে রিমিকা ধরছে আ কার তান। কি অদ্ভুত বোঝাপড়া দুই শিল্পীর!। শেষটায় দুজনে একসাথে ছুটতান ধরল। দারুন আবেশ ছড়িয়ে তেহাই দিয়ে শেষ হল তাদের যুগলবন্দী পরিবেশনা। মুহুর্মুহু করতালিতে ফেটে পড়ল পুরো মিলনায়তন। করজোড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে রিমিকা ও কৃষ্ণব্রত। দুজনের হাতে ফুলের তোড়া, গলায় রজনীগন্ধার মালা পরিয়ে দিল আয়োজকদের কেউ।
পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে সুরের পথের দুই শুদ্ধ সারথী। সকল সংকীর্ণতা, সংস্কার, পাপ-পূণ্যের ঊর্ধ্বে গিয়ে, সুরের সাধনায় নিজেদের ছড়িয়ে দেয়া দুই শিল্পীর চোখে তাই আজ আনন্দাশ্রু। দুজনের মনেই ঝড়, দুজনেই ভেবে চলেছে “ভালবাসা এমনও হয়”? অন্তরীক্ষে কেউ বলে উঠল অস্ফুটে; “ভালবাসা এমনই হয়”।