"কালো যদি মন্দ তবে কেশ পাকিলে কাঁদ কেনে?"
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তার কবি উপন্যাসে এই চরণ বলেছেন। আমরা কালো চুল পাকিলে কাঁদি আবার কালো অবজ্ঞা করি।
নারী দিবসের বিশেষ নাটক 'বিদিশা'য় এই কালো বা শ্যামা মেয়ের প্রতি অবজ্ঞা এবং সেই মেয়ের আত্মবিশ্বাসী মনোভাব ব্যক্ত হয়েছে। ৮ মার্চ নারী দিবস উপলক্ষে সিনেমাওয়ালার ইউটিউবে প্রচারিত হয় মুহাম্মদ মোস্তফা কামাল রাজ পরিচালিত 'বিদিশা' নাটক। গল্প লিখেছেন আবুল বাশার পিয়াস। নাটকটির কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন সাবিলা নূর। আরো আছেন শামীমা নাজনীন, সমু চৌধুরী, এরফান মৃধা শিবলু সহ আরো অনেকে।
যখন বিদিশা নিজের নিরাপত্তা হবে ভেবে শিক্ষার্থীর মায়ের নিকট বলতে গেল তখন তার নিকট থেকে তুচ্ছতাচ্ছিল্যের রোষানলে পড়তে হলো। নারী হয়ে নারীর কাছেই কি আশ্রয় মিলল? বাহ্যিক সৌন্দর্যের কাছে যারা পরাজয় স্বীকার করে। তাদের প্রতিনিধি শিক্ষার্থীর মা।
বিদিশার বাবা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দর্পণ স্বরুপ নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তার স্ত্রীর কথার বিপরীতে বলতে গিয়ে মেয়েকে বিদ্রুপ করতেও বাঁধল না। নিজের মেয়েকে বিষের সন্ধান দেয়। পরে মেয়ের সফলতায় সে মেয়ের প্রতি সদয় হয়। তবুও তার বিবাহ চিন্তা শেষ হয় না।
মেয়েরা তার মায়ের রূপ। বাংলার মেয়েরা হতে চায় তার মায়ের মত। নিজের পরিচয়ে মায়ের কথা বলতে বেশ স্বাচ্ছন্দবোধ করে। এই নাটকে মা চরিত্র সবসময় মেয়ের পাশে থাকে ছায়ার মত। মেয়ের মন খারাপের সময় মা মেয়েকে অনুপ্রেরণা দেয়। শিক্ষার কথা বলেন। মেয়ে শিক্ষা দিয়ে প্রতিশোধ নিতে তৈরি হয় বিসিএস দেয়ার জন্য। সকলের অবজ্ঞা পিছনে ফেলে বিদিশা প্রতিশোধ নেয়, মানে অবজ্ঞায় প্রতিশোধ!
আমি ব্যক্তিগতভাবে বন্ধু বিরোধী মানুষ। না আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি আসলে সবার বন্ধু। বিশেষ কারো সঙ্গে বন্ধুত্ব নেই, সবার সাথে আছে। কিন্তু দার্শনিক এরিস্টটল ব'লে গেছেন–
"যে সবার বন্ধু সে আসলে কারোই বন্ধু নয়।"
এই অর্থে বললাম, আমি বন্ধু বিরোধী মানুষ। নাটকে দেখতে পাই বিদিশার কয়েকজন বন্ধু 'সেলফি' তুলছে সেখানে তার ত্বকের কারণে বিদিশা থাকতে পারে না। পরিবারের পরে বন্ধুদের থেকে একজন মানুষ মানসিক প্রশান্তি পায়। কিন্তু সেই মানসিক শান্তি বিদিশার জন্য আরো অশান্তি বয়ে আনে।
"অবশ্য আপনার সাথে কে-ই বা প্রেম করবে আপনি দেখতে যে কালার কালা।" ঠিক এমন অভিব্যক্তি প্রকাশ করে কন্যা দেখে আসা বিবাহ বিচ্ছেদ সম্পন্ন জামাই। যাকে কিনা শ্যালিকা দুলাভাই হিসেবে পছন্দ করেনি। অবশ্য ছেলে নিজেকে সুদর্শন ও বেকার বলে পরিচয় দিয়ে মেয়ের বাবা মায়ের কাছে যৌতুক হিসেবে ব্যবসার পথ পেতে চায়।
নাটকে কালো মেয়ের মুক্তির পথ হিসেবে বিসিএস উল্লেখ করা হয়। বিসিএস ক্যাডার হবার পর কালো মেয়ের ত্বক কেউ দেখে না। বিদিশার শিক্ষার্থীর মা তার ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে। অন্যদিকে স্ত্রী পরিত্যক্ত 'সুদর্শন' ছেলে বিয়ে করতে রাজি হয়। আত্মবিশ্বাসী বিদিশা তাদের তীব্র কণ্ঠে তাদের না করে দেয়। অবশ্য এই রচনায় লেখক সফলতা হিসেবে বিসিএস উল্লেখ না করলে ঘটনাটি আরো বাস্তববাদী হত। মূলত এখানে বিসিএস পরীক্ষার প্রক্রিয়াকে খুব সংক্ষিপ্ত আকারে দেখানো তো একটু গ্যাপ মনে হয়েছে।
"আমি এমন কাউকে বিয়ে করব যে আমাকে সম্মান দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে বিয়ে করবে।" বিদিশার এমন আশার বাস্তবিক অর্থে কতটা প্রাপ্তি আছে তা নিয়ে গবেষণা প্রয়োজন। তবে উপন্যাস গল্পে আমরা অহরহ দেখতে পাই- কালো, শ্যামাঙ্গী কন্যাদের পরিপূর্ণ ভালোবাসা প্রাপ্তি। কালো বলে কি তারা সুন্দর না? তারা কালো তারপরও তারা সুন্দর বলেই পরিপূর্ণ ভালোবাসা তাদের প্রাপ্য। কাকে বলে সুন্দর? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে নব প্রবন্ধ রচনা করতে হবে। তাই সেদিকে যাচ্ছি না। তবে এটাই আসল কথা- বাহিরের, মানে ত্বকের সৌন্দর্য কখনো মানব সৌন্দর্য হতে পারে না।
বিদিশা চরিত্রের যে অভিনয় করেছেন তার মেকআপ বিভিন্ন দৃশ্য কম বেশি মনে হয়েছে। মনে হয় মেকআপ নিয়ে আরো কাজ করা যেত। তবে বিদিশার পোশাক-পরিচ্ছদ যথাযথ ছিলো। আপাতদৃষ্টিতে কালো বা শ্যামাঙ্গী মেয়েরা যে ধরেণ পোশাক করেন তা মিল পাওয়া যায়।
পরিশেষে, নাটকের গল্প নির্মাণ বেশ ভালো হয়েছে। বাংলা নাটকের সুফল বয়ে আনতে এমন নাটক প্রত্যাশা করে দর্শকরা। দর্শকদের মনো প্রাপ্তির পূর্ণতা বোঝা যায় মন্তব্য দেখলে। কেউ কেউ নিজের জীবনের সঙ্গে মিল খুঁজে পান নাটকের সঙ্গে। নাটক তো সমাজের দর্পণ স্বরুপ। বাংলা নাটক আরো ভালো দিকে ধাবিত হোক এই কামনা করি। এই নাটকটি দেখার পর লেখার চিন্তা আসে একজন কালো বা শ্যামা মেয়ের কষ্ট অনুধাবন করে। আমি মনে করি এই নাটকটি আমার চিন্তাজগত নাড়া দিতে পেরেছে। এরকম ইতিবাচক নাটকের ধারা অব্যহত থাকুক সবসময়।
লেখক: মুহাম্মদ আল ইমরান।
৩১শে আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৬ই অক্টোবর ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ।