পোস্টস

সমালোচনা

দেওরা গানটা ভালো

১৪ মে ২০২৩

উম্মে রায়হানা

মূল লেখক উম্মে রায়হানা

আমার পাশের বাসায় একটা পরিবার থাকে, যৌথ পরিবার। এই পরিবারের একটা ছেলে মাদকাসক্ত। এই ছেলেকে নিয়ে চারপাশের সবারই অভিযোগ আছে, সে নানা ধরণের নুইসেন্স করে থাকে বলেই আছে। একদিন  বিকেলে আমি নারীকণ্ঠের চিল চিৎকার শুনে বের হয়ে দেখি ওই ফ্ল্যাটের বাইরে ভিড়।  ছেলেটার বোন ছেলেটার দুই হাত ধরে রেখেছে আর এই বাড়ীর বড় ছেলের বউ বলছে, এই ছেলে আমাকে মেরে ফেলবে। 

 

আমি উঁচু গলায় ছেলেটাকে বললাম, আপনার সমস্যা কী ভাই? দুইদিন পর পর কী শুরু করেন! 

 

আমি তাকে ধমক দেওয়ার সাহস করলাম কারণ কয়দিন আগেই সে মদ্যপান করে বাইরের গেটের কাছে বকুল গাছের নিচে বমি করে যথেষ্ট সিন ক্রিয়েট করেছিলো। 

 

আমার কথার উত্তরে সে যা বললো তার অর্থ হচ্ছে, ঝগড়া হচ্ছে। অর্থাৎ এটা তাদের পারিবারিক বিষয়। 

 

সেদিনই সন্ধ্যাবেলায় দেখি বউটা বাপের বাড়ী চলে যাচ্ছে, তার বর তাকে নিয়ে যাচ্ছে, বাচ্চাদের সহই। কিন্তু ওই বড় বোন যেতে দিতে চাচ্ছে না, সে ক্রমাগত বলছে, আমি তোদের বাড়ী আসলাম আর তোরা চলে যাচ্ছিস এ কেমন কথা? বাচ্চাদের তো রেখে যা।  

 

শেষতক বউটা যে যায়নি তা বুঝলাম তার বাচ্চাদের সিঁড়ির ল্যান্ডিং আর গ্যারেজে খেলতে দেখে। 

 

পুরো নাটকের দিন দুই পর রাত দেড়টা দুইটা নাগাদ বউটা আমার কাছে কোলাপ্সিবল গেটের চাবি চাইতে এলো, আমি দরজা খুলতে একটু দেরী করায় আবার চলেও গেলো। আমার কাছে যখন ওই গেটের চাবী ছিলো না তখন আমিও অনেক অসময়ে (যেমন অনেক ভোরবেলা বা সেহেরির সময়) তার কাছে চাবী চেয়েছি, ফলে এটা সে করতেই পারে, আমি জেগে আছি সেই আওয়াজ পেয়েই সে নক করেছিলো। কিন্তু সে চাবী না নিয়েই চলে গেল কেন সেটাই বুঝলাম না। 

 



 

আমি গল্প লেখক হলে এই প্লট নিয়ে একটা মজার ফিকশন লিখতে পারতাম । এই যে মাদকাসক্ত ছেলে, যাকে প্রায়ই বাসা থেকে বের করে দেওয়া হয়, ধরে নেওয়া যেতেই পারে, ও যেন লুকিয়ে বাসায় আসতে না পারে সে জন্য গেটের চাবী থাকে এদের বাবা অর্থাৎ এই বউটার শ্বশুরের কাছে। কিন্তু এ রাত বিরাতে প্রায়ই আসে। কল্পনা করাই যায় যে সে এই মেয়েটিকে দেখতেই আসে। হয়তো মেয়েটার দিক থেকেও আসক্তি আছে। প্রেমের মধ্যে মান অভিমান থাকেই। সবার সামনে দেবর হয়ে ভাবীকে মারতে উদ্যত হওয়ায় মেয়েটির অপমান লাগে, নিজের বরকেও সে কোনভিন্স করতে পেরেছিলো বাপের বাড়ী নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গেলো তো না। অত রাতে সে চাবী নিতে চাচ্ছিলো কার জন্য? কেনইবা পরে আর নিলো না! পাশের বাসার মানুষদের নিয়ে এরকম গল্প কল্পনা করে লিখে ফেলা হয়তো দূষণীয় নয়, কারো নাম তো আর দিচ্ছি না! কিন্তু কেমন একটা ভয়ারিস্টিক মনে হয় নিজেকে! 

 

যা-ই হোক,দেবর ভাবীর সম্পর্কের মধ্যে একটা ইরোটিক ডাইমেনশন আছে। মিথলজির দ্রৌপদী উপাখ্যান এর পিছনে কালেকটিভ আনকনশাস হিসেবে জারি থাকলেও থাকতে পারে।দেবর শব্দের অর্থ দ্বিতীয় বর, আগের দিনে কোন মেয়ের বর মরে গেলে অবিবাহিত ভাই থাকলে তার সঙ্গেই বিয়ে দিয়ে ওই মেয়েকে ওই পরিবারেই রেখে দেওয়া হতো। এই রেখে দেওয়া কেবল সন্তানাদি ও মায়ামমতা সম্বন্ধীয় মনে করা হয়তো ঠিক হবে না। নারীর সম্পত্তি ও শ্রমের ওপর দাবী ছাড়তে না চাওয়াও এই ধরণের বিয়ের পিছনে কারণ হিসেবে কাজ করতো বলে ধারণা করলে সেটা নিশ্চয়ই বড় রকমের ভুল হবে না।  

 

অবশ্য দেবর ভাবী ছাড়াও অন্যান্য বৈবাহিক সম্পর্কের আশেপাশেও এরকম হালকা ডাইমেনশন হয়। সেসবের ইঙ্গিত শিল্প সাহিত্য ও সঙ্গীতে পাওয়া যায়। যেমন-  ‘ও ননদী, আর দু’মুঠো চাল ফেলে দে হাড়ীতে, ঠাকুরজামাই এলো বাড়ীতে’, ‘আসসালামু আলাইকুম বিয়াই সাব’ ইত্যাদি। এই ধরণের সম্পর্ককেই সম্ভবত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলতেন, ঠাট্টা সম্পর্কের আত্মীয়া। 

 

দুই হাজার তেইশের সাতই মে কোক স্টুডিও বাংলা একটা গান রিলিজ করছে, গানের নাম দেওরা। দেওরা- দেওর- দেবর। গানটা আসলে অনেকগুলো গানের ফিউশন। তাতে একটা লাইন হচ্ছে, হাতে লাগে ব্যথা রে, হাত ছাইড়া দেও সোনার দেওরা রে। গানের অনেকগুলো অংশ। নৌকা বাইচ নিয়ে আছে, যাত্রাপালা ফর্মে আছে, অনসাম্বল স্টাইলে আছে, কিন্তু পাঞ্চ লাইন এটাই।  

 

এই গানটা নিয়ে একটা আলোচনা দেখতে পেলাম। ঢাকার হিট অফিসার বুশরা আফরিন তার ফেসবুক পেইজে লিখেছেন,  দেওরা গানে দেবর ভাবীর সম্পর্ক রোমান্টিসাইজ করা হয়েছে। তার এই পোস্ট শেয়ার করছে অনেকেই। এই পোস্ট প্রসঙ্গে বলার আগে বলে রাখা ভালো, বুশরা আফরিনকে ঢাকার তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য হিট অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তিনি এর আগে ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে কাজ করলেও পরিবেশ নিয়ে তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজ নেই। এই রকম পদ তৈরি করে অন্য ফিল্ড থেকে যথেষ্ট তরুণ একজনকে নিয়োগকে নেপোটিজমের প্রমাণ হিসেবেই পাঠ করছে সবাই। সম্ভবত এই কারণেই তার একটু নাইভ একটা ধারণাকেও তার বিরাট গাধামির প্রমাণ হিসেবে দেখানো হচ্ছে ফেসবুক দুনিয়ায়। তবে বুশরার এই পোস্টের অথেনটিসিটি নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। 

 

দেবর-ভাবী সম্পর্ককে রোমান্টিসাইজ করার যে আশঙ্কা বুশরা আফরিন প্রকাশ করেছেন, তার সঙ্গে আমি একমত নই। পরকীয়া বা  ইলিগ্যাল বা ইমমোরাল বা ইনসেস্ট বা সোশ্যালি এক্সেপ্টেবল নয়, এরকম প্রেম এই সমাজেই আছে, ফলে সাহিত্যে, আর্টে, মিউজিকেও থাকবেই। তবে গানের পাঞ্চ লাইনটা নিয়ে আমার অবজারভেশন হচ্ছে, এই লাইনে প্রবল মর্ষকাম দেখা যাচ্ছে। ব্যথাকে সেলিব্রেট করা হচ্ছে। এখানে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই,  নারীর দুঃখ, দুর্দশা, কান্না, হাহাকার সবই বিক্রয়যোগ্য। বিধবা মেয়ের সাদা শাড়ী নিয়ে কাজী নজরুল ইসলামের লেখা গানটাকে আমি কোনভাবেই এমপ্যাথি হিসেবে দেখতে পারি না, কেমন যেন কষ্টের সওদাগরি মনে হয়, মনে হয় পেইন পর্ন।  যেমন এই দেওরা গানে ভাবী দেবরকে হাত ছেড়ে দিতে বলছে, ব্যথা পাচ্ছে। তার মানে পুরুষটি জোরে ধরেছে হাত। দেবর জোর করে ভাবীর হাত ধরবে এটা পুরুষের ধর্ষকাম, ধর্ষকামকে প্রায়ই পৌরুষের সঙ্গে সিনোনিমাস বিবেচনা করা হয়। উল্টোদিকে নারীর আবেদন তার ভালনারেবলিটিতেই। নারী যত নরম শরম পুতুপুতু হবে তত সে পুরুষের কাম্য হবে। শক্তিমতী নারীকে পুরুষ পুজা করতে পারে, কিন্তু চায় না। পুরুষের ধর্ষকাম বনাম নারীর মর্ষকাম দিয়ে দারুণ বাইনারি অপোজিশন তৈরি করা হয় সব সময়ই। 

 

কিন্তু এই গানের ভিজুয়ালে জেন্ডারের এই বাইনারিকে ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে। ইসলামউদ্দিন পালাকার যাত্রাশিল্পী বলেই তার পক্ষে নারীসুলভ সাজসজ্জা স্বাভাবিক। হঠাৎ দেখে কুইয়ার মনে হওয়াও বিচিত্র নয়। আবার গানের ভার্সের নারী অংশ পালাকার গাইলেও পুরুষ ভার্স গেয়ে ওঠেন দুই নারী। গানের সঙ্গে যে নাচের কোরিওগ্রাফি সেখানে লিড দিতে দেখা যায় শাড়ী কাম প্যান্ট বা না-শাড়ী না-প্যান্ট পরা এক প্রবল নারীকে। পোশাক, ভারস, কোরিওগ্রাফি, কম্পোজিশন সব দিক দিয়েই জেন্ডার রোল পাল্টে গেছে বা মিলেমিশে একাকার। 

 

জেন্ডার যে একটা কোন স্থির বিষয় নয়, বাইনারিও নয়, বরং লিকুইড বা ফ্লুইড তা নিয়ে এই সময়ে নানান তাত্ত্বিক আলোচনা আছে। কিন্তু যেহেতু এইটা কোন তাত্ত্বিক লেখা নয় তাই সে আলোচনায় গেলাম না। তবে এ কথা বলতেই হবে যে দেওরা গানের পোশাক পরিকল্পনা আর সঙ্গীত আয়োজনে এইভাবে ফ্লুইড করে জেন্ডারগুলোকে দেখানোটা একটা দারুণ ব্যাপার ছিলো। এমন ফুর্তির একটা গান জেন্ডার নিউট্রাল হওয়া জরুরি। তবে, অল্প একটু ব্রিথিং স্পেস দিয়ে গানটাকে মিনিট পাঁচেক পর্যন্ত টানলে মজাটা আরও জমতো বলে সন্দেহ করি।