মানুষের জীবন একটি জটিল ও বহুমুখী অভিজ্ঞতার সমষ্টি। আমাদের প্রতিদিনের কাজ, পরিকল্পনা ও লক্ষ্যগুলো প্রায়শই ব্যবহারিক প্রয়োজনের চারপাশে গড়ে ওঠে। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ও নিরাপত্তা মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান। এ ধরনের প্রয়োজন মেটাতে আমাদের পরিশ্রম ও প্রচেষ্টা কেন্দ্রীভূত থাকে। তবে জীবনের পরিপূর্ণতার জন্য কেবল প্রয়োজনের দিকেই নজর দেওয়া যথেষ্ট নয়। অপ্রয়োজনেরও একটি বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে। এটি মানুষের মানসিক ও নান্দনিক প্রয়োজনকে পূরণ করে।
মার্কাস অরেলিয়াস তার দার্শনিক ভাবনায় বলেছেন, ‘মানুষের সুখী জীবনের জন্য খুবই অল্প কিছু জিনিসের প্রয়োজন, যা প্রতিটি মানুষের মধ্যেই আছে এটি শুধু মানুষের ভাবনার ধরন।’ তার এই কথার মধ্যেই লুকিয়ে আছে একটি গভীর সত্য। মানুষের সুখ ও তৃপ্তির মূল উৎস হলো তার মানসিক দৃষ্টিভঙ্গি। কিন্তু প্রয়োজনীয়তার বাইরেও কিছু বিষয় থাকে যা আপাতদৃষ্টিতে অপ্রয়োজনীয় মনে হতে পারে। কিন্তু জীবনের স্বাভাবিক গতির জন্য ওইগুলোও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
প্রয়োজনের কাজ আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমরা আমাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করার জন্য কাজ করি, যা আমাদের শারীরিক ও মানসিক স্থিতি বজায় রাখে। তবে মানুষ কেবল প্রয়োজনীয় কাজের মাধ্যমেই পরিতৃপ্তি লাভ করতে পারে না। বহু সময় এমন অনেক বিষয় বা কর্মকাণ্ড থাকে, এটি সরাসরি প্রয়োজনের সঙ্গে সম্পর্কিত না হলেও আমাদের মনের গভীরতম স্তরে আনন্দ ও তৃপ্তি এনে দেয়। এগুলোকে আমরা ‘অপ্রয়োজন’ বলে অভিহিত করি। তবে বাস্তবে ওই অপ্রয়োজনের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে জীবনের নান্দনিক রূপ।
কাজের বাইরে ‘অকাজের কাজ’ বা বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ড আমাদের জীবনের অপরিহার্য অংশ। আমরা যখন কোনো সৃজনশীল কাজ, যেমন চিত্রাঙ্কন, গান, সাহিত্যচর্চা, বা ঘোরাঘুরিতে মগ্ন হই, তখন ওই কাজগুলো সরাসরি আমাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করে না। কিন্তু সেগুলো আমাদের মানসিক শান্তি ও তৃপ্তি এনে দেয়, এটি কোনো প্রয়োজনীয় কাজ থেকে পাওয়া সম্ভব নয়।
অপ্রয়োজনীয় কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেই মানুষের সৃজনশীলতা বিকাশ লাভ করে। তার মনের গভীরতায় লুকিয়ে থাকা নান্দনিকতার প্রকাশ ঘটে। যেমন একজন শিল্পী তার কাজের মাধ্যমে জগতের প্রতি তার অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন, এটি প্রয়োজনীয়তার গণ্ডিতে পড়ে না। কিন্তু তা মানবতার জন্য একটি মূল্যবান সৃষ্টি হয়ে দাঁড়ায়।
অপ্রয়োজনের প্রয়োজন বোঝার জন্য জীবনকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হয়। প্রয়োজনীয় কাজ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের একটি অংশ হলেও, অপ্রয়োজনীয় কাজ মানুষকে সৃজনশীলভাবে চিন্তা করতে ও নতুন সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচন করতে সাহায্য করে। শুধু কাজের কাজ করে গেলে জীবনে একঘেয়েমি ও মনস্তাত্ত্বিক চাপ তৈরি হতে পারে। সেখানে অপ্রয়োজনীয় কাজগুলোই আমাদের মনের জড়তা দূর করে এবং জীবনের রঙিন দিকটি দেখিয়ে দেয়।
আমরা অনেক সময় অপ্রয়োজনীয় মনে করে যে বিষয়গুলো এড়িয়ে চলি, একদিন ঠিক ওই বিষয়গুলোর প্রয়োজন অনুভব করি। হয়তো কোনো সময় যে শখের কাজটি আমরা অবহেলা করেছি, তা আমাদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। মানুষের জীবনে এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে যেখানে অপ্রয়োজনীয় কাজ বা অভিজ্ঞতা থেকে পরবর্তী সময় বড় কিছু অর্জন হয়েছে।
অপ্রয়োজনকে অপ্রয়োজনীয় ভেবে দূরে সরিয়ে রাখার প্রবণতা থেকে আমাদের মুক্ত হতে হবে। জীবনের পূর্ণতা পেতে হলে প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয় উভয় দিকেই সমান গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ, কেবল প্রয়োজনের তাগিদে জীবন চালানো সম্ভব হলেও, অপ্রয়োজনের মধ্যে রয়েছে জীবনকে সুন্দর, সৃজনশীল ও পরিপূর্ণ করার এক বিশেষ ক্ষমতা। অতএব, জীবনে অপ্রয়োজনকেও গুরুত্ব দিন, কারণ সেখানেই লুকিয়ে আছে জীবনের নান্দনিক ও আনন্দের প্রকৃত রূপ।