একটি সময়ের কথা, পাহাড়ে ঘেরা, নদী বেয়ে চলা ছোট্ট একটি গ্রাম ছিল, যার নাম সূর্যনগর। এই গ্রামটি ছিল সবুজের সমারোহে পূর্ণ, ফসলের মাঠে ভরা এবং মানুষের হাসি-আনন্দে মুখরিত। গ্রামের সবকিছুই শান্তিপূর্ণ, কিন্তু গ্রামের এক কিশোর, রজন, অন্যরকম ছিল। তার মন সবসময় কৌতূহলে ভরা থাকত। সূর্যনগরের সীমাবদ্ধ জীবনে সে একেবারেই সন্তুষ্ট ছিল না। তার ইচ্ছে ছিল বিশ্বের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়ানোর, সেই বিশাল অজানা জগৎ দেখার যা তাদের গ্রামকে ঘিরে রেখেছিল।
রজনের বাবা-মা ছিলেন সরল কৃষক, যারা প্রায়ই তাকে বলতেন, "গ্রামের বাইরের জগৎ ভয়ংকর। আমরা যে শান্তিতে আছি, সেটাই আশীর্বাদ।" কিন্তু রজনের কৌতূহল কোনোভাবেই থামতে চাইত না।
অজানা জগতের ডাক
এক সন্ধ্যায়, যখন সূর্য পশ্চিমাকাশে ডুব দিচ্ছিল, চারপাশে সোনালি আলো ছড়িয়ে পড়ছিল, রজন নদীর ধারে বসে ছিল, গভীর চিন্তায় মগ্ন। হঠাৎ তার নজরে এলো কিছু অদ্ভুত। নদীর ওপার, ঘন অরণ্যের ভেতর থেকে এক মৃদু আলো ছড়িয়ে পড়ছিল, যেন হাজারো জোনাকি এক জায়গায় এসে জড়ো হয়েছে। অবাক হয়ে সে উঠে দাঁড়াল। গ্রামের প্রবীণরা বরাবরই সতর্ক করতেন, "সন্ধ্যার পর অরণ্যের দিকে যাওয়া উচিত নয়, কারণ অরণ্যটি অভিশপ্ত, সেখানে আত্মা আর অজানা প্রাণীরা থাকে।" কিন্তু রজনের মনে ভয় না, বরং কৌতূহল বেশি ছিল।
একটি ছোট্ট ছুরি আর একটি প্রদীপ হাতে নিয়ে, রজন নদী পার হয়ে অরণ্যের দিকে পা বাড়াল। তার হৃদয় তখন প্রবলভাবে ধকধক করছিল। অরণ্যের গাঢ় সবুজ ছায়ায় ঢুকে, সে এক অসাধারণ দৃশ্য দেখল। একটি পুরনো, বিশালাকৃতির গাছ দাঁড়িয়ে আছে অরণ্যের মাঝখানে, তার শাখাগুলো মচমচে হাতের মতো আকাশের দিকে ছুটছে। এবং গাছের গোড়ায়, এক অদ্ভুত সোনালি রঙের চাবি ঝলমল করছিল।
রহস্যময় চাবি
রজন কোনো কিছু না ভেবেই সেই চাবিটি তুলে নিল। চাবিটি হাতে নেওয়া মাত্রই মাটি কেঁপে উঠল, গাছের শাখাগুলো নড়ে উঠল, আর হঠাৎ একটি বিকট শব্দ হলো। চারদিকে যেন বাতাস ভরে উঠল অদৃশ্য ফিসফিস শব্দে, যেন গাছটি নিজেই কিছু বলতে চাইছে। রজন তাড়াতাড়ি চাবিটিকে পকেটে রেখে পিছু হটতে লাগল, কিন্তু তার পা জমে গেল মাটিতে।
গাছের সামনেই মাটির নিচ থেকে উঠে এলো একটি পাথরের দরজা। রজনের হৃদয় তখন মুখের মধ্যে উঠে এল। দরজাটি পুরনো এবং ময়লা জমে থাকা, কিন্তু চাবির ছাঁচের মতো একটি ছিদ্র তার মাঝখানে দেখা যাচ্ছিল।
প্রাচীন দরজার রহস্য
সাহস করে, রজন সেই চাবিটি পাথরের দরজার ছিদ্রে ঢুকিয়ে ঘুরিয়ে দিল। একটি প্রচণ্ড শব্দে দরজাটি খুলে গেল, আর ভেতর থেকে বেরিয়ে এল একটি ধোঁয়া মাখা আলো। দরজার ওপারে ছিল একটি অন্ধকার গুহা, যার ভেতর থেকে এক জাদুকরী গন্ধ ভেসে আসছিল। সেই মুহূর্তে, রজন বুঝল যে সে হয়তো এমন একটি পথের শুরুতে এসে দাঁড়িয়েছে, যা তাকে জীবনের চিরপরিবর্তন ঘটাতে পারে।
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ভাবার পর, রজন সেই অন্ধকার গুহার ভেতর প্রবেশ করল। গুহার ভেতর থেকে সে এক অদ্ভুত সুর শুনতে পেল, যেন কেউ মৃদু মৃদু গান গাইছে। চারপাশে ছড়ানো পুরনো সব নিদর্শন আর শিলালিপি দেখে মনে হচ্ছিল, এই গুহাটি বহু প্রাচীন কোনো সভ্যতার ছিল, যাদের অস্তিত্ব এখন কেবল গল্পে রয়েছে।
গুহার গভীরে যাওয়ার পর রজন দেখতে পেল এক প্রাচীন ধাতব মূর্তি, যার গায়ে অজস্র মণিমুক্তা খচিত। সেই মূর্তিটির হাতের মধ্যে ধরা ছিল একটি বিশাল ধনুক, আর মূর্তির পেছনে ঝুলছিল এক রহস্যময় লাল রঙের কাপড়। রজন ভাবতে শুরু করল, "এতবড় গোপন ধনসম্পদ এভাবে লুকানো কেন? এর পেছনে কী রহস্য থাকতে পারে?"
রহস্যের উদ্ঘাটন
হঠাৎ, মূর্তির চোখে এক ঝিলিক দেখা গেল, আর সেই লাল কাপড়টি বাতাসে উড়তে শুরু করল। মূর্তির মুখ থেকে বের হলো একটি গম্ভীর কণ্ঠ, "তুমি কী চাও, রজন?"
রজন কাঁপতে কাঁপতে বলল, "আমি জানতে চাই, এই গুহার রহস্য কী? এই ধনসম্পদ কার?"
মূর্তি উত্তর দিল, "এই ধনসম্পদ তাদের জন্য, যারা সত্যের সন্ধানে আসে। কিন্তু যারাই মিথ্যা আশায় আসে, তাদের জন্য এখানে শুধু ধ্বংস অপেক্ষা করে।"
রজন কিছু বুঝতে না পেরে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল। কিন্তু সে বুঝতে পারল, তার সামনে থাকা এই রহস্য তাকে হয়তো জীবনের এক অন্যপথে নিয়ে যেতে পারে, যেখানে অজানা শক্তি আর দুর্দান্ত ক্ষমতা লুকিয়ে রয়েছে।